ডিগডিগে রোগা শরীর কেনারামের। ফড়িং এর মত চেহারা নিয়ে সে হাটে ঘুরে বেড়ায় আনন্দে।
হাটবারে সকলের সাথে দেখা হয়। এক গ্রামের সঙ্গে অন্য গ্রামের একটা মেলবন্ধন ঘটে। প্রতি বুধবারে হাট বসে ভুলকুড়ি গ্রামে। আশেপাশের দশ বারোটা গ্রামের মধ্যে সবথেকে বড় গ্রাম হল ভুলকুড়ি।

দশ-বারোটা গ্রামের সকলেই সমীহ করে চলে বাবুরাম পালোয়ানকে। সে নিজে মিথ্যে কথা বলে না, কোনোরকম অপরাধ করে না। আর কেউ কোনো অন্যায় করলে তাকে ছেড়েও কথা বলে না। এই ভুলকুড়ি গ্রামের পালোয়ান হল বাবুরাম।

বাবুরাম পালোয়ানকে একজন জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা আপনাদের গ্রামের নাম ভুলকুড়ি হল কেন?

একে চন্দ্র, গোণার সময় কুড়ি বলতে ভুলে গিয়েছিল হয়তো। বাবুরাম গম্ভীর হয়ে বলে, ”তোমার অত কৈফিয়ৎ এর কাজ কী?”

পেটমোটা সরু ঠ্যাঙের লোকটা হিহি করে হেসে বলে, ”এই এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম আর কী!”

বাবুরাম পালোয়ান বলে, ”চেহারাটা তো একদম মার্কামারা ফড়িংএর মতো। কেন, সকালে উঠে কিছু ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করতে পারো না?”

ডিগডিগে রোগা লোকটা বলে, ”পেটের ব্যারাম হয় বড্ড।” রোগা লোকটা হেসে আরও বলে, ”ব্যায়াম করতে গেলে ঠ্যাঙ নিয়ে আর চলতে পারব না বাবুরাম দাদা।”

গোঁফে তা দেয় বাবুরাম,”আগামীকাল থেকে আমার আখড়ায় চলে আসবি। না এলে বাড়ি থেকে কান ধরে টেনে আনব।”

রোগা লোকটা চুপসে গেল আর ভাবল, এর সঙ্গে কথা বলাই ঘাট হয়েছে।

”তোর নাম কী?”

”আজ্ঞে কেনারাম অধিকারী।”

বাবুরাম বলল, ”যা এখন।কাল থেকে আসবি আমার কাছে।”

পরের দিন ভোর না হতেই কেনারাম কচুর বনে লুকিয়ে থাকল।সকাল সাতটা অবধি মশার কামড়ে প্রাণ যায় যায় আর কী! ঠিক কচুর বন থেকে বের হয়েছে আর দুজন পালোয়ান পিছন দিক থেকে এসে জাপটে ধরে কোলে তুলে একেবারে বাবুরামের আখড়ায়। বাবুরাম কেনারামকে মুগুরটা হাতে দিয়ে বল ঘোরা এটাকে দশবার।

কেনারাম মুগুর ঘোরাবে কী, তুলতেই পারছে না। বাবুরাম কেনারামের কাঁধে মুগুর চাপিয়ে দিল আর বলল, এটাকে কাঁধে নিয়ে মাঠটা দু’পাক ঘুরে আয়। অগত্যা কেনারাম ঘুরতে ঘুরতে কোনোরকমে একপাক ঘুরে উবু হয়ে শুয়ে পড়ল। বাবুরাম বলল,এবার কুড়িবার বৈঠক দে। দশবার ডন টান। কেনারাম শেষে একবাটি ছোলাগুড় পেল। বাবুরামের আদেশমত ছোলাগুড় খেতে হল কেনারামকে।

পরেরদিন কেনারাম সকাল থেকে পেটের ব্যামোয় ভুগতে শুরু করল। ল্যাট্রিন গেল প্রায় দশবার । তারপর হেগোরুগী বিছানায় শুয়ে পড়ল। দু’জন পালোয়ান এসে গায়ে হাত দিয়ে দেখল, গায়ে হাল্কা জ্বর আছে। সেদিন তারা আর জোর করল না কেনারামকে। বাবুরাম শুনে বলল, বেটা একদম কুঁড়ের বাদশা। ওকে পালোয়ানের দলে ঢোকাতেই হবে।

তারপর দিন দশেক পরে আবার কেনারামকে ধরে আনল পালোয়ানের দল। শুরু হল শরীরচর্চা। প্রায় একবছর হয়ে গেল কেনারাম এখন শরীরচর্চা করে নিয়মিত। আর তাকে পেটের রোগে ভুগতে হয় না। কেনারামের দেখাদেখি আশেপাশের অনেক ছেলেছোকরা বাবুরামের আখড়ায় নিয়মিত আসা যাওয়া করল শরীরচর্চার জন্য।

প্রায় তিনবছর পরে একটা কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করল বাবুরাম ও তার দলের পালোয়ানরা। বেশ বড় বড় নামকরা খেলোয়াড় ও পালোয়ানকে এনে স্টেজে বসানো হল। কুস্তিতে যে জিতবে তার জন্য বড়কাপ ও পাঁচহাজার টাকার পুরষ্কার ঘোষণা করা হল। কেনারামও নাম লেখালো প্রতিযোগিতায়। তার গ্রামের বন্ধুরা যারা কেনারামকে পেটরোগা বলে বিদ্রুপ করত, তারাও মজা দেখার জন্য হাজির হল। শুরু হল কুস্তির আসর।

গ্রুপ ক, থেকে একজন সেমি ফাইনালে গেল।গ্রুপ খ থেকে একজন সেমি ফাইনালে উঠল। গ্রুপ গ আর ঘ থেকে উঠল দু’জন। মোট চারজন সেমিফাইনালে গেল। এর পর দু’জন ফাইনালে উঠবে।

লড়াই শুরু হল। কেনারাম সেমিফাইনালে উঠেছে।এখন ফাইনালে ওঠার জন্য লড়াই শুরু হল। বেশ কঠিন সে লড়াই। অবশেষে কেনারাম ফাইনালে উঠল। শুরু হল খ গ্রুপের সেমিফাইনাল। সেখানে ফাইনালে গেল কেনারামের গ্রামের অহঙ্কারী পালোয়ান দুর্যোধন। সে সুযোগ পেলেই কেনারামকে সকলের সামনে অবজ্ঞা করত। আজ হবে কঠিন লড়াই। কেনারাম, বাবুরাম পালোয়ানকে একটা প্রণাম করল। বাবুরাম বলল, ”দুর্যোধন ব্যাটাকে চিৎপটাং করতেই হবে। তোর উপর আমার অনেক আশাভরসা আছে।”

কেনারাম বলল,আমি ওকে হারাবই। তবেই আমার নাম কেনারাম পালোয়ান।”

”সাবাস, সাবাস, এই তো চাই।”

তার পর শুরু হল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মতো কুস্তির লড়াই। দুর্যোধন আর কেনারামের মধ্যে। দুর্যোধন বার বার কেনারামকে পায়ে ধরে টান মারে। কেনারাম সরে সরে যায়। তার পর একটা চরম সুযোগে কেনারাম দুর্যোধনের পায়ে প্যাঁচ লাগিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। তার পর তার উপর চেপে বসে চিৎ করে ধরে থাকে অনেকক্ষণ। বিচারে কেনারাম বিজয়ী ঘোষিত হয়। বাবুরাম পালোয়ানের হাততালির তালে তাল মিলিয়ে দর্শকরা হাততালি দিয়ে ওঠে কেনারামের জেতার আনন্দে।