লেখা – প্রতিম রাহা |
ভৌতিক কাণ্ডে আমি তেমন একটা বিশ্বাসী কোনোকালেই ছিলাম না। তবে বিষয়টা আমার কাছে বরাবরই প্রিয়। গল্পাকারে বা টিভির পর্দায় যদি কখনও-সখনও এসেই পড়ে, নেহাত মন্দ লাগে না। কিন্তু আজ যে অভিজ্ঞতার কথা জানাতে চলেছি, তেমনটা আমার জীবনে একবারই হয়েছে। সেটা ভুত না অদ্ভুত, তা আমি নিজেই এখনও পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারিনি। সেটা বিচারের দায়িত্ব তাই পাঠকদের উপরেই দিলাম।
সেটা এক রোববারের দুপুর ছিল মনে আছে। শ্রাবণের মাঝামাঝি, সকাল থেকে আকাশের মুখ গোমড়া। রাস্তাঘাট ফাঁকা বললেই চলে। আমি একটা কাজে পার্ক সার্কাসের দিকে গিয়েছিলাম। তবে দুপুর দুপুর কাজ মিটে গেছে। বাড়ি ফেরার বিশেষ তাড়া নেই। ঘড়িতে বলছে ৩টে বেজে পাঁচ। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিশেষ ভরসা পেলাম না। যে কোন মুহূর্তে ঢালবে। জোরেই পা চালাচ্ছিলাম। উদ্দেশ্য পার্ক স্ট্রিট মেট্রো। ডাইনে ওয়াইট হাউজ বিল্ডিং-এর কাছে এসে কি মনে হতে একবার ঘাড় ঘোরাতেই রাস্তার ওপারে জেলখানার মত উঁচু পাঁচিলটা দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বড় বড় আমগাছের ডালের ফাঁক দিয়ে পাঁচিলের ওপাশ থেকে ত্রিভুজের মত টোম্বগুলো মাথা উচিয়ে আছে। গায়ে শ্যাওলার পুরু ছ্যাতলা বেশ বোঝা যায়। আধ ভেজানো গেটের ভেতর ক্রসটা এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে, South Park Street Cemetery , Open-1767, Closed-1790.
এর আগে একবারই এসেছি এই সিমেট্রিতে। কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন কবরস্থান দর্শনে ভালই ভিড় হয় প্রতিদিন। যারা আসে, তাদের মধ্যে কমবয়সীদের সংখ্যাই বেশি। তবে মেঘাছন্ন আকাশ বলে কী রোববারের দুপুর বলে জানি না, জায়গাটা আজ অস্বাভাবিক ফাঁকা। আর সেই কারণেই সম্ভবত একবার ভিতরে ঢোকার ইচ্ছে হল।
গেট দিয়ে ঢুকে বুঝলাম, আজ দর্শনার্থী নেই বললেই চলে। শুধু বেঁটেখাটো দারোয়ান শেডের তলায় বসে ঢুলছে। খাতায় নাম লিখে সবে পা বাড়াতে যাব, পিছন থেকে দারোয়ানের গলা ভেসে এল, ‘বৃষ্টির সময় ভেতরে না যাওয়াই ভালো। আর এমনিতেও একটু পরে বন্ধ হয়ে যাবে’।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন গেলে কি হবে’ ?
একটু রহস্যময় গলায় উত্তর এল, ” জানি না। ওপর থেকে অর্ডার আছে বৃষ্টির সময় ভেতরে কাউকে ঢুকতে না দিতে।”
হেসে বললাম, ‘আরে, বৃষ্টি তো এখনো শুরু হয়নি। বেশিক্ষণ সময় নেব না, এক্ষুনি ফিরব’।
এই বলে আমি পা বাড়ালাম। বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে বুঝলাম, আকাশে মেঘ থাকার জন্য অন্ধকারটা একটু বেশিই লাগছে এখানে। ধীরে ধীরে গাড়ির আওয়াজ কমে আসছে। দুপাশে শ্যাওলার ছ্যাতলা পড়া দুশো বছরের সৌধের মাঝে মাঝে শ্যাওলাবিহীন টোম্ব গুলো দেখেই বোঝা যায়, সদ্য তৈরি হয়েছে। ক্রমে উইলিয়াম জোন্স, রবার্ট কিড, জর্জ এগেলস্টন-এর সমাধি ছাড়িয়ে যেই ডান পাশে ঘুরেছি, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু। অগত্যা ছাতা বের করতেই হল। ভিজে রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগিয়েছি, হঠাৎ বাঁ পাশের সৌধের আড়াল থেকে ক্যামেরা গলায় এক বিদেশিনী তাড়াহুড়োয় বেরোলেন আর আমায় দেখতে পেয়ে ‘গুড আফটারনুন’ বলেই দ্রুত গেটের দিকে চলে গেলেন। তাকে উত্তর দেওয়ার সময় পেলাম না আমি। তবে মনে হল, আজকের আফটারনুনটা ততটাও গুড নয় বলতে গেলে।
যাই হোক, এগোতে লাগলাম। বৃষ্টির তেজ ক্রমেই বাড়ছে। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ার দাপটও। অগাস্টাস ক্লেভল্যান্ড সাহেবের সমাধির কাছে গিয়েই রাস্তা ফুরলো। এরপর কাদা মাটি ঘাস, সব একাকার হয়ে গেছে। এখন শুধু বৃষ্টির শব্দ ঝঙ্কার তুলছে আম, অশ্বত্থের জঙ্গলে পরিণত এই আড়াইশ বছরের গোরস্থানে। বিদ্যুৎ চমকালো। জানি না কেন, ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। তাই রাস্তা ছেড়ে এবার মাটিতে নামলাম। হাওয়ার দাপটে বৃষ্টিটা হেলে এসে গায়ে ঠেকছে । কাদা বাঁচিয়ে পা সাবধানে ফেলছি, এমন সময় একটা ঝুপ ঝুপ শব্দ কানে এল। সামনে থেকে আসছে শব্দটা। একটা উঁচু সমাধির গা দিয়ে ঝরনার মত জল পড়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। ফলকে খোদাই করা নামটা চোখে এল ‘ক্যাপ্টেন ডেনিস বডকিন’। কত সালে মারা গেছে, সেটা দেখার আগেই বৃষ্টিটা তিনগুন বেড়ে গেল এক নিমেষে। আমি উপায়ন্তর না দেখে একটু ছুটে এগিয়েই একটা গোল মাথা সৌধের নীচে আশ্রয় নিলাম। এটা অনেকটা মসজিদের ধাঁচে তৈরি একটা সৌধ। আকারে যদিও তার চেয়ে অনেকই ছোট। ঝুপ ঝুপ শব্দটা আর একটু জোর শুনতে পাচ্ছি এখান থেকে। তবে কোথায় তার উৎপত্তি, তা বেরিয়ে দেখার উপায় নেই, এতটাই জোর হচ্ছে এখন বৃষ্টিটা।
ছাতাটা পাশে নামিয়ে রেখেছি। ঠিক এই মুহূর্তে এখানে দাঁড়িয়ে এটা উপলব্ধি করা কঠিন, যে এর বাইরেই একটা জমজমাট শহর বহাল তবিয়তে রয়েছে। আমি যার সৌধের নিচে আশ্রয় নিয়েছি, তার নামটা চোখে পড়ল। এলিজাবেথ এমা টেইলর, ওয়াইফ অফ জেমস টেইলর, এটর্নি টু দ্য অনারেবেল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ক্যালকাটা, ডায়েড ৩১ জুলাই, ১৮০৯, এজড ৩৫ ইয়ারস। অর্থাৎ প্রায় ২০৮ বছর আগে মারা গিয়েছেন তিনি।
দাঁড়িয়ে রয়েছি তো রয়েছি। বৃষ্টি কমার কোনও লক্ষণ নেই। ঝুপঝুপ শব্দটা প্রতি ৩ মিনিট ছাড়া কানে আসছে। আর মাথায় সব আবোল তাবোল ভাবনা ঘুরছে। ভাবছি, যেখানে শেষ সমাধি কয়েকশো বছর আগে এসেছে, সেখানে ভুত থাকার সম্ভবনা কতটা। আর যদি ভাগ্যক্রমে তেঁনাদের একজন দেখা দিয়েই দেয়, তবে রাম নাম নেব, না যিশু খ্রিস্টকে জপব? সিমেট্রিতে দাঁড়িয়ে রামনাম নেওয়াটা খুব একটা সুবিধেজনক নাও হতে পারে, এদিকে হিন্দু হয়ে যিশুকে ডাকলে কতটা কাজে আসবে, তা-ও আন্দাজ করা কঠিন।
ভাবনা-চিন্তা চলছিলই, এমন সময় আকাশ চিরে একটা বেগুনি আলোর ঝলকা আর সঙ্গে সঙ্গেই কানের কাছে একসঙ্গে দশটা টায়ার ফাটার শব্দ! ৪ টে বেজে গেছে। দারোয়ান গেট বন্ধ করে দিলে গেলাম! ভাবছি, এই তুমুল বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ফিরব কিনা, এমন সময় উল্টোদিকের একটা সৌধের মধ্যে কি যেন নড়ে উঠলো। জায়গাটা অন্ধকার হয়ে আছে প্রথম থেকেই দেখেছি। এই বর্ষার দিনে একটা সৌধের ভিতর কী আর থাকবে, এই ভেবেই মনোযোগ দিইনি আসার থেকে। কিন্তু এই নড়াতেই প্রথম চোখে এল কিছু একটার অস্তিত্ব। আমি সোজা তাকিয়ে আছি ওই দিকে। আশপাশ দূরে থাক, দুশো গজের মধ্যে এখন কেউ নেই, এটা আমি নিশ্চিত। তবে ওটা কী!
আবার নড়ল! আচমকা আরেকটা বিদ্যুতের ঝিলিকে আলোটা ওই জায়গায় পড়তেই এবার পরিস্কার দেখতে পেলাম একটা মানুষের পা। তবে দাঁড়ানো নয়। শুয়ে থাকলে যেমন থাকে, তেমন ভাবে। আমার হার্টবিট সম্ভবত এইবার দ্রুত হল। ছাতাটা হাতে তুলে নিয়েছি আবার। ভাবা হয়ে গেছে, বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ফিরব। তবে পরিস্কার বুঝতে পারলাম, একজন চিত হয়ে শুয়ে থেকে যেমন করে উঠে বসে, সেই ভঙ্গিমায় একজন উঠছে। দাতে দাঁত চেপে আমি তাকিয়ে রয়েছি সেই দিকে। বিপদে পড়লে এখান থেকে চিৎকার করেও কোনও লাভ হবে না, সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারছি।
যিনি উঠলেন সৌধের ভিতর থেকে , তিনি এবার বাইরের দিকে এগিয়ে আসছেন। অর্থাৎ যে সৌধটার মধ্যে আমি দাঁড়িয়ে আছি, তার দিকে।
ভিতরটা অন্ধকার থাকার জন্য তার চেহারা এখনও স্পষ্ট নয়। স্পষ্ট হোক, তা আমি চাইও না। আর কোনওদিকে না তাকিয়ে একরকম লাফ মেরেই নামলাম। জল কাদা ছিটকে প্যান্টে উঠে এল। ছাতাটা না খুলে ভিজতে ভিজতেই একরকম পা চালাচ্ছি, হঠাৎ পিছন থেকে ভারী গলায় শুনলাম, ‘দাদা…’
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার সাহস নেই। তবে ডাকের আকস্মিকতায় আমি দাঁড়িয়ে পড়েছি। সম্মোহিতের মতো এবার ঘাড় ঘোরাতেই দেখলাম, শার্ট আর ময়লা লুঙ্গি পরে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখলে মনে হয় নেহাতই নিরীহ দিনমজুর। বৃষ্টির শব্দ এড়াতেই লোকটা একটু চেঁচিয়ে কথা বলছিল।
‘‘ওপাশে মেরামতির কাজ চলছে। কখন ঘুম্মে পড়েছি, খেয়াল নেই। তায় উঠে দেখি বিষ্টি পরচে। আপনার তো ছাতা রয়েছে। বলছিলাম, গেট অবধি এজ্ঞে দেবেন? ’’
গুরুদেবের গল্পখানা মনে এল। গোরস্থানে সত্যিই সাবধান হওয়া উচিত ছিল!!
কমেন্টস
সুন্দর গল্প অদ্ভুত।