|
দিনটা ক্রমশ শেষ হয়ে আসছিল। পাড়া থমথমে। সামনের নারকেল গাছে দুটো কাক সেই দুপুর থেকে চিৎকার জুড়েছে। এখনও তাদের থামার লক্ষণ নেই। কাদের ঘরে খবর চলছে তার আওয়াজ এখান পর্যন্ত আসছে। ইন্দ্রনাথ শোয়ার ঘরের জানলায় এসে দাঁড়ালেন। একটু একটু হাওয়া দিচ্ছে এখন। একটা গুমোট দিনের উপর যেন কোমলতার প্রলেপ মাখিয়ে দিচ্ছেন বিধাতা। কাছে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য ফ্ল্যাট বাড়ি। ভাটিচালার মাঠে যেখানে বিকেল হলেই ছেলেরা ফুটবল নিয়ে দাপাত, সেটা এখন ফাঁকা। একটু আগে ওপাশের রাস্তা দিয়ে টহল দিয়ে গেছে একটা পুলিশ গাড়ি।
লকডাউন। জীবদ্দশায় এই প্রথমবার এমন কিছুর সাক্ষী ইন্দ্রনাথ। এমারজেন্সি, ৭১-এর যুদ্ধের কথা মনে আছে তার। চেষ্টা করলে হয়তো স্বাধীনতা পরবর্তী দিনগুলোও কিছুটা মনে পড়তে পারে। কিন্তু সেসবের সঙ্গে এর মিল নেই বললেই চলে। এ যেন এক অন্য সাজা! পোস্ট আপিস অব্দি সান্ধ্য ভ্রমণটা বন্ধ হল। খগেন, বকুলদের দেখা পাননি মাস পেরোতে যায়। ইন্দ্রনাথ টিভি দেখেন না। চোখের জন্য বই পড়া কবেই শিকেয় উঠেছে।
জীবনে এখন বিনোদন বলতে রয়েছে কেবল ছাদের পায়চারিটুকু। বাকি সময়টা ভুতের মতো এঘর সেঘর করে কাটে। রুটিনমাফিক মেয়ের ফোন পান প্রতি রাতে। সুগারের ওষুধ খাওয়া হয়েছে কী না, প্রেশারের ওষুধ আর ক’পাতা আছে, খোঁজ নেয় সে। সব ঠিক থাকলে হপ্তায় একবার তার সাক্ষাৎ পান ইন্দ্রনাথ। ঠাকুরপুকুরের শ্বশুরবাড়ি থেকে বেগবাগানে স্কুটি চালিয়ে চলে আসে মেয়েটা। গত হপ্তা তিনেক তারও দেখা মেলেনি!
সময় খুব দ্রুত বদলায়। ইন্দ্রনাথ টের পাচ্ছেন যত দিন যাচ্ছে, তার বেঁচে থাকাটা যন্ত্রণার হয়ে উঠছে। মনটা আগের মতো নেই। সব সময়ে অদ্ভুত এক খারাপ লাগা লেপটে থাকে শরীরে।
পায়ে পায়ে বৈঠকখানায় আসেন ইন্দ্রনাথ। শেষ বিকেলের আবছা আলোয় একটা নাইলন দড়ি সিলিং ফ্যান-এর হুক থেকে ঝুলছে। ওটায় ফ্যান কোনোকালেই ছিল না। হুক রয়ে গেছে। কতবার ভেবেছেন এবার লাগিয়ে নেবেন, কিন্তু তার প্রয়োজন পড়েনি। তোলা কাজের লোকটি না আসায় ধুলোর পলেস্তারা জমেছে মেঝেতে। ঘরের কোণা ইতি উতি ঝুলে ভর্তি। জানলার পাশে একটা সোফা, যার গদি ছিঁড়ে বেড়িয়ে পড়েছে স্পঞ্জ। দেওয়ালে শেফালী ছবির থেকে হাসে। মুখখানা দেখে আরাম লাগে ইন্দ্রনাথের। শেষ বয়সের কুঁচকে যাওয়া চামড়া, সাদা চুল, ক্যানসারে ধুঁকতে থাকা জীর্ণতার সঙ্গে ও ছবির মিল নেই কোনও।
ফ্যান না থাকায় হুক থেকে সহজেই দড়িটা ঝোলানো গিয়েছে। অবিশ্যি ফ্যান থাকলেও আটকাত না। ওই দড়িতে এক সময়ে শেফালী কাপড় শুকাতো। একটা আটষট্টি কেজি মানুষের শরীর ধরে রাখার মতো ক্ষমতা ওর আছে বলেই ইন্দ্রনাথের বিশ্বাস।
শিক্ষকজীবনে ছাত্রদের মার্ক্স, টলস্টয়, সুভাষ বোসের কথা শোনাতেন ইন্দ্রনাথ। বলতেন, ‘‘প্রত্যেকের বেঁচে থাকার একটা উদ্দেশ্য থাকা উচিৎ। পারপাস অফ লাইফ। পেটের দায়ে চিরকাল থাকবে আর তার জন্য কিছু না কিছু সবাইকে করে যেতে হবে। কিন্তু সেটাই সব নয়। সেটা ছাড়াও একটা কিছু থাকা চাই, যার জন্য বেঁচে থাকা!’’
ছেলেরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথাগুলো শুনত। ওদের চোখ দেখে তৃপ্তি পেতেন ইন্দ্রনাথ। কিন্তু ইদানীং আর সেই বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যটাই খুঁজে পান না তিনি। মাস্টারি জীবন শেষ হয়েছে প্রায় একদশকের উপর। তার পরেও যে দু’একজন ঘরে পড়তে আসত, শেফালী চলে যাওয়ার পরে তাদেরও বারণ করেছেন। মেয়ে কতদিন বলেছে ছাদের টবগুলোয় গাছ লাগাতে, সময় কাটে। উৎসাহ পাননি ইন্দ্রনাথ।
সব মিলিয়েই তাই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন গতকাল। শেফালী নেই, মেয়ের গোছানো সংসার, তিনি ঝাড়া-হাত পা। বেশ কিছুদিন ধরেই মনে হচ্ছিল ধরাধামে তার উদ্দেশ্য ফুরিয়েছে।
কিন্তু মরব বললেই কি মরা যায় ? অতই সহজ ? তাহলে খেলা কখন চুকে যেত সেই দুপুরেই! ইন্দ্রনাথ কেনই বা চেয়ারে উঠবেন, দড়ির ফাঁসে মাথা গলিয়ে কেনই বা সময় নষ্ট করবেন। চেয়ার থেকে পা সরলেই তো যত হ্যাপা, যত বিরক্তির অবসান হয়। কিন্তু দড়ি গলায় পড়ার পর জগবন্ধুর কথাগুলো যে কেন কানে বাজতে লাগল, ইন্দ্রনাথ জানেন না!
‘‘শোনো ইন্দ্র, মানুষ যেহেতু নিজেই নিজেকে জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না, সেহেতু নিজেকে হত্যা করার অধিকারও তার নেই। আত্মহত্যা করাটা মানুষের ইচ্ছার অপব্যবহার এবং অহংকার প্রণোদিত কর্ম যার উভয়ই চরম পাপ হিসেবে পরিগণিত হয়, বুঝলা ?’’
জগবন্ধু ছিলেন ইন্দ্রনাথের সহকর্মী। প্রায় আঠেরো বছর দু’জন একসঙ্গে একই স্কুলে মাস্টারি করেছেন। স্কুলের এক কেরানি কোনো এক কারণে একবার আত্মহত্যা করে, স্কুল দু’দিন বন্ধ ছিল। সে সময়ে ইন্দ্রনাথকে কথাটা বলেছিল জগবন্ধু। আজ দড়িতে মাথা গলিয়ে সেইটে মনে পড়ল ইন্দ্রনাথের। ইন্দ্রনাথ জানেন না ওই কেরানির বাঁচার উদ্দেশ্য শেষ হয়েছিল কী না! উদ্দেশ্যহীনভাবে বাঁচার চেয়ে আত্মহত্যা কি ভালো নয় ? এই প্রশ্নটা সেদিন জগবন্ধুকে করা হয়নি। এখন মনে হচ্ছে করা গেলে বেশ ভালো হত। কিন্তু করার আর উপায় নেই। জগবন্ধু পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছে বছর তিনেক হচ্ছে।
তবে সাত-পাঁচ না ভেবে ঝুলে পড়াই এখন ঠিক মনে হল ইন্দ্রনাথের। মেয়েটা একটু কষ্ট পেলেও পেতে পারে, কিন্তু আজকাল বাপের প্রতি তার টান যে তেমন নেই, ইন্দ্রনাথ বেশ টের পান। দিনে একবার ফোন না করলে খারাপ দেখায়, তাই করে। ইদ্রনাথ পুরো দড়িটা গলা অব্দি গলিয়ে নেন। সামনের দেওয়ার ঘড়িতে চোখ পড়ে, ২ টো বেজে ১২ হচ্ছে। আর একটু পরেই বাড়িটা ভুতের বাড়ি হয়ে যাবে। দুটো কাক সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে বাইরে। দেওয়াল থেকে শেফালী সোজাসুজি তার দিকেই তাকিয়ে।
টিংটং!
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ! ইন্দ্রনাথ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন! এ সময়ে আবার কে! তড়িঘড়ি চেয়ার ছেড়ে নামেন। দরজা খুলে অবশ্য অবাক হন না তিনি। বিষ্টু দাঁড়িয়ে। হাতে টিফিন কেরিয়ার। একটু আগেই আসে রোজ, আজ দেরি করল। ইন্দ্রনাথ ভুলেই গেছিলেন। সেলুনের পাশের গমকলে কাজ করে বিষ্টু। থাকে ওর পিছনেই। পুরুলিয়ায় বাড়ি। যেদিন থেকে তার তোলা কাজের লোকটি আসে না, বিষ্টুই ভরসা। দু’বেলা ভাতে ভাত যা ফোটায় নিজের জন্য, ইন্দ্রনাথকেও দিয়ে যায়। বাজারের টাকা দেন ইন্দ্রনাথ। রান্নার টাকা ও নেয় না।
বিষ্টু যখন এপাড়ায় প্রথম এল, তখনও বছর পাঁচেক চাকরি বাকি ইন্দ্রনাথের। সেলুনে একদিন কাগজ পড়ার সময়ে খবর পেয়েছিলেন ভয়ানক জ্বরে পড়েছে ছেলেটা। গমকলের মালিক তখন বাইরে কোথায় যেন! ইন্দ্রনাথ তড়িঘড়ি ডাক্তার বদ্দির ব্যবস্থা করেন। সেরে উঠেছিল ও। সেই থেকে ভারী ন্যাওটা ইন্দ্রনাথের।
‘‘ জেঠু, আজ পোনার ঝোল পাতলা করে করেছি…’’ কেরিয়ারটা এগিয়ে দেয় বিষ্টু। ইন্দ্রনাথ মলিন হাসেন। তার পর কেরিয়ারটা নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েন।
সেই কেরিয়ার বিকেল অব্দি তেমনি পড়ে আছে রান্নাঘরে। খোলেননি। সারাদিন খিদে তেষ্টা কিছুই অনুভূতি হচ্ছে না ইন্দ্রনাথের। দড়িটা এখনও তেমনই ঝুলছে। বিষ্টু চলে যাওয়ার পরে আর একবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হচ্ছে না। মরাটা বড্ড কঠিন কাজ। ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে বিকেল। অন্যদিন হলে ঘরের আলোগুলো জ্বালিয়ে দেন এই সময়ে। আজ মন চাইছে না। সেই দুপুর থেকেই একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা ছেয়ে রয়েছে। একটা সাদামাটা জীবন কাটিয়েছেন তিনি। মৃত্যুর পর মর্গে তার লাশ কাটা ছেঁড়া হচ্ছে, দৃশ্যটা যেন ইন্দ্রনাথের চোখের সামনে ভেসে উঠল।
শরীরের সমস্ত শক্তি জড় করে আর একবার চেয়ারে উঠলেন তিনি। দড়ির ফাঁসটা এখন প্রায় তার মাথার সমান সমান।
বড় রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি মাইক ফুঁকতে ফুঁকতে চলে গেল। ইন্দ্রনাথ ফাঁসটা মাথায় গলালেন। কাকের চিৎকার থেমে গেছে। চারপাশে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। ঘড়িতে পাঁচটা বেজে আটত্রিশ। এই বোধহয় সবচেয়ে ভালো সময়। চল্লিশে কাঁটাটা যাওয়ার আগেই চেয়ার থেকে পা-টা শুন্যে ভাসিয়ে দেবেন ইন্দ্রনাথ। জীবনের যাবতীয় অভিমান, ক্ষোভ, নিঃসঙ্গতা, বিরক্তির অন্তিম অধ্যায়টা লিখে ফেলবেন এইভাবে।
একটা পা চেয়ার থেকে সামনে বাড়িয়ে দেন ইন্দ্রনাথ। পুরো শরীরের ওজনটা এখন অন্য পায়ের উপর। সেটা কাঁপছে। কতক্ষণ গেল ? পাঁচ সেকেন্ড… দশ সেকেন্ড …
আচমকা দরজায় প্রবল ধাক্কা! দম দম করে কেউ ঠুকছে কাঠের পাল্লাটা। ঠুকেই চলেছে। থামার কোনো লক্ষণ নেই।
————-
ইন্দ্রনাথ দরজা খুলে দেখলেন, প্রতিবেশী খগেন মিত্তিরের আট বছরের নাতিটা দাঁড়িয়ে। ওর নাম জানেন না তিনি। তবে মাঝেমধ্যে দেখেছেন বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করে।
‘‘উফফ, তোমার দরজা খুলতে এত সময় লাগে কেন ?’’ ছোকরার চোখে মুখে কৌতূহল! ইন্দ্রনাথ চেয়ে থাকেন তার দিকে।
‘‘এটাকে রাখতে হবে। আমি নিয়ে গেলে মা মারবে …’’ অর্ডার দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল ছোকরা। তার পর দুটো হাত সে এগিয়ে দেয় ইন্দ্রনাথের দিকে।
ইন্দ্রনাথ দেখলেন, ছেলেটার দু’হাতের মুঠোয় ধরা একটা কুকুরছানা। সাধারণ রাস্তার কুকুর, বাদামি বর্ণ, সাদা ডোরাকাটা কয়েকটা ছোপ দেওয়া গায়ে । ‘আ-আমি কোথায় রাখব ?’ আচমকা এমন প্রস্তাবে হোঁচট খান তিনি।
‘‘কেন তোমার এত বড় বাড়িতে জায়গা নেই ?’’ ছোকরার গলায় অবিশ্বাস ।।
‘‘না মানে …’’
‘‘তোমার বাড়ির সামনে দুপুর থেকে পড়ে আছে, দেখোনি ? হাঁটতে পারে না, কাগে ঠুকরোচ্ছে…। আমিই তো উদ্ধার করলাম।’’ ইন্দ্রনাথের মনে হল ছেলেটা এই বয়সে বড্ড বড়দের মতো কথা বলে। দুপুর থেকে কাকগুলো সমানে চিৎকার করছিল। এতক্ষণে কারণ বুঝতে পারেন তিনি।
‘‘ কী হল, নাও ধরো…’’, তাড়া লাগায় সে; ‘‘তোমার কাছে রাখো এখন, আমি ম্যানেজ করে নিয়ে যাব পরে …’’। একরকম জোর করেই ইন্দ্রনাথের হাতে কুকুরছানাটা ধরিয়ে দেয় ছোকরা।
‘‘ ইয়ে… কিন্তু …’’ বাকিটা আর বলে উঠতে পারেন না ইন্দ্রনাথ। ততক্ষণে সে বাড়ির পথে হাঁটা দিয়েছে।
বৈঠকখানার মেঝেতে কুকুরছানাটা নামাতেই ‘ভুক’ করে মুখ দিয়ে একটা শব্দ করল। বেশি নড়াচড়া করছে না। বোঝা যায় পা যখম হয়েছে। ইন্দ্রনাথের ঢোলা পাজামাটা দাঁত দিয়ে টানার চেষ্টা করে। ইন্দ্রনাথ তার মাথায় টোকা মারলেন। এ বাড়িতে কখনও কুকুর বেড়াল ছিল না। এরা কী খায় তিনি জানেন না। কিন্তু মনে হল কিছু খেতে দেওয়া দরকার। দুপুর থেকে হেঁশেলে বিষ্টুর দেওয়া খাবারটা রয়ে গেছে। ওইটে খানিক দিয়ে দেখা যেতে পারে। না খেলে রাতে অন্য ব্যবস্থা হবে। ইন্দ্রনাথ ঘরের লাইটগুলো জ্বালিয়ে দিলেন। হেঁশেলের দিকে যাওয়ার আগে তার নজর পড়ে সিলিং ফ্যানের হুকে। দড়িটা এখনও তেমনি ঝুলছে। ঝুলুক ওটা। আবার না হয় অন্য কোনো দিন।
কমেন্টস
ভালোই লাগলো লেখাটা।
অবেলায় পড়লাম। অনেক্ষন বসে ছিলাম তারপর। মানুষ যখন একাকী হয়ে যায় তখন তার যে মানসিক যন্ত্ৰণা তা একমাত্র সেই বোঝে। লোকে দীর্ঘ জীবন খোঁজে, এটা বাস্তব সত্যি। কিন্তু একা একা দীর্ঘ জীবন কাটানো যে কি ভয়ঙ্কর কষ্টের এ লেখার পরতে পরতে তা ফুটে উঠেছে।
ধন্যবাদ লেখিকা কে এমন একটা লেখা উপহার দেওয়ার জন্য।
Sorry লেখক লিখতে গিয়ে লেখিকা হয়ে গেছে।
অসাধারণ গল্পটা। কোথাও বাস্তব জীবনের সাথে মিলে গেল।