রীতিমতো আজ বহুদিন পর বাড়ি ফিরছি বলে নানাভাবে ব্যস্ত। ছোট বোনটার আবার জন্মদিন, তাই দিন শেষের আগেই সুন্দর একটা উপহার নিয়ে তার কাছে যাওয়ার তাড়া। এদিকে ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি তাই অফিসের কাজগুলো গুছিয়ে যেতে হবে সেই তাড়না। সব মিলিয়ে যেন ট্রেনটা মিস করে ফেলার অবস্থা। যা ভেবেছি ঠিক তাই হল, আমি যখন পৌঁছালাম, ট্রেনটা ছাড়ে ছাড়ে অবস্থা। আমার লাগেজ সংখ্যাও ভালোই, দৌঁড়ে গিয়ে যে উঠব তা-ও সম্ভব নয়। হঠাৎ করেই ট্রেন থেকে ছোট্ট টুকটুকে সুন্দর একটা বাচ্চা মেয়ে বলে উঠল, “ওই আঙ্কেলটা উঠবে…” (বুঝলাম আমাকেই ইশারা করে সে আঙ্কেল বলতে চেয়েছে)। তার কথা শুনে একজন লোক এসে আমার ব্যাগগুলো টান দিয়ে নিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন…”
আমি কিছুটা লাফ দিয়েই উঠে পড়লাম।
“থ্যাংস, আজকে হয়তো ট্রেনটা মিসই করে ফেলতাম।”
লোকটা হালকা হেসে মেয়েকে নিয়ে চলে গেল। (আমার অনুমান মেয়েটা তারই।)
শুরু থেকেই মেয়েটার উপর আমার চোখ আটকে ছিল। এত সুন্দর টুকটুকে মেয়ে। পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে তার দিকে এগিয়ে বললাম, “থ্যাংক ইউ মা…” বাচ্চা মেয়েটা খুব খুশি হয়ে চকলেটটা নিয়ে চলে গেল।
আমি ব্যস্ত হয়ে গেলাম নিজের সিট খুঁজে ব্যাগগুলো রেখে একটু শান্তিতে বসার জন্য। হঠাৎ করেই একটা গলার স্বর আর নাম আমার কানে এসে আঘাত হানল।
“নিহারিকা, এদিকে আসো মা।” পিছনে ফিরে দেখলাম, সেই বাচ্চা মেয়েটা ঠিক আমার বিপরীত দিকের সিটে। আমি কেন জানি না খুশি হয়ে গেলাম; তবে তার চেয়েও বেশি অবাক হলাম বাচ্চাকে যে ডাক দিয়েছিল, তাকে দেখে। বুঝতে অসুবিধা হল না ইনি মেয়ের মা।
এক মুহূর্তেই যেন চলে গেলাম ৫ বছর আগের একটা দিনে। এমনই এক ট্রেন যাত্রায় একদিনের জন্য পরিচয় হয়েছিল একজনের সাথে। (আসলে আমাদের প্রতিনিয়ত অনেক মানুষের সাথে দেখা হয়। সবাইকে আমরা মনে রাখি না বা মনে রাখার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু কিছু মানুষকে চাইলেও ভোলা যায় না)।
৫ বছর আগে সেদিনও বাড়ি ফেরার পথে ট্রেন মিস করতে বসেছিলাম, তখন সেই মেয়েটি আমায় সাহায্য করেছিল। ট্রেনটি ছাড়তেই মেয়েটি নিজের সিটে বসে ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে গান শোনায় ব্যস্ত হয়ে গেল। জানি না কেন, আমি সামনে বসে নিষ্পলক চেয়েছিলাম মেয়েটির দিকে। সৃষ্টিকর্তার কী অপূর্ব সৃষ্টি! শ্যামবর্ণের মধ্যে কী মায়াবি তার চেহারা! কী ছলছল চোখ! হঠাৎ করেই যেন তার প্রতিটি বিষয় আমায় আকৃষ্ট করল। একটা মানুষ কেমন করে এত সুন্দর হয়! সেটা মেয়েটির নজরে পড়েছিল কী না জানি না, আচমকা আমার ঘোর ভেঙে দিয়ে সে বলে উঠল, “আপনি কি সবসময়ে এমন পরিস্থতিতে পড়েন নাকি?””না… মানে ইয়ে, বাড়ি যাব তো, মায়ের জন্য জামদানি শাড়ি কিনতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। তবে আপনাকে থ্যাংস।”
“ওয়েলকাম। তবে আরেকটু দেরি হলে তো ট্রেন গেছিলো…”
“হ্যাঁ, তখন আর কী অন্যভাবে যেতে হত।”
“আপনার কষ্ট হত। শাড়ির জন্য দেরি না করে অন্যকিছুও নিতে পারতেন!”
“কষ্ট হতো বটে, জামদানি শাড়ি দেখে মায়ের মুখে যে হাসি আসে, তা আমার জন্য বেশি জরুরি।”
(কথাটি শুনে মেয়েটির হাসি দেখে বুঝতে পারলাম তার কাছে ব্যাপারটা ভালো লেগেছে)
“ওহ… আপনার নামটাই জানা হলো না!”
“নাদিরা৷ আপনার?”
“রায়হান।”
তার পর একের পর এক কথায় আড্ডা ভালোই জমে উঠছিল সেদিন। কী রকম অদ্ভুতভাবে জানি তার আর আমার অনেককিছু মিলে যাচ্ছিল। মাঝ রাতে হঠাৎ গিটার বাজানো শুরু করল সে। আমি গান ধরলাম। নাদিরাও গলা মেলালো। তার স্বরে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এসবের ফাঁকেই তাকে কী একটা প্রসঙ্গে যেন বলেছিলাম, “নিহারিকা শব্দটা আমার বেশ পছন্দের।” সেই কারণ আজ মনে নেই। তবে সেই রাতের মুহূর্তগুলো এখনও চোখের সামনে ভাসে। ভোরের দিকে আমার চোখ লেগে যায়। যখন ঘুল ভাঙল, ততক্ষণে নাদিরা চলে গেছে। শুধু ফেলে গেছে সুন্দর কিছু স্মৃতি আর একটা ছোট্ট চিরকুট। আমার মনে হল, কেন ঘুমাতে গেলাম!
না, আমি একে লভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট বা ভালোবাসা বলব না। এটা নিছক মোহ। কিছুক্ষণের আকর্ষণ, যেটা এতদিনে সে-ও ভুলে গেছে, আমিও। তবে অ্যাদ্দিন বাদে বধূর বেশে নাদিরাকে দেখে চিনতে অসুবিধে হল না। আগের চেয়ে কিঞ্চিৎ স্বাস্থ্যবান হয়েছে সে। লাবণ্য এখনও তার সঙ্গ ছাড়েনি। দেখলাম, সেও আমায় চিনতে পেরেছে।”আরে আপনি! কেমন আাছেন? চিনতে পেরেছেন তো!”
“হ্যাঁ, চিনব না কেন! আমি ভালো। আপনার কী অবস্থা?”
“এই তো ভালো। আশা করিনি এমনভাবে আবার কখনও দেখা হবে৷”
“আমিও। আপনার মেয়ে?”
“হ্যাঁ।”
“খুব মিষ্টি।” (মনে মনে বললাম ঠিক আপনার মতো)
এরপর কীভাবে যেন নিহারিকার সঙ্গে আলাদা একটা বন্ড হয়ে গেল। বাচ্চা মেয়েটাও আমার সাথে খুশি। পুরো ট্রেন যাত্রা আমার নিহারিকাকে নিয়েই কাটল। রাত গভীর হয়ে গেছে তা-ও ও ঘুমোতে রাজি না। আমার সাথে আরও খেলবে। একটা সময় আমার কোলেই ঘুমিয়ে যায়। আমার যখন নেমে যাওয়ার সময় হল, তখনও গভীর ঘুম। ইচ্ছে করছিল না ওকে রেখে চলে যেতে। কী যেন এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম। তার পর মনে হল, এত কিছু না ভেবে ওর ঘুম ভাঙার আাগে চলে যাওয়াই ভালো, নতুবা যদি সঙ্গে যাওয়ার বায়না জোরে! যেমন মিশুকে মেয়ে, তার বাবা-মাও অপ্রস্তুত হয়ে পড়বে। বরং চলে গেলে হয়তো সকালে উঠে একটু মনে পড়বে, তার পর ধীরে ধীরে ভুলে যাবে। নামার আগে তাকে আমার বার্থে শুইয়ে চাদর ঢাকা দিয়ে দিলাম। দেখলাম, তার মা ও বাবাও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। স্টেশনে ট্রেন ঢুকছিল। আমি শেষবারের মতো নাদিরা আর নিহারিকাকে দেখে নিলাম এক ঝলক।
মনে পড়ল পাঁচ বছর আগে এমন এক রাতে নাদিরার রেখে যাওয়া চিরকুটটার কথা। সেখানে লেখা ছিল – “আকস্মিক মোহ বেড়ে স্থায়ী হওয়ার আগে নীরবে চলে যাওয়াই শ্রেয়।”