সুবর্ণা মান্না
বারোশো স্কোয়্যার ফুট ফ্ল্যাটে চিনির সময় কাটে না। একঘেঁয়ে রুটিন তার। স্কুল থেকে ফিরে খাওয়া, সন্ধ্যায় প্রাইভেট টিউটর আসার আগে তাঁর হোমওয়ার্ক সেরে রাখা। তারপর টিভি, কম্পিউটার, মোবাইলফোন দেখে, ঘেঁটে, বিরক্ত হয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কমপ্লেক্সের বাইরে গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট বাড়ির ছেলে মেয়েগুলোর খেলা দেখা― এই তার রোজকার রুটিন । ব্যালকনিতে দাঁড়ালে চিনির একটু ভালো লাগে। এই সময় চিনি আকাশ দেখে, রাস্তার পাশে সারি সারি নীল সাদা রঙ করা দেবদারু গাছের সবুজ পাতার চূড়ায় বিকেলের পড়ন্ত রোদকে নামতে দেখে। ব্যস্ত গাড়ির দৌড় দেখে…আর রাস্তার পাশেই পড়ে থাকা মাঠে সমবয়সী ছেলে মেয়েগুলোকে খেলতে দেখে।ওরা কি সুন্দর খেলে। ওদের কত হাসি মজা ভেসে আসে বাতাসে।চিনি কান পেতে শোনার চেষ্টা করে..ওর খুব ভাব করতে ইচ্ছে করে ওদের সাথে। কিন্তু সুযোগ হয় না।তাছাড়া ওর মা বলে ওরা বস্তিবাসী, ওদের সাথে মিশতে নেই।
চিনিদের ফ্ল্যাটের কমপ্লেক্সে খেলা হয় না…ওদের কমপ্লেক্সের সমবয়সী সবাই স্কুল থেকে ফিরে সাঁতার, টেনিস, গান আঁকা, ক্যারাটে, দাবা শিখতে বেরিয়ে যায়। চিনির বাবা অর্ক সিনহা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাঙ্গালোরে থাকেন। কলকাতার সদ্য গজিয়ে ওঠা এই কমপ্লেক্স এর তিনতলায় পশ্চিমের দিকের থ্রী-বি-এইচ-কে ফ্ল্যাটে চিনি থাকে মায়ের সাথে। ওর মা তিতির সরকারি স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। চিনিও গান শেখে, বাড়িতে ওস্তাদজি আসেন। ক্যারাটে রবিবার সকালে, রবিবার বিকেলে টেনিস, তারপর আঁকা। রবিবার মায়ের ছুটি, সেই কারণে বাকি সব কিছু রবিবারের রুটিনে।
চিনির আর ভাললাগে না। দিন দিন সব কিছু বিরক্তি লাগছে। পড়াশোনা, ক্যারাটে, টেনিস ,গান, আঁকা সব। স্কুলে বকা খাচ্ছে, মিস বলেন ক্লাসে মনোযোগ নেই, বাড়িতে টিউটর তিতিরকে অভিযোগ করেছেন রোজ। পড়ার সময় অন্য মনস্ক। চিনি বুঝতে পারে.. মা তার ওপর বেশ বিরক্ত । কিন্তু মা-কে বোঝায় কি করে যে তার আজ কাল কিছুই ভাললাগে না।
আজ কয়েক সপ্তাহ চিনির মন বেশ ফুরফুরে। শিল্পীর সাথে তার খুব বন্ধুত্ব হয়েছে। শিল্পী ওদের কমপ্লেক্স বাইরের ওই ছোট ছোট বাড়িগুলোর কোনও একটায় থাকে। শিল্পী ওর মতো ক্লাস থ্রি তে পড়ে দূরের প্রাইমারী স্কুলটায়। সেদিন যখন চিনির ড্রাইভার কাকু গাড়িটা দাঁড় করিয়ে রাস্তার পাশে পান কিনতে গেল, একটা ছেলে দুম করে গাড়ির খোলা জানালা গলিয়ে একটা ময়লা স্কুলব্যাগ গাড়ির ভেতর ছুঁড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল। ছেলেটির পিছু পিছু কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসেছে একটি মেয়ে, চিনি জানলার বাইরে হাত গলিয়ে তাকে ব্যাগ ফেরত দিতেই চোখ মুছে একগাল হেসে মেয়েটি দুর্লভ জিনিস পাওয়ার মতো ব্যাগটা বুকের কাছে টেনে নিল। এরপর থেকে দেখা হলেই গাড়ি থেকে চিনি হাসে, আর শিল্পী রাস্তা থেকে… । শিল্পীর সাথে তার বন্ধুত্ব গভীর হয়ে ওঠে।
চিনির আর আজ কাল মনখারাপ করে না, খুশি মনে পড়াশোনা, আঁকা, টেনিস, গান,সবই তার এখন ভালো লাগে, একটা খুশি খুশি ভাব তার চোখেমুখে,একটা আনন্দের আবরণ যেন তাকে জড়িয়ে রেখেছে।চিনি আর আগের মতো ইস্কুল থেকে এসে সময় নষ্ট করে না, তাড়াতাড়ি খেয়ে হোম–ওয়ার্ক সেরে দৌড়ে নীচে চলে যায় , শিমলা মাসিকে বুঝিয়ে বলে যায় মা ফেরার আগেই ফিরবে সে। শিমলা মাসি তাকে দেখাশোনা করে। কমপ্লেক্স এর গেট পেরিয়ে উল্টো দিকের মাঠে চলে যায় চিনি, মাঠে তখন ছেলেমেয়েদের জটলা, হৈ হুল্লোড় খেলা, ওখানেই শিল্পী অপেক্ষা করে চিনির জন্য।শিল্পীর বন্ধু নেই, সেই দুষ্টু ছেলেটা শিল্পীকে মারে; খেলতে দেয় না। শিল্পীর সাথে থাকতে চিনির খুব ভালো লাগে, শিল্পী মায়ের কাছে শোনা গল্পগুলি চিনিকে শোনায়। এই ফ্ল্যাট গুলোর জায়গায় আগে নাকি এরকম ছোট বাড়ি অনেক ছিল, তারপর সেগুলো ভেঙে ফ্ল্যাট হয়েছে, শিল্পীর পুরোনো বন্ধুরা অন্য কোথাও চলে গেছে। শিল্পীর বাবা পটুয়া। কুমোরটুলিতে কাজ করতে যায়। কখনো কখনো চন্দননগরেও যায় মাটির পুতুল বানাতে। শিল্পীও মাটির পুতুল বানাতে পারে। যখন অনেক অর্ডার আসে তখন ও বাবাকে সাহায্য করে। ঘরের সবাই মিলে তখন মাটির পুতুল, মূর্তি বানায়। চিনিকে সে নাকি শিখিয়ে দেবে মাটির পুতুল বানাতে।
তিতির আজ স্কুলে হাফডিউটি করেই বাড়ি ফিরছে। কাল মেয়ের অঙ্ক পরীক্ষা, তারপর বিজ্ঞান। দুটো হলেই শেষ এ বছরের মতো। তিতির বেশ টেনশানে ভোগে। একদিকে স্কুলের চাপ। অন্য দিকে মেয়ের। দিন দিন উজ্জ্বল মেয়েটা কেমন যেন ম্রিয়মান হয়ে পড়ছে। দু মাস আগেই স্কুল থেকে অভিযোগ এসেছিল পড়াশোনা করছে না। কোনো কিছুই চিনি ঠিক মতো পারছে না। পড়াশোনার সাথে সাথে অন্য সব কিছুতেই তার অনীহা। সে হেডমিস্ট্রেস হয়ে অন্য টিচারের কাছে মেয়ের অভিযোগ শুনবে এ যেন চরম অপমান।চিনিকে কি সে ঠিক মতো মানুষ করতে পারছে না! না কি সে ঠিক সময় দিচ্ছে না তাকে! অনেক প্রশ্নের সাথে ব্যর্থতা তিতির কে ঘিরে ধরে।তাই এবারে তিতির একটু বেশি কঠোর হয়েছে মেয়ের প্রতি। মনে মনে ভাবে তার স্ট্রিক্ট নিয়মে এই দু মাসে চিনি যেন আবার প্রাণ উচ্ছল হয়ে উঠেছে হারানো নদী স্রোত গতি ফিরে পাওয়ার মতো।
বাড়ি ফিরে তিতির মেয়েকে দেখতে পেলোনা। যখন জানলো প্রতিদিন এই সময় ওই মাঠে ও খেলতে যায় আকাশ থেকে পড়লো, প্রথমে সব রাগ ঝাড়ে শিমলার ওপর।তারপর রওনা দিলো চিনি কে মাঠ থেকে নিয়ে আসতে। মনে মনে হতাশা রাগে দুঃখে গজ গজ করে, এই জন্যই বোধহয় মেয়েটির মন নেই কিছু তে, ওদের সাথে মিশে মিশে ওই ছোটলোক গুলোর মতোই হবে হয়তো মেয়ে। চিনি তখন একমনে কাদামাটি ঘাটছে পা ছড়িয়ে বসে শিল্পীর সাথে …তার জামায়, নাকে গালে কাদার শুকনো প্রলেপ, দুই বন্ধু কথায় গল্পে হাসি ঠাট্টায় ব্যস্ত। হঠাৎ কানে সজোরে টান পড়তেই চিনি মাথা ঘুরিয়ে দেখে মায়ের লাল চোখ, মায়ের মুখ দেখেই চিনি বুঝতে পারলো ঝড় উঠতে চলেছ ভীষণ। খেলা ছেড়ে মা কিছু বলার আগেই এক ছুটে মাঠ থেকে ঘরে। ভাব এমন যেন বন্ধুর সামনে অপমানিত হওয়ার চেয়ে ঘরে দ্বিগুন মার খাওয়া ভাল।
চিনি আবার আগের মতই ম্রিয়মান, ঝড়ে বিধ্বস্ত ছেড়া ফুলের মতই পরে থাকে ঘরে, কিছুই তার ভালো লাগে না। দু-মাস হয়ে গেছে চিনি আর খেলতে যায় না, মা সেদিন মারতে মারতে বলেছিল ―’বস্তি বাসীদের সাথে মিশে মিশে কু-শিক্ষা পাচ্ছে, মেয়ে আমার তাই এই হাল, বস্তিটাই তুলে দেওয়ার দরকার। ছোটলোক গুলো পরিবেশ নষ্ট করছে’― চিনি চায় না শিল্পীদের কেউ তুলে দিক ;ছোট বাড়িগুলোর আবার কষ্ট হোক। চিনি তাই শিল্পীর সাথে আড়ি করেছে, সে আগের মতো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখে….।ব্যালকনি থেকে শিল্পীকে দেখে। শিল্পী এখন ওদের সাথে খেলা করে, ছেলেটি আর বিরক্ত করেনা শিল্পীকে, চিনি কয়েকটা ক্যারাটের পোজ শিল্পীকে শিখিয়ে দিয়েছিল,সেটা প্রয়োগ করেই শিল্পী ছেলেটিকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে।
শিল্পীও বোঝে চিনির অকারণ এই আড়ির কারণ…। শিল্পীর মা বলে― ‘ওরা বড়লোক, আমাদের মতো মানুষদের কে বেঘর করে, কষ্ট দেওয়া ওদের কাজ…ওদের সাথে মিশবি না’। শিল্পী তাই সাহস পায়না কথা বলার।
আজ চিনির স্কুলে পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়া হবে। তিতির এর উদ্বেগ বেড়ে গেছে। অডিটোরিয়াম হলে পরিচিত অভিভাবকদের থেকে মুখ লুকিয়ে বসে আছে। মনে মনে সে নিশ্চিত মেয়ে তার পাস করবে না। এক সময়ের আত্ম অহংকার তার চূর্ণ হতে চলেছে, নিজের ব্যর্থতাই যেন প্রকট হয়ে উঠছে সামনে।পাশে চিনি অন্যমনস্ক ভাবে বসে। মঞ্চে হেডমিস্ট্রেস ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড পজিশনে থাকা স্টুডেন্টকে ডেকে পুরস্কার দিচ্ছেন।
এবার ক্লাস থ্রী এর পালা। …প্রথম, দ্বিতীয় ঘোষণার পর তৃতীয় পজিশনে নাম ডাকা হলো “উদিতা সিনহা। তিতির কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না নিজের কানকে, চিনি কে মঞ্চে ডাকা হচ্ছে। চিনি তৃতীয় হয়েছে!! মেয়েটি তার পাশ করেছে! তিতির সম্বিৎ ফিরতেই দেখে চিনি ততক্ষনে মঞ্চের ওপর। চিনির হাতে দুটি পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন হেডমিস্ট্রেস।একটি পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান পাওয়ার জন্য, আরেক টি “আর্টিস্ট অফ দ্য ইয়ার’ এর। হেড মিস্ট্রেস হাতে রাখা দুটি মাটির পুতুল―, দেখিয়ে বললেন প্রতি বছরের মতো স্কুলে আর্ট কম্পিটিশন এ যে ফার্স্ট হয় তার বানানো মডেল আমাদের সংগ্রহশালায় রাখা হয়, মাটির তৈরি এই গুপীবাঘা দুটি আমাদের স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী উদিতা সিনহা বানিয়ে প্রথম স্থান পেয়েছে, এই মাটির পুতুল দুটি আমাদের সংগ্রহশালায় রাখা হবে যাতে জুনিয়র ছাত্র ছাত্রীরা অনুপ্রেরণা পায়।
তিতির এর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না এমনকি মঞ্চে চিনিকেও না আর…।তার শুধু মনে পড়ছে মাঠের এক কোনায় কাদা মাটি মেখে দুটি পুতুল হাসতে হাসতে গল্প করতে করতে পুতুল বানাচ্ছে।
কমেন্টস
বৈভবপূর্ণ সমাজ শুধু ডিগ্ৰী দেয়। দেয়না প্রকৃত শিক্ষা।এ গল্প তারই প্রতিচ্ছবি। সুন্দর উপস্থাপনা।
we need ethics and true learning of life , very nice and moralistic story thank you
আড়ি-ভাব সুন্দর গল্প।