লেখক – সুবর্ণা মান্না|
দীঘির পাড়ে একশো বছরের পুরনো বট গাছটি আজ স্থির দৃষ্টিতে দেখছে চিতায় সাজানো সাতাশ বছরের মেয়েটির শব দেহের দাহ। দীঘির ঠিক উল্টো দিকে এই গ্রাম্য শ্মশানে শবদাহ বট গাছটি প্রায় দেখে। কিন্তু আজ তার বড্ড খারাপ লাগছে। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা শেকড় থেকে ডালপালা হয়ে পাতায় পাতায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। নিস্পলক ভাবে শুধু চিতার আগুনকে দেখছে। মেয়েটির চিতা থেকে উঠে আসা কালো ধোঁয়ার কুণ্ডুলি তার পাতা ছুঁয়ে উন্মুক্ত আকাশে মিলিয়ে যেতে যেতে মনে করিয়ে দিচ্ছে কত কথা।
বট গাছটি যখন প্রথম দেখেছিল মেয়েটিকে তখন মেয়েটির বয়স এক বছরও হয়নি, ঘাটে বসে ওর মা কোলে চিৎ করে শুয়ে মাথাটা ধুয়ে দিচ্ছিল। আর মেয়েটি নিষ্পাপ চোখে বটগাছের পাতার নাচন দেখে খিলখিলিয়ে হেসেছিল, যত হেসেছে বটগাছও তার ডাল পালা পাতা দুলিয়ে হাসিয়েছিল তাকে। তারপর থেকে প্রতিদিন সে মায়ের সঙ্গে আসতো।
ওর মা বাসন মাজতো, কাপড় কাচতো, স্নান করতো, আর মেয়েটি কখনও টলমল পায়ে বটগাছের নিচে ঘুরে বেড়াতো, কখনো বা নরম ছোট্ট হাতে গাছের গায়ে হাত বোলাতো। এইভাবেই যত বছর ঘুরেছে ছোট্ট শিশুটির কৈশর, যৌবন সবেরই সাক্ষী এই বটগাছ।
আজ বটগাছের খুব মনে পড়ছে সেইদিনটা-মেয়েটি তখন সাত কি আট। একমনে তার গোড়ায় বসে তার ডালপালার ছায়ায় খেলাঘর সাজিয়ে খেলছিল, মেয়েটির মা ‘নীলু নীলু’ ডেকে উঠতেই নীলু লুকিয়ে পড়েছিল তার গুঁড়ির আড়ালে আর ওর মা খুঁজে না পেয়ে দীঘিতে পড়ে যাওয়ার ভয়ে খুব কান্নাকাটি করেছিল। সেদিন নীলু আর বটগাছ খুব হেসেছিল।
আজ ওর মাকে দেখা যাচ্ছে না। চিতার পাশ থেকে কিছু কাগজ হাওয়ায় পাক খেতে খেতে বটগাছের গা ছুঁয়ে চলে গেল, মনে পড়ে সেই দিনটা, এই যে ঝুরি গুলো নেমেছে মাটির দিকে তারই কিছুটা জুড়ে একটা দোলনা বাঁধা আছে, ঠিক এইখানেই বসে দুলতে দুলতে মেয়েটি কার যেন চিঠি পড়ছিল, আর মাঝে মাঝে আকাশের দিকে মুখ করে আপন মনে হাসছিল। পরে ঘাটে আসা গ্রামের অন্য গৃহিনীদের কথাবার্তায় বট গাছ জানতে পারে এই গ্রামের ধনী বাড়ির ছেলের সঙ্গে নীলুর প্রেমের কথা, বিয়ের কথা, ছেলের বাড়ি থেকে মেনে না নেওয়ার কথাও। তবে শেষ অবধি বিয়ে হয় ছেলেটির সঙ্গে।বিয়ের পরের দিন বিদায়ের আগে লাল বেনারসী পড়া মেয়েটি এসেছিল বটগাছের পাশেই কালীমন্দিরে প্রণাম করতে, কালী মায়ের মতোই বট গাছটিও মনে মনে অনেক আশীর্বাদ করেছিলো সুখী হওয়ার, দীর্ঘায়ু হওয়ার। সব আজ বিফলে গেল।
চিতার আগুন কিছুটা নিভে এসেছে..পোড়া কাঠ ভাঙা হাঁড়ি কলসি ছড়ানো, কিছুটা দূরে দাহ করতে আসা গ্রামের লোকগুলি চিতা নেভার অপেক্ষায় জড়ো হয়ে বসে। তাদের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠে ‘কি দরকার ছিল নীলুর আত্মহত্যা করার? অনেকের স্বামী কাজের জন্য তো বাইরে থাকে, তো এত ঝগড়াঝাটি করে আত্মহত্যা না করলেই পারত।’ আর একজন বললো ‘স্বামী তো ভালো শুনেছি, কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ি বেশ অশান্তি করতো ,কিন্তু কি এমন ঘটলো যে বাপের বাড়ি আসার নাম করে এখানে এসে আত্মহত্যা করল?’ এই সব আলোচনা শুনতে আর ভাল লাগছে না বট গাছের, ইচ্ছে করছে দু হাতে কান চাপা দিয়ে সরে যেতে…. নয়তো চিৎকার করে জানাতে নীলু আত্মহত্যা করে নি।কেউ না জানুক একমাত্র সে জানে….দুদিন আগের রাতের বীভৎস ঘটনা বটগাছ কিছুতেই ভুলবে না, ভুলতে পারবে না।
এদিকে দিনে যত লোক চলাচল করুক না কেন সন্ধ্যার পর শ্মশান থাকায় গ্রামের লোক এদিকটায় আসেই না, পরশু মাঝরাতে অমাবস্যার নিকষ কালো আঁধার ছেয়েছিল, শেয়ালের ডাক মাঝে মাঝে নিস্তব্ধতা ভেঙে দিচ্ছিল, শান্ত নিবিড় হাওয়া বটের ঝুরি ছুঁয়ে কি যেন অশুভ সংকেত দিচ্ছিল বট গাছ নিজেই বুঝতে পারেনি, দেখল মেয়েটির শ্বশুর-শাশুড়ি নীলুকে টানতে টানতে নিয়ে এল দীঘির ঘাটে, মেয়েটি অনেকটা আছন্ন অবস্থায়, ওরা নীলুরর গলায় একটা বড় কলসি দড়ি দিয়ে বেঁধে পুকুরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল, তারপর পালিয়ে গেল। নিকষ আঁধারেও বট গাছ দেখেছিল নীলুর যন্ত্রণা কাতর মুখ ধীরে ধীরে গভীর দীঘির জলের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। বড় অসহায় লেগেছে নিজেকে, ইচ্ছে করছিল দুহাত বাড়িয়ে মেয়েটিকে তুলে আনে, কিন্তু সজীব হয়েও নির্জীবের মতো দেখা ছাড়াব আর কিছু করার ছিল না… । সকালে যখন পুলিশ আত্মহত্যার সন্দেহে জল থেকে নীলুর নিথর দেহ তুলেছিল বটের ঝুরি শেষ বারের মত মেয়েটিকে ছুঁয়ে ক্ষমা চেয়েছিল সাক্ষী হয়েও সাক্ষ্য দিতে না পারার জন্য।
চিতা নিভেছে।লোকগুলো জল ঢেলে চলে গেছে। কিছু ছাই হাওয়ার টানে উড়ে যাচ্ছে। আর কিছু মাটিতেই। বট গাছের কাছে গোল গোল পাক খেয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে নীলুর মতো…।
কমেন্টস
আমার প্রফেশন লেখালেখি।
আমি ছোট গল্প লিখি, বড় গল্প লিখি।
গল্পকুটির এর এই আয়োজন আমার খুব ভালো লেগেছে।
আমি আমার গল্প গুলো কে গল্প কুটির এর মাধ্যমে অগণিত পাঠকের কাছে পৌঁছাতে চাই।