পর্ব – ২

প্রাত্যহিক দুঃখ-সুখের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধতে পারে না। মারিয়া তবুও সাবধান হয় না। এক অসম বন্ধুত্ব যে হয়ে গেছে ফুলওয়ালার সঙ্গে। মারিয়ার যে বড় মায়া পরে গেছে তার ওপরে মাত্র এই ক’দিনেই। তার জন্যই সে এগনেসের কাছে সদ্য ফোটা ফুলের স্নিগ্ধতা রেখে আসতে পারে। মৃত্যুর পরেই যে আরেক জীবনের উষ্ণতা। ফুলের সুবাসে ভরিয়ে দিতে চায় মারিয়া সে জীবন। 

লুনা রোজ মারিয়ার সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়ে ভীষণ চিৎকার করছে। ১৬ বছরের এই জীবনে লুনাকে এমন অস্থির হতে দেখেনি মারিয়া। ড্রাইভওয়েতে ঢুকলেই গ্যারাজের দিকে ইশারা করে কী যেন দেখাতে চায় মারিয়াকে লুনা। লুনাকে যে আটকাবে, মারিয়ার শক্তিতে কুলিয়ে ওঠে না আর।  হাত থেকে বাঁধন আলগা হয়ে যায়। মারিয়া এবং গিলবার্ট দু’জনেই বোঝে সে কিছু একটা খুঁজছে; কিন্তু এই অশীতিপর বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা সে রহস্য উন্মোচন করতে পারে না। 

পুলিশ এসেছে গ্রামে। জর্জের দোকানের সামনে দুটো পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে। গিলবার্ট প্রতিদিনের মতো আজও সকালে এসেছে জর্জের দোকানে, কিন্তু জর্জ আজ দোকান খোলেনি। গিলবার্টকে দেখা মাত্র পুলিশের দুই আধিকারিক সামনে এগিয়ে এসে হাত বাড়ায়। হাতে হাত মিলিয়ে গিলবার্ট উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে তাদেরআগমনের কারণ। জর্জ ঠিক আছে কিনা সেটা জানাই আসল উদ্দেশ্য। পুলিশ জানায় জর্জ গাড়িতে তাকেও উঠতে হবে গাড়িতে। একটা হাতে আঁকা স্কেচ দেখায় পুলিশের আধিকারিক গিলবার্টকে।

কোঁকড়া চুল, খোঁচা দাড়ি। চোখে একটা ভারী ফ্রেমের চশমা। হ্যাঁ, এই তো ফুলওয়ালা। উত্তেজিত হয়ে শনাক্ত করে ফুলওয়ালাকে। পুলিশ গিলবার্টকে গাড়িতে উঠতে বলে, ফুলওয়ালা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়।  

মারিয়া প্রহর গোনে। পাহাড়ের কোলে অন্ধকার গাঢ় হয়। গিলবার্ট  তবুও বাড়ি ফেরে না। কনসারভেটরি থেকে মারিয়া দেখে দুটো গাড়ি পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠে আসছে। মারিয়া নিশ্চিত এ গাড়িতেই জর্জ আর গিলবার্ট ফিরবে। এ বয়েসে অপেক্ষা যে বড় বেদনাদায়ক। 
পুলিশ এসে জানায় গিলবার্ট এবং জর্জ বার্লিনে রাত্রি বাস করবে পুলিশি হেফাজতে।

কারণ?

কারণ তথ্য সংগ্রহ।

“কীসের তথ্য?” উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে মারিয়া।

পুলিশ জানায়, ফুলওয়ালা ফেরারি। তাকে যে করেই হোক খুঁজে বের করতেই হবে।  সুতরাং যার কাছে যা তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব তাই তারা করবে।

“কিন্তু জর্জ এবং গিলবার্টই কেন?” মারিয়া এবার ভেঙে পরে।

ততক্ষণে এরিক এসে পরেছে। মারিয়াকে শোয়ার ঘরে নিয়ে গিয়ে এরিক পুলিশকে বাইরে নিয়ে এসে প্রশ্ন করে। পুলিশ জানায়, গত সপ্তাহে পুলিশের কাছে একটা অজ্ঞাত ফোন যায়। চকের বাড়িগুলোর কোনও এক বাড়ির বাসিন্দা। সে জানায় একটি বাড়ির সামনে টাটকা রক্তের দাগ দেখা গেছে। সারা রাত সে বাড়িতে আলো জ্বলে। পুলিশ প্রথমটায় আমল দেয় না, কিন্তু আবার ফোন আসে অন্য আরেকটি বাড়ি থেকে। সারা রাস্তা জুড়ে রক্তের ছোপ। গাছের ঝোপে মানুষের হাড়। পুলিশ এসে চকের সবকটা বাড়ি খতিয়ে দেখার পরে একটা বাড়ির সামনে এসে রহস্যের উদ্ঘাটন করে। তালা ভেঙে ঢুকে পুলিশ খুঁজে পায় মৃতদেহ। হাড়, মাংস। বুঝতে বাকি থাকে না এ বাড়ির বাসিন্দা একজন নরখাদক। দশ বছর পর আবার আরেকজন। 

পুলিশ খুঁজতে শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যে বের করে ফেলে যে ফুলওয়ালাই ওই বাড়ির বাসিন্দা। অর্থাৎ ফুলওয়ালাই কি তাহলে নরখাদক? 

দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আজও লুনা বড্ডো চিৎকার করছে। সকাল বেলায় মারিয়া লুনাকে নিয়ে ড্রাইভওয়েতে বেরোতেই লুনা চিৎকার করতে শুরু করেছে। মারিয়া তাকে থামাতে পারছে না। গত রাত্রে পুলিশ মারিয়াকে কথা দিয়ে গেছে, আজ গিলবার্ট ফিরবেই,  কিন্তু সারা সকাল পেরিয়ে গেছে। 

আজ ভোর থেকে বৃষ্টি নেমেছে অবিশ্রান্ত ধারায়। বেলাশেষের এই নিস্তরঙ্গ জীবনে এমন চাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে কোনওদিন ভাবেনি মারিয়া। আজ যে জীবনে প্রথমবার চায়ের কাপ হাতে একলা বসে সে কনসারভেটরিতে। কেন এই দীর্ঘ প্রতীক্ষা? এই অনিশ্চয়তা। এর চেয়ে কি জীবনান্তের নিশ্চয়তা অনেক বেশি শান্তির নয়? 

সন্ধ্যে নামার আগে গিলবার্ট বাড়ি ফেরে। মারিয়া উদগ্রীব হয়ে থাকে সবটা শোনার জন্য। গিলবার্টের সঙ্গে পুলিশ আসে। ফুলওয়ালা যে রোজ মারিয়ার কাছে আসতো সে খবর জানিয়েছে গিলবার্ট পুলিশকে সেই সঙ্গে লুনার মুখের সেই রক্ত মাখা জামার টুকরোর কথাও। সেই রাত্রেই পুলিশ ড্রাইভওয়ে এবং বাগান তল্লাশি করেছে। গ্যারেজে একটা পুরনো বাক্সের মধ্যে থেকে বেশ কয়েকটা মোবাইল ফোন, ঘড়ি, এবং অন্যান্য সামগ্রী উদ্ধার করে পুলিশ সেই রাত্রেই । অর্থাৎ রোজ ফুল দিতে এসে ফুলওয়ালা সবার অলক্ষে এই গ্যারাজে ঢুকেই মৃতের জিনিস সুরক্ষিত রাখত।

আর বাগানের সেই গর্তগুলো? যেখানে সে ফুলের গাছ লাগবে বলেছিল মারিয়াকে? রাত্রের অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যেই পুলিশ টর্চের আলোয় সবকটা গাছ উপড়ে ফেলে দেখে শুধুই মানুষের হাড়! 

পুলিশ জানায় ফুলওয়ালা ফেরার। “বুক” এ গত ৫ মাসে ৩ তিনজন নিরুদ্দেশ হওয়ার কথা পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছিল। পুলিশের ধারণা সেই তিনজনই চকের ওই বাড়িতে ফুলওয়ালার শিকার হয়েছিল। বাড়ি থেকে তিনটে দেহেরই কিছু কিছু অংশ খুঁজে পায় পুলিশ। পুলিশ এও জানিয়ে যায় ফুলওয়ালার পরের শিকার হয়ত বা মারিয়া ছিল। তাই সে রোজ তাকে ফুল দিয়ে যেত নিজের হাতে। বন্ধুত্ব ও করেছিল। তবে এই গ্রামে যে সে আর ফিরবে না এও আশ্বাস দিয়ে যায় পুলিশ। 

গিলবার্ট আর মারিয়া কনসারভেটরিতে বসে নতুন সূর্যোদ্বয়ের অপেক্ষা করে। গিলবার্ট আজকাল আর জর্জের দোকানে যায় না। এগনেস একা পরে থাকে কবরে। হঠাৎ একদিন দরজার বেল বেজে ওঠে। ঠিক যে সময়ে ফুলওয়ালা ফুল নিয়ে আসত সেই সময়ে। মারিয়া দরজা খুলতে যায়। গিলবার্ট বাঁধা দিয়ে নিজে এসে দাঁড়ায় দরজার সামনে।এক তোড়া সাদা গোলাপ নিয়ে একজন মাঝ বয়সি কোঁকড়া চুলওয়ালা লোক সামনে এসে দাঁড়ায়।