সুবর্ণা মান্না।

রাস্তায় ভিড় বেড়েছে,  অফিস ছুটি হলে এই সময় ফুটপাথে পা ফেলা দায়। তার ওপর ফুটপাথ জুড়ে গজিয়ে ওঠা দোকানগুলিকে মানুষ মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরেছে। জটলা জটলা ভীড়ের ধার ঘেঁষে; লোকের গা বাঁচিয়ে কৌশিক এগিয়ে চলেছে ফুটপাথ ধরে, কখনও এর ওর ধাক্কা খাচ্ছে…অন্যদিন হলে বেশ বিরক্ত হয়, আজ কিন্তু সে নিজেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে।

ফুটপাথে হকারদের গলা চড়ছে। “দাদা এদিকে আসুন, দিদি আসুন কমে পাবেন”। কৌশিক ভীড়ের মাঝে গলা বাড়িয়ে দেখে নিচ্ছে কোনটা কিসের দোকান।

পর পর রং বেরঙের কুর্তির দোকান। কৌশিক দাঁড়িয়ে পড়লো।  হাঙ্গারে ঝোলানো জামাগুলির গায়ে হাত বুলিয়ে দেখলো একটার পর একটা। মীরার কি পছন্দ হবে! বিড়বিড় করে বললো, মনের কথাটা লুফে নিয়ে হকারটি বললো “ নিয়ে যান দাদা বউদির খুব পছন্দ হবে,” কৌশিক আর দাঁড়ায় না, ওই দোকান ছেড়ে এগিয়ে যায়।

প্রতিবার মীরাকে পুজোর সময় বেশ কয়েকটি কুর্তি কিনে দেয় কৌশিক, খুব দামি না হলেও মীরার পছন্দসই এনে দেয় সে, মীরার কাছে এ কোনো নতুনত্ব নয়,…আজ কৌশিকের জীবনের বিশেষ দিন, এই দিনটিতে সে মীরা কে জীবনসঙ্গী করে সংসার সাগরে ডুব দিয়েছিল।দেখতে দেখতে দশ বছর পেরিয়ে গেছে। আজ তাদের দশম বিবাহ বার্ষিকী।এই বিশেষ দিনে কোনো বিশেষ উপহার সে নিয়ে যাবে মীরার জন্য…।

কুর্তি ঠিক তার মনে ধরল না। কুর্তির অনেকগুলো দোকান পেরিয়ে থমকে দাঁড়াল কাঁচঢাকা বড় দোকানের সামনে। দোকানের সামনে দেওয়ালে ডিসপ্লে বক্সে রাখা লাল, নীল, সবুজ শাড়িতে চোখ আটকে গেলো…।বেশ সুন্দর। মনে মনে মীরার গায়ে শাড়িগুলো জড়িয়ে নিয়ে কৌশিক এক ঝলক দেখে নিল। মনে মনে ভাবল বেশ মানাবে, ফর্সা গায়ের রঙ, আর ছিমছাম মুখশ্রীতে। এক প্রকার চঞ্চল পায়ে দোকানে ঢুকে পড়লো কৌশিক। দোকানের সামনে দাঁড়ানো কর্মচারীকে শাড়িটি দেখিয়ে দাম জিজ্ঞেস করল-

নির্লিপ্ত ভাবে কর্মচারিটি বলল” আট হাজার টাকা থেকে শুরু স্যার,  দেখাবো?”

“–আট…!! এর কম…”বাকিটা বলার মতো সাহস হলো না কৌশিকের..।

–“ওই শাড়ি আসবে না স্যার“ কত বাজেট আপনার? অন্য শাড়ি হবে স্যার দেখাব? দু হাজার তিন হাজার…

কৌশিক প্যান্টের পকেট চেপে ধরে। জমানো টাকাটা আছে তো? মাসের শেষ…  রঙের একটা দোকানের কর্মচারীর কতই বা মাইনে হবে। বর্তমান বাজারে আট হাজার টাকায় সংসার চালানো আর যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রুর সামনে বিনা হাতিয়ারে দাঁড়ানো সমান বলে মনে হয় কৌশিকের তবুও বাঁচতে হবে,বাঁচাতে হবে আট বছরের ছেলে আর মীরাকে নিয়ে গড়ে তোলা ছোট্ট সংসারকে- শুধু এই সংকল্প নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সে দিনের পর দিন…..

কর্মচারিটিকে থামিয়ে দিয়ে সংকোচের সুরে মিন মিন স্বরে বললো

–“এই আটশো টাকার মধ্যে…?

লোকটি তাক বেয়ে কটা শাড়ি নামালো…কৌশিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো, এরকম দু তিনটে  শাড়ি মীরার আছে, অনুষ্ঠানে পরে,। – তাকের দিকে উঁকি মেরে বললো―” এর থেকে ভাল…?”

― “হবে না দাদা, আপনার যা বাজেট, এই আসবে”..

কর্মচারীর মুখে বিরক্তির ভাব দেখে কৌশিক আর কথা বাড়ায় না। যত উৎসাহে দোকানের ভেতরে ঢুকেছিলো ততটাই সংকোচে লজ্জায় তড়িঘড়ি করে বাইরে বেরিয়ে এলো। পথের পাশে ব্যাগের দোকান ভ্যানিটি ব্যাগ, ছোট বড়, নানান আকারের, নাহ কৌশিক দাঁড়ায় না, ব্যাগ খুব একটা পছন্দ করে না মীরা। ইমিটিসন এর দোকানও দেখতে দেখতে পারে হয়ে যায়। এসব দুল গলার হার মীরার আছে, দু একবার কিনে দিয়েছে কৌশিক কিন্তু মীরাকে তেমন পরতে দেখেনি। হয়তো পছন্দ করে না….।

হাত ঘড়ি দেখে নেয় একবার। ট্রেনের টাইম হয়ে গেছে। গড়িয়াহাট বাজার পেরিয়ে বালিগঞ্জ স্টেশনে  আসতে আর দশ মিনিট লাগবে। জোড়ে পা চালায় কৌশিক, ক্যানিং যাওয়ার এই ট্রেনটা মিস করলে আর এক/ দেড় ঘণ্টা পরে ট্রেন, তাও সেটায় ভীড়ে ওঠা যাবে কিনা সন্দেহ….। কৌশিক পা চালায় আরো জোড়ে, দু পাশের দোকানগুলো হুস হুস করে পেরিয়ে যাচ্ছে তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে…..যেমনটি করে নিম্নবিত্তের হাতের নাগালের বাইরে স্বপ্ন আশা পেরিয়ে যায়….।

নাহ ! ট্রেনটা সে পেলো না। ওভার ব্রীজ থেকে নামতে নামতে প্লাটফর্ম ছেড়ে এগুতে শুরু করেছে ট্রেন। আজই দরকার আর আজই ঠিক সময়ই ট্রেনটা পার হয়ে গেল।অন্যদিন পাঁচ/দশ মিনিট লেট করে…

ভাবতে ভাবতে সোনারপুর লোকাল ঢুকলো, কৌশিক উঠে গেল ট্রেনে। বালিগঞ্জ এ বসে না থেকে সোনারপুর পর্যন্ত চলে যাবে ফাঁকায় ফাঁকায়, ওখানে পরের ক্যানিং ট্রেন অনেকটা ফাঁকা হয়ে যায়, সেটাতে উঠে যেতে পারবে সহজেই, তারপর চম্পাহাটি নেমে কিছুটা হাঁটলেই কৌশিকের বাড়ি ।

সোনারপুর প্লাটফর্মে বসে আছে প্রায় পাঁচ মিনিট, ক্যানিং ট্রেন আসতে বেশ দেরি। বসন্তের মিষ্টি হাওয়া চুলে এসে লাগছে, দূরে কোথাও কোকিল আনমনে ডাকছে, প্লাটফর্মের পাশে কৃষ্ণচূড়া  গাছটায় ফুলে ফুলে লাল…সন্ধ্যায় পাখিরা ফিরেছে বাসায়..তাদের কোলাহলে স্টেশন চত্তর মুখর…..কৌশিকের মনটা মুষড়ে গেছে। অর্থাভাব মানুষের মনটাকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দেয়, তার ছোট ছোট আশা গুলি যখন  সামর্থের অভাবে অকালে মরতে থাকে তখন নিজেকে সব থেকে অকর্মণ্য অক্ষম মনে হয়। কৌশিকের ও আজ সেই রকম বোধ হচ্ছে। এই দশ বছর মীরাকে সেভাবে কিছু দিয়ে উঠতে পারে নি, মেয়েটি শান্ত তাই মেনে নেয় সব কিছু। প্রতি বছর বিবাহ বার্ষিকীতে মীরা যত্ন করে কৌশিকের পছন্দের খাবার বানায়,। সংসারের চাল ডাল থেকে বাঁচিয়ে কিভাবে যে  সুস্বাদু খাবারের এত উপকরণ ব্যবস্থা করে সে কৌশিকের অজানা,  রান্নার হাত ভালো ।কৌশিকের মন তৃপ্তিতে ভরে যায়।প্রতি বছর ফুল চকলেট উপহার দিত কৌশিক, দশম বিবাহ বার্ষিকীতে ভালো একটা কিছু উপহার মীরাকে দেবে ভেবে রেখেছিল সে, কোনো রকমে খরচ বাঁচিয়ে এদিক কেটে ওদিক টেনে আটশো টাকা জমাতে পেরেছে কৌশিক। সোনা হীরে মুক্ত উপহার দেওয়ার মতো ক্ষমতা তার নেই, পোশাক সব মেয়েদের পছন্দ, তাই সেই চেষ্টা করছিল….কিন্তু সব ই বিফলে।……”আরে কৌশিক যে!!

পুরনো বন্ধু প্রবীরের বাজখাই স্বরে কৌশিকের ঘোর কাটলো। এতটাই অন্যমনস্ক ছিল বুঝতেই পারেনি প্রবীর তার পাশে  বসে পড়েছে। খুশিতে কৌশিক জড়িয়ে ধরলো তাকে। ―”আরে ট্রেন মিস করেছি,পরের ট্রেনটা ধরবো, তাই…

―সে তো অনেক দেরি,ক্যান্সেল করেছে ট্রেনটা, পরের ট্রেন দু ঘন্টা পর …চল ঘুরে আসি” গল্প হবে..

কৌশিকের ইচ্ছে নেই, মন খারাপ কিন্তু কারন বলতে পারলো না, যদি ট্রিট চায়,…উপহারের টাকাটা কিছুতেই সে খরচা করবে না,। অগত্যা প্রবীরের পাশে পাশে এগিয়ে চললো। স্টেশন ক্রস করে কিছুটা  এগিয়ে আসলো ওরা, বই মেলার বড় গেট ।

কৌশিকের ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু না বলার উপায় নেই, প্রবীরের চাপে একরকম নিমরাজি হয়ে বই মেলায় ঢুকে পড়লো সে, প্রবীর বই পাগল সেই স্কুল লাইফ থেকে, কতবার স্কুলের লাইব্রেরীর বই চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে তার হিসেব কৌশিক জানে। স্টলে ঢুকে ঢুকে বই দেখছে প্রবীর। কৌশিকের ভীষণ একঘেঁয়ে লাগছে। বই তার ভালো লাগে না।পড়ার বই কোনোরকমে পড়েছে। গল্প বই থেকে শত হাত দূরে থাকে সে।মীরা ঠিক তার উল্টো, ভীষণ রকম বই পোকা,এর থেকে ওর থেকে চেয়ে তো বই পড়েই, কাগজের ঠোঙায় কিছু পড়া পেলে সেটাও পড়ে, এই কিছুদিন আগে এই নিয়ে বিশাল অশান্তি হয়ে গেল দুজনের। এমনিতে মীরা শান্ত, কোনো চাহিদা তার নেই, না গয়নার ,না পোশাকের…সেদিন হটাৎযে কি হলো স্থানীয় বই মেলায় গিয়ে বায়না জুড়লো “বনফুলের ছোটগল্পসমগ্র” সব খন্ড কিনবে। সব কটি খন্ড মিলে দাম দেখে চক্ষু কপালে কৌশিকের বলে কিনা ন শো টাকা। এত টাকা!!! তিন সপ্তাহের বাজার হয়ে যাবে ওই টাকায়। কষ্টের টাকা বই কিনে নষ্ট করবে সে!!! এ কখনও হতে পারে না…কৌশিক সরাসরি না বলে মেলা থেকে বেরিয়ে এলো, এর রেশ বেশ কদিন ছিল, মুখ গোমড়া, লুকিয়ে চোখের জল ফেলা…কত কি।কৌশিক বুঝে পায় না বই দেখলে পাকা গিন্নীটা কেমন অবুঝ ছেলেমানুষ হয়ে ওঠে।

পায়ে পায়ে আরেকটা স্টলের সামনে দাঁড়ায় কৌশিক।বেশ ভালো রকম ডিসকাউন্ট দিচ্ছে এখানে,।ওই তো “বনফুলের ছোটগল্প সমগ্র”…

সেদিনের মীরার করুন মুখটা কৌশিকের মনে পড়ে যায়….বুকের বাঁ দিক মোচড় দিয়ে ওঠে।…কি বা দিয়েছে এই দশ বছরে ওর পছন্দের…সবার ভালোলাগা ভালোবাসা তো সমান হয় না…মীরা বই ভালোবাসে তাই ওর এত আকুলতা….

―”বনফুলের ওই গল্পের সবকটি খন্ড ডিসকাউন্ট দিয়ে কত দাম আসবে দাদা…?”

―সাতশো টাকা…,দোকানি হিসেব কসে বলে।

কৌশিকের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। পকেট হাতড়ে টাকা বার করে গুনে গুনে সাত শো টাকা দোকানীর হাতে দিয়ে বলে..―

―দিয়ে দিন দাদা…

বইয়ের প্যাকেট টা হাতে নিয়ে প্রবীরের পিঠ চাপড়ে বলে ―”চল তোকে মিষ্টি খাওয়াই ..আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী”।

প্রবীর আনন্দে জড়িয়ে ধরলো…..কৌশিকের চোখে তখন বার বার শুধু মীরার আনন্দে চিক চিক করা দুটি চোখ,আর ঠোঁটে তৃপ্তির হাসিটা ভেসে উঠছে…….