অপারেশনটা হবার কথা ছিল বারো তারিখেই। ঝুলিয়ে দিয়েছে ডাক্তার স্বয়ং। বিহু তাকিয়ে তাকিয়ে নার্সিংহোমের কেবিনের জানলার বড়ো কাচ দিয়ে শহরের রাস্তায় ভোর থেকে ছুটন্ত গাড়িগুলোকে দেখছিল, আর ভাবছিল গোটা শহরটা ছুটছে, শুধু তার জীবনটা পলকে থমকে গেছে। মেঘলা-মেঘলা করে আছে সকালটা। মাঝে মাঝে হালকা রোদ্দুর উঠছে না ওঠার মতো করে। কেমন যেন মন খারাপটা পেয়ে বসেছে আরও বেশি করে। এক একদিন এমনই হয় বিহুর। ইদানীং জরায়ুর ক্যান্সারের সঙ্গে সঙ্গেও এই রোগটাও দানা বেঁধে আছে মন নামক অঙ্গে। কপালের ফেরটা এমন, সবাই যখন লাল গোলাপ, লাল টেডি আর ডার্ক চকোলেট দিয়ে তার ভালবাসার মানুষ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, তখন অপারেশন থিয়েটারে বিহুর রক্তাক্ত শরীর লাল রঙের গোলাপের মতোই রক্ত বর্ণ হয়ে জানান দেবে ভালবাসার ফসল বপন ও বহন করার অঙ্গটি বাদ যাবে চিরকালের মতো।
“আপনি রেডি তো?” সাদা পোশাক পরিহিত নার্স জিজ্ঞেস করে।
“হ্যাঁ” বিহু উত্তর দেয়, “বাবা-মা আসেনি?”
“এসেছেন। ওঁরা ওয়েটিং রুমে আছেন। প্রয়োজন মতো ওটির সামনে চলে আসবেন।”
“আচ্ছা।”
“আপনি কি উঠতে পারবেন একা?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। নো প্রবলেম।” বিহু জোর গলায় উত্তর দেয়।
এই একা ওঠা, উঠে দাঁড়ানো, গুটি গুটি পায়ে চলার অভ্যাসটা তো তাকে করতেই হবে।কারোর হাত ধরে জীবন নদী পার হবার সৌভাগ্য সবার জোটে না। তাই অনেক সময় হাজারও প্রতিবন্ধকতা অস্বীকার করতে হয় মনের জোরে। নিজেকে দাঁড় করাতে হয় তালগাছের মত সব বাধা পেরিয়ে। আকাশে উঁকি মারতে গেলে নিজেকে প্রসারিত করার দরকার হয়। সেখানে বিহু একাই চলার সংগ্রাম করবে এটাই মেনে নিতে হয়। তাই যেদিন প্রথম জানতে পেরেছিল তার ইউটেরাসটা কেটে বাদ দিতে হবে, কোনওদিন তার মাতৃগর্ভ সন্তান ধারণ করতে পারবে না নিজের মুখেই ভয়ংকর সত্যিটা ইন্দ্রকে জানানোর ক্ষমতা এনেছিল নিজের মনে।
সেদিনের সন্ধেটা অনেক কিছু শিখিয়েছিল বিহুকে। মা বাধা দিয়ে বলেছিল,”কী দরকার মামন,যখন অপারেশন হবে তখন জানাস।”
বিহু প্রতিবাদ জানিয়েছিল ,”কেন মা? জানতে পারবে তো একদিন, এটা তো লুকিয়ে রাখার জিনিস নয়, যে লুকিয়ে রাখব। দু’দিন পর জানলে কি সত্যিটা বদলে যাবে?”
দুর্বল ক্লান্ত শরীর কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না ইন্দ্রর সঙ্গে দেখা করার। মনের সঙ্গে আজকাল তাল মেলাতে পারে না শরীর। মাঝে মাঝেই চরম বিরুদ্ধতা জানায়। ওতোপ্রোতভাবে জড়িত দুটির মধ্যে একজন বিপরীতে চলতে শুরু করলে বিহু এঁটে উঠতে পারে না নিজের সঙ্গেই।
ইন্দ্র কিছুটা অবাক হয়েই প্রশ্ন ছুড়ল,”কী ব্যাপার রে, এত জরুরি তলব?”
“ইন্দ্র, তোকে কিছু বলার আছে আমার। মন দিয়ে শুনবি তো? আমাদের বিয়ের আর ছমাস বাকি। কথাগুলো তোর জানার দরকার।”
“বাবা রে! কী হলো রে তোর? দার্শনিকের মতো কথা বলছিস যে! তাড়াতাড়ি বলে ফেল।এমনিই আজ অফিস থেকে বেরোতে দেরি হয়ে গেছে।”
“হ্যাঁ বলছি সব। একটু সময় দে আমায়।” বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে লাল স্ট্রবেরি জুসে চুমুক দিতে দিতে বিহু কেটে কেটে সত্যিটা জানিয়েছিল ইন্দ্রকে, “ইন্দ্র আমি কখনও মা হতে পারব না।”
ইন্দ্র গলা ঝেড়ে কাশলো,”এনিথিং প্রবলেম বিহু? অফিসে তোর প্রবলেম হলে বল। আর বিয়ের পর পরই তো তুই মা হচ্ছিস না। আরে বছর দুই চুটিয়ে প্রেম করব। তোকে চাকরি ছাড়ার কথাও বলছি না। মা বাবা আছে।ওইসব বাচ্চা-কাচ্চা মানুষ নিয়ে চিন্তা করিস না তুই।”
বিহু আরও একবার চোখ বোলালো ইন্দ্রকে। কোনওদিন কি বুঝতে পারবে না ইন্দ্র? যার সাথে মনের আদান-প্রদান হয় তাকে এক ঝলক দেখে বোঝা যায় তার ভিতর ঘরের খবর। যেমন বিহু বুঝে নেয় ইন্দ্রকে দেখে। ইন্দ্র বোঝে না… কোনওদিন বোঝেনি।
“না রে তুই যা ভাবছিস তা নয়। আসলে …আসলে অসুবিধাটা অন্য জায়গায়।তোকে বলবো কী করে তাই ভাবছি!”
ইন্দ্র চোখ সরু করে তাকায়,”কী বলবি ঝেড়ে কাশ তো!”
“ইন্দ্র, আমার ইউটেরাসে দুটো টিউমার ধরা পড়েছে। দুটোই ম্যালিগন্যান্ট সাসপেক্ট করছে ডক্টর। সেক্ষেত্রে অপারেশন করে ইউটেরাসটা কেটে বাদ দিতে হবে। কন্ডিশন ডিটোরিয়েট করলে কেমোও চলতে পারে তার পর।”
ইন্দ্র ভূত দেখার মত হকচকিয়ে গেল,”মানে?”
“মানেটা এই যে প্রসিডিওরটা চলছিল বেশ কিছুদিন থেকেই। তোকে বলব বলব করে বলা হয়নি। কোথাও পজিটিভ ছিলাম আমি। কিন্তু বায়োপসি রিপোর্টটা দুদিন আগে এসে সেই ভুল ভেঙে দিয়েছে।”
ইন্দ্র উঠে এসে বিহুকে বুঝিয়েছিল নিজের মতো করে। নাহ বিহু কাঁদেনি। বিহু কাঁদতে পারে না। ভেতরে পাহাড়প্রমাণ যন্ত্রণা হলেও চোখদুটো শুকনোই থাকে। শুধু গলার কাছে অসম্ভব একটা ব্যথা অস্বস্তি জানায়। তার দুদিন পর ইন্দ্রর বাড়ি থেকে খবরটা পায় বিহু। ইন্দ্রর মা সাফ জানিয়ে দেয় বিয়েটা হচ্ছে না। একমাত্র ছেলেকে তারা এই হতাশার জীবনে ঠেলে দিতে রাজি নয়। ভবিতব্যটা যে একেবারেই আঁচ করেনি বিহু তা নয়। তবু ইন্দ্রর দিক থেকে কিছুটা সময় আশা করেছিল বিহু। সে আশাতেও জল ঢেলে ইন্দ্র আরও তিন-চার দিন পর বিহুকে জানায়,”ভুল বুঝিস না বিহু। বুঝতে পারছিস তো! বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে আমি। কী করে ওদের বিরুদ্ধে যাই! আমরা কিন্তু ভাল বন্ধু বিহু। যোগাযোগটা বন্ধ করিস না।”
বিহু যেন আশা করেছিল কিছুটা। তবুও অবচেতনে মনের ঘরে লুকিয়ে থাকা কেউ বুঝিয়েছিল ইন্দ্র থাকবে পাশে। প্রত্যাশা যখন ভেঙে যায়, গুঁড়িয়ে যায় মনের ভেতরের সমস্ত আশাগুলো, জমাট বাঁধে পাথরের মতো। কিছুতেই গলবে না, ভাঙবে না, শুধু বারবার বুকের ভেতর আঘাত করবে আর পরিহাস করবে ভুলটা তোমারই—নির্বাচনের ভুল তোমার, বিশ্বাস করার ভুল তোমার, ভরসা করার ভুল তোমার। অপরকে আঘাত করার জন্য পাথরটা হাত থেকে ছুড়ে দিয়ে লাভ নেই। নিজেই নিজেকে আঘাত করো বারবার। ভুলের খেসারতটা তোমারই প্রাপ্য ।
বিহু অনেকক্ষণ ফোনের ওপারে থাকা মানুষটিকে দেখার চেষ্টা করছিল আর বিদ্রুপ করে বলতে ইচ্ছে করছিল ভাগ্যিস আমার এই অঙ্গটা কেটে বাদ দিতে হল ইন্দ্র! নয়তো অনেক অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ জীবনে জুড়ে বাধা হয়ে দাঁড়াত। মুখে শুধু বলল,”বন্ধুত্বটা গড়ে উঠবে না আর নতুন করে। বন্ধুত্ব আসলে স্বচ্ছ জলের মতো। সেই স্বচ্ছতা ঘোলাটে হয়ে গেলে সেটা আবর্জনার মতো মনে হবে!”
“বিহু প্লিজ বন্ধুত্বটা অস্বীকার করিস না!”
কান্নাটা হাসিতে বদলে গেল বিহুর, “দুজনের মাঝের সম্পর্কটা স্বীকার করতে পারিসনি যখন, তখন সেটাকে বদলে দেওয়ার মতো ভুল করিস না। তোর হয়তো অসুবিধা হবে না খুব একটা। আমার হবে জানিস। প্রেমটা হয়ে গেছিল তো! ভালবাসা তো মরে যায় না। বন্ধু হয়ে ওঠার মধ্যে যখন অভিনয় করতে হয়, সেটা আমার ভেতর থেকে আসবে না। তোরও এখন আমাকে বন্ধু ভাবতে গিয়ে করুণা আসবে বারবার , সেটা আমি মেনে নিতে পারব না রে। পাশাপাশি থাকাটা যখন হয়ে উঠল না তখন দূরত্বই থাক। ভাল থাকিস।”
জোর করে বিহুই ফোনটা কেটে দেয়। নিমেষের মধ্যে বছর তিনেকের রঙিন প্রজাপতিগুলো কেমন কালো হয়ে গিয়েছিল ! ডানা ঝাপটাতে না পেরে একটা আবছা অন্ধকার ঘরে প্রজাপতিগুলো সব ঢুকে পড়েছিল। বেরোতে পারছিল না কিছুতেই। একাকি ফিঙে শুধু ল্যাম্পপোস্টের কালো তারে বসে দোল খাচ্ছিল নিজের মতো। সূর্য তখন ডুবে আসছে।
“টেনশন করবেন না একদম!” বিহু বাইরের জানলা থেকে মুখ তুলে তাকায়। সামনে মোটা রিমলেস ফ্রেমের চশমা পরে সুঠাম ফর্সা চেহারার একজন এসে বি পি মেশিনটা নিয়ে বিহুর হার্টবিট চেক করে। পাশে সিস্টারের উদ্দেশ্যে বলে,”বিপি নরমাল।”
বিহুর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,”ভয় লাগছে?”
“না তো!”
“ব্রেভ গার্ল। একটু রিল্যাক্স করুন। একটু পরে ডঃ রায় আসবেন। নিয়ে যাওয়া হবে ওটিতে। ভয় পাবেন না কিন্তু। বিপি হাই হলে ওটিতে প্রবলেম হয়।”
বিহু কোন উত্তর দেয় না। শুধু সামনের পুরুষটির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তারদের বুঝি এমন আত্মবিশ্বাস থাকে! বিহুর আজকাল আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
“কি নাম আপনার?”
“বিহু। বিহু চ্যাটার্জী”।
“ওকে। ওটিতে দেখা হচ্ছে।”
ওটিতে নিয়ে যাবার সময় বাবা-মা বিহুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। বিহু তাকায় সিলিংয়ে জ্বলতে থাকা এলইডি লাইটের দিকে । ও কী মরে যেতে চাইছে! বাঁচার রসদ ফুরিয়ে গেলে কি মরতে ইচ্ছে করে প্রতিনিয়ত? বাবার মুখটা বড্ড অসহায় লাগছে। বিহু ইচ্ছে করে তাকাচ্ছিল না। মাকে দেখে বিহুর মনে হয় সংগ্রামটা ওর মায়ের অনেক বেশি। তীব্র আলোর দিকে তাকিয়ে ভাবে মৃত্যুর আগে কি এমন আলো দেখা যায়? তবে যে বলে সমস্ত ভাল স্মৃতি চোখের সামনে ভিড় করে জীবনের শেষ অধ্যায়ে! বিহুর কেন ইন্দ্রর সাথে কাটানো একটি মুহূর্তও মনে পড়ছে না! উল্টে মনে পড়ে যাচ্ছিল ইন্দ্র কীভাবে তাকে বাতিল করল। তাহলে কি বিহু মরবে না? বাঁচতে ইচ্ছে করে না আর। এরপর দীর্ঘ লড়াই আক্রান্ত রোগের সঙ্গে। বাবা-মাকে এভাবে শাস্তি দেওয়ার চেয়ে একেবারে চলে যাওয়া মনে হয় শ্রেয়। চোখদুটো জ্বালা করছে খুব । তবু কান্নাটা আসে না। বিহু কিন্তু কাঁদতে চায়। ভালবেসে কাঁদতে চায়। ভেতরের পাথরটা গলিয়ে দিয়ে নরম তরল করতে চায় বিহু।
অপারেশন টেবিলে বিহুর ভীষণ ভীষণ ঠান্ডা লাগল। জুনিয়র ডাক্তারটি তাকে অন্যমনস্ক রাখার চেষ্টা করে,”নামটা কী বললেন আপনার?”
“বিহু”
“সুন্দর নাম তো! যে কোনও অসুবিধা হলে জানাবেন।”
বিহু বাধ্য বালিকার মত মাথা নাড়ে।
“কী করেন আপনি?”
“আমি জব করি আইটিতে। আপনার নাম কী?”
“আমি আরণ্যক বসু।”
“আপনার নামটাও তো সুন্দর!”
আরণ্যক হাসে।
অপারেশন হয়ে যায়। বিহুর ক্লান্ত শরীর যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যায়। ডঃ রায় আরও দিন চার পাঁচ রাখার কথা বলেন। বাবা-মা প্রতিদিন আসে। ইন্দ্র আসেনি। বিহু ভেবেছিল, আশা করেছিল ইন্দ্র আসবে, কিন্তু আসেনি। বিহু জানে ইন্দ্র ইচ্ছে করেই আসেনি। দোষ করলে মুখোমুখি হবার সাহস সবার থাকে না। শরীরটা নিয়ে কাটাছেঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনটা খান খান হয়ে যায় বিশ্বাসঘাতকতায়।
“ব্যথা কমেছে একটু ?”আরণ্যক শুধায়।
“অল্প।”
“খাওয়া-দাওয়া করুন ঠিক করে। ঘুম হচ্ছে রাতে?”
“হুম”
“আপনার বাবা-মা ভীষণ টেনশন করছিলেন গতকাল।”
“হ্যাঁ, তা তো হবারই কথা।”
“আপনার হয়নি?”
“না।”
আরণ্যক অবাক হয়ে তাকায় বিহুর দিকে। কেন এত বিতৃষ্ণা নিজের জীবনের প্রতি মেয়েটির, “কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জানেন, পেশেন্ট এমন হয়ে থাকে অপারেশনটা ক্রিটিকাল হয়ে যায় ,আপনাকে দেখছি একমাত্র, যিনি ক্যান্সার পেশেন্ট হয়েও ভয় পাননি।”
“মনে যখন রোগ বাসা বাঁধে শরীরের রোগ তুচ্ছ মনে হয় জানেন?”
“কি বললেন?” চমকে উঠলেন ডক্টর আরণ্যক। যেখানে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সবাই প্রতিযোগী সেখানে কেন মেয়েটি নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে ভাগ্যের হাতে সেটাই বোঝার চেষ্টা করে। ওটিতেও নজর করেছে আরণ্যক।
বিহুর সম্বিত ফেরে,”না। বলছি আপনাকে ঠিক ডাক্তার বলে মনে হয় না, সবার সাথে কথা বলেন, একদম আলাদা।”
“ডাক্তারেরা ভাল নয় বলছেন?”
“তা কখন বললাম? সবাই আপনার মতো হয় না সেটাই বক্তব্য।”
আরণ্যক হাসে। হাসলে ভারী সুন্দর দেখায়। আরণ্যক ভাবে এই মেয়েটির মধ্যে একটা স্পার্ক আছে। যেটা সবার থাকে না। চোখ দুটো অসম্ভব উজ্জ্বল দৃঢ়। বড্ড কাছে টানে চোখ দুটো। মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। মায়ের যখন ইউটেরাস অপারেশন হল তখন ও মেডিকেলে পড়ছে। কী ভীষণ যন্ত্রণা পেত সারা দিন! চিৎকার করত এক এক দিন। চোখদুটোর সাথে মায়ের চোখের অনেক মিল আছে। এই কেবিনে এলে আরণ্যক একটু বেশি উদ্ধত হয়ে যায় তাই।
পরপর দিন চারেকের জায়গায় সাত দিন কেটে যায় হাসপাতালে। প্রতিদিন আসে আরন্যক। টুকটাক কথা হয়। বিহু ঘুমিয়ে থাকে বেশিরভাগ সময়। তবুও আরণ্যক আসে। ঘুমন্ত বিহুকে দেখে বড্ড মায়া হয়।
“তাহলে নেক্সট চেকআপে আসবেন ঠিক দশ দিন পর।”
বিহু সিডিউলগুলো বোঝার চেষ্টা করছিল বাবার সাথে। আরণ্যক এগিয়ে এসে ফোন নম্বরের কার্ডটা ধরিয়ে দেয়। গাড়িতে ওঠার সময় ফিরে তাকায় বিহু আরণ্যকের দিকে,”অসুবিধা হলে ফোন করব।”
“অসুবিধা না হলেও ফোন করতে পারেন। ”
বিহু অবাক হয় অল্প,”কেন?”
“ফোন করবেন।”
বাড়ি ফিরে বিহু দিন কাটায় শুয়ে শুয়ে। ভাবে ও কি মরে যাচ্ছে? ডাক্তার বলেছে টিউমার কেমন তার উপর নির্ভর করছে কেমো চলবে কিনা। যদি কেমো চলে তার সমস্ত চুল উঠে যাবে। কেমন দেখতে লাগবে তাকে! বিহু আবার হাসে। যাকে দেখানোর জন্য নিজেকে সাজানো সেই তাগিদটা নেই, আর মানুষটাই তো নেই জীবনে। এই বেশ ভাল। ইন্দ্র থাকলে বরং নিজের বিকৃত রূপ নিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে যুদ্ধ করতে হত আবার। যুদ্ধের সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে তার জীবনে। জয় করতে গিয়ে পরাজিত হবার আশঙ্কা জাগে মনে। আবার জয়ী হবার লক্ষ্য ঠিক নেই। বিহু ভাবে যদি মরে যায় ইন্দ্রর কি কষ্ট হবে? ওর বাবা-মার কী হবে? যদি বেঁচে থাকে ইন্দ্রকে ছেড়ে বাঁচবে কী করে! সব ভাবনাগুলো জট পাকায়। ফোনটা আসে তখনই।
“হ্যালো?”
“বিহু বলছেন?”
“হ্যাঁ। আপনি?”
“আরণ্যক বলছি ।”
“বলুন?”
“কেমন আছেন?”
“ঠিক আছি।”
“আপনাকে জানেন আমার মায়ের মতো দেখতে?” আচমকা প্রসঙ্গ বদলানোয় বিহু চমকে যায়,”তাই?”
“আর তার জন্য আমি আপনাকে লুকিয়ে দেখতাম যখন আপনি ঘুমোতেন।”
“আমি কিন্তু কখনও টের পাইনি।”
আরও কিছু কথা বলে ফোনটা রেখে দেয় দুজন। কথাটা একদিন নয় চলে মাঝে মাঝেই। বিহুর মনে আরন্যক কখন বন্ধুত্বের জায়গা নিয়ে নেয় বিহু নিজেও টের পায় না।
বছর খানেক ট্রিটমেন্ট চলে। কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠে বিহু । আরণ্যকের সাথে দেখা হয় নার্সিংহোমে। বিহু চেক আপে আসে। আরণ্যক কখনও ভোলে না। ভুল করে না। কিছু না কিছু অজুহাতে দেখা করার চেষ্টা করে। আর বিহুও চেষ্টা করে জানাবার। সম্পর্কটার কোনও নাম তৈরি হয় না। দায়বদ্ধতাটা আপনা আপনি চলে আসে। প্লবতার মতো ভেসে চলে সম্পর্কটা। নিমজ্জিত নয় ,পুরো ভাসাও নয়,কিছুটা ডুবে গিয়ে ভেসে থাকে সম্পর্কটা।
আরেকটা চোদ্দ তারিখ চলে আসে। সারা শহরে লাল গোলাপে ছেয়ে যায়। আজ বিহুর শেষ ইনজেকশন। কেমোথেরাপি করার দরকার হয়নি শেষ পর্যন্ত । গত মাসে ঠিক আজকের দিনে চরম অপমান করেছিল বিহু তাকে। এই একমাস যাবৎ আরণ্যক শুধু নিজেকে প্রশ্ন করেছিল যে ও তো ইন্দ্র নাও হতে পারে। বিহু কেন একজনকে দিয়ে অপরজনকে বিচার করল! সবাই কি এক ছাঁচে ঢালা মানুষ হয়! যখন আরণ্যক জানিয়েছিল,”বিহু একবার ভেবে দেখো সারা জীবন আমরা একসাথে চলতে পারব কিনা, সময় হয়তো বেশি দিতে পারব না, তবু যেটুকু ফুরসত পাব সেটুকু তোমার আমার।”
ভীষণ খেপে গিয়েছিল বিহু,”দয়া করছো .. দয়া? তোমরা কি ভাব আমায়? মানুষ ভাব? নাকি পালিত পশু? এত বড় রোগ আছে জেনে এসব ন্যাকামি করতে আসো কীসের জন্য? ওসব ভালবাসা-টালবাসার সংজ্ঞা দুদিন আগেই বদলে গেছে। তোমরা সকলে সুযোগ-সন্ধানী স্বার্থপর! সব সময়ই লাইফে এন্ট্রি নেওয়ার চেষ্টা করো।”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলার পর বিহু হাঁপাচ্ছিল। বাথরুমে গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে সে। আরও অবাক হয়ে গিয়েছিল নিজেই। ভিতরের পাথরটা কাউকে ছুড়ে মারতে ইচ্ছে করছে না। শুধু গলে যাচ্ছে। গলে গলে বরফ গলা জল পড়ে গাল বেয়ে নেমে আসছে কোনও বাধা না মেনে। শীতল অশ্রু নয় আগাগোড়া উষ্ণতায় মোড়া। ও কী ভালবেসে ফেলেছে আরণ্যককে? এত বড় ভুল সে করবে না। কাউকে ব্যবহার করার জন্য তার সাথে জড়িয়ে পড়া এমন বড় দোষারোপ নিতে পারবে না। নিজের মনেই বলছিল তখন, “কেন ভগবান, কেন? এতো কান্না আজ আসছে কেন? ইন্দ্রের জন্য তো কখনও এমন কষ্ট হয়নি! তবে আজ কেন? আরন্যককে আমার জন্য এত ত্যাগ করতে দেব না আমি।”
চোখ মুছে শেষ অব্দি এটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিহু। নয়তো সে তো আরন্যককে বুঝতে পেরেছিল বহু আগেই। পুরুষের চোখের নির্দিষ্ট ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। এটাও বুঝতে পেরেছিল, সেও খড়কুটোর মতো ভালবাসার স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। আসলে এই একটা বছরে ইন্দ্রকে আরণ্যক মুছে দিয়েছে ইরেজার এর মত। তবু অতিরিক্ত জোর দিয়ে লিখলে যেমন কাগজে ছাপ থেকে যায়, তেমনি নামটা মুছে গেলেও দাগ রয়ে গেছে তলপেটে অপারেশনের কাটা দাগের মতো। এই দাগটা মুছবার নয়। এই দাগটা অভিজ্ঞতার, সারা জীবনে অনেক কিছু শেখার সাক্ষী। বিহুর এখন মনে হয় ইন্দ্র অনেকটা ক্যান্সারের মত তার জীবনে।
আজ অরণ্যক একবারও এল না। চোদ্দই ফেব্রুয়ারি। ভালবাসার দিন। ভালবাসাটা তার জীবনে ভবিতব্য হয়ে পোক্ত হয়নি কখনও। ইনজেকশন নেওয়া কমপ্লিট হলে বাবার সাথে গাড়িতে ওঠার জন্য নার্সিংহোম এর বাইরে এসে দাঁড়ায়। বাবা ওলা বুক করার জন্য এগিয়ে যায় ফোনটা নিয়ে। ক্যাফের একটি ছেলে এক গোছা লাল গোলাপ নিয়ে বিহুকে দেয় আর বলে ডক্টর বাসু পাঠালেন। বিহু নিল ফুলের তোড়া। তোড়ার গায়ে একটি চিঠি আটকানো।
“বিহু আমার হাতের লেখা খুব খারাপ, কষ্ট করে পড়তে হবে জানি। অনেক কষ্টের সংগ্রামে এই লড়াইটা তুচ্ছ, এবং তুমি তা পারবে। তুমি আমায় ভালবাস ইন্দ্রের চেয়ে অনেক বেশি। আমার কথাটাও তোমার জানা। দয়া করার সাহস নেই আমার। সাংঘাতিক জীবন যুদ্ধে জয়ী মেয়েটির চোখ দুটো আমায় পরাজিত করেছে। নিজেকে কখনও এতটা তুচ্ছ মনে করো না। কখনও ভেবো না এতে আমার ক্ষতি হয়ে যাবে। ভালবাসায় লাভ-ক্ষতির বিচার হয়, বিহু? ভালবাসায় ক্ষতি হলেও সঠিক অংক কষে লাভের ঘরে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের দুজনেরই।
মা হতে তুমি পারবে বিহু। শুধু মা না হওয়া আর বাবা হতে না পারা একসাথে না চলার কোনও অজুহাত হতে পারে না। কত সন্তান মায়ের কোল খোঁজে। একটা কোল না হয় তুমি দিও। তোমার ভেতরের শক্তি সেটাও পারবে জানি। আমায় শুধু তোমাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার সুযোগ দিও।
আর হ্যাঁ, গোলাপের গন্ধে তোমার এলার্জি আছে জানি । পিছনে অ্যান্টি অ্যালার্জির নাম লেখা আছে। একদিন না হয় এই উপদ্রবটুকু সহ্য কোরো! ওষুধটা খেতে ভুলো না কিন্তু!
চলো না বিহু আমরা একসাথে পথ হাঁটি। ভালবাসার ওম দিয়ে সম্পর্কটা বাঁচিয়ে রাখি।”
আরণ্যক ঝুলন্ত ব্যালকনির করিডরে নিজেকে লুকিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে আর ভাবে এখনই হয়তো চিঠিটা ছিঁড়ে কুচি-কুচি করে ফেলে দেবে বিহু।
বিহু চিরকুটটা যত্নে ভাঁজ করে । চোখ থেকে গরম নোনা জল বেয়ে নেমে আসে দুই হাতের মুঠোয় ধরা গোলাপের পাপড়িতে। লাল গোলাপের তোড়াটাকে আঁকড়ে ধরে বুকের কাছে বিহু। বিন্দু বিন্দু অশ্রু জমে থাকে পাপড়ির গায়ে।
কমেন্টস
Just daaaruuun ❤❤❤
কিছু বলার ভাষা খুজে পাচ্ছি না। খুব সুন্দর একটি লেখা।।