কমলেশ কুমার|

রতু বাগদি পালিয়েছে। শুধু যে পালিয়েছে তাই নয়, পালানোর সময় নিয়ে গেছে জিতু মাঝির বৌ কনককে।

পাড়ার লোকে অনেকদিন ধরেই গুজুর-ফুসুর করত রতুর সঙ্গে কনকের নাকি একটা মাখো-মাখো ব্যাপার তৈরি হয়েছে। পাড়ার মাচায়, চায়ের দোকানে, পুকুরের ঘাটে এই নিয়ে পুরুষ-মহিলারা আলোচনাও করত খুব, কিন্তু মধু সে সব বিশ্বাস করতে পারত না। মধু ভেতর থেকে বিশ্বাস করত, রতু শুধু ওরই। একান্তভাবেই ওর। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে বিয়ের সাত বছর কেটে গেলেও মধু রতুকে কোনও বাচ্চা-কাচ্চা দিতে পারেনি এখনও, কিন্তু তাই বলে রতুও তো তার জন্য কোনওদিন গালমন্দ করেনি মধুকে! বরং উল্টোটাই হয়েছে বেশি। প্রতি রাতে মধুই নিজেকে দোষারোপ করতে করতে, চোখের জলে ঝাপসা হতে হতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই রতু পারল মধুবনীকে ছেড়ে অন্য একটা পাড়ার বৌয়ের সঙ্গে ভেগে যেতে?

“পারে রে মধু, পারে। পুরুষ জাতটাই অমন হয় রে! শরীলের চাহিদা মেটাতে সব পুরুষ মানুষই ওরকম ছুঁকছুঁকে হয়। মেয়েছেলেদের উচিত তাদের বেঁধে রাখা, সেটা তুই পারিসনি রে মধু!” কথাটা বলে হাঁপাতে লাগল পারুলঠাকমা, “সব পুরুষমানুষকে আমি চিনি। মদ্দার ব্যাটারা সবাই এক। যতদিন শরীল, ততদিনই সোহাগ। শরীল গেল তো সোহাগও গেল।”

“এটা তুমি ঠিক বললে না গো পিসি। এই আমাদের মানুষটাকেই দেখো না! বয়েস তো আর কম হল না! তা, তিন-কুড়ি তো হবেই; কিন্তু বৌ ছাড়া কিচ্ছুটি জানেনে কো। হ্যাঁ, এটা ঠিক মদ-টদ গিলে বাড়ি ঢুকেছে অনেকবার, মদের ঘোরে আমাকে পিটিয়েছেও; কিন্তু ঘোর কাটলেই আবার সেই লক্ষ্মী লক্ষ্মী করে মাতিয়ে তুলেছে।” বেশ গর্বের সঙ্গে কথাগুলো বলে লক্ষ্মী একবার মধুর দিকে আর একবার পারুলঠাকমার দিকে তাকাল।

আসলে আজ সকালে উঠেই জানা গেছে রতু আর কনক পালিয়েছে। অনেকেই নাকি ওদের দু’জনকে হাওড়ার দিকের ট্রেন ধরতে দেখেছে। সেই থেকে রতুর বাড়ির উঠোনে লোকের জায়গা দেওয়া মুশকিল। প্রথম এসেছে কনকঠাকমা। তারপর রন্তুদিদি, নিরাময়কাকা, ছোট হেবো, চম্পা পিসি, মানু বাগদি, কে আসেনি! মধুকে নানা গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান করে, তার ভবিষ্যত জীবনে কী করা উচিত সেই সম্বন্ধে বিস্তারিত মতামত জানিয়ে, রতুর বিরুদ্ধে মধুর কানে ভালো মতো বিষ ঢেলে একসময় ক্লান্ত হয়ে তারা চলে গেছে জিতু মাঝির বাড়ির দিকে। কনক কী করে রতুর সঙ্গে পালাতে পারল, এমন একটা লোফার ছেলের সঙ্গে কী করে সে বাকি জীবনটা কাটাবে – এইসব নিয়ে রাশি রাশি চিন্তা আর উদ্বেগ ঝরে পড়েছে তাদের গলায়। রতুর বিরুদ্ধে হাজাররকম উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলে, রতুর নামে জিতুকে থানায় গিয়ে এফআইআর করারও পরামর্শ দিয়েছে পঞ্চা বাউলদাস। পঞ্চা এই দেউলটি গ্রামের সদস্য। পার্টিতে খুব নামডাক করেছে ইদানিং।

দুপুরের দিকে খবর পেয়ে মধুর মাও চলে এসেছে বাড়িতে। এসেই ধমকাতে শুরু করেছে মেয়েকে, “পইপই করে তখন বলেছিলাম নেকাপড়া কর। একটা পাশ অন্তত দে। তখন তো মা তোর পিরিতি একেবারে উথলে উঠল। একটা থিরি কেলাস পাশ ছেলের গলায় মালা দিলি তুই। নে, এবার সামলা। সারা জীবনটা কী বাপের ঘরে গিয়ে বসে বসে খাবি রে মুখপুড়ি!”

মধুবনী নামটা ওর বাবাই খুব আদর করে রেখেছিল। মধুবনী সাঁতরা। বাড়ির সকলে আর পাড়ার লোকজন মধু বলেই ডাকত অবশ্য। মধুর বাবা একটা কাপড়ের দোকানে কাজ করত, অল্প কিছু জমি জায়গাও ছিল। ওর বাবার খুব ইচ্ছা ছিল মেয়ে লেখাপড়া শিখে মানুষ হোক। কলেজ যাক। এমন কী সোনালী দিদিমণি, স্বাতী দিদিমণি, দেবার্চি দিদিমণিদের মতো ইস্কুলে পড়াক তার মেয়ে; এমন ইচ্ছাও তার বুকের গভীরে জমা করে রেখেছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। ক্লাস নাইনে পড়তে পড়তেই মধুর সঙ্গে আলাপ হল দেউলটি নামের ঠিক তিনটি গ্রাম পরের বাসিন্দা রতু বাগদির। রতুর জমি জায়গা বলতে ফক্কা। হাতের কাজ জানত ছেলেটা। বাঁশ-কঞ্চি কেটে ঝুড়ি, পেতে বানাত।কারোর বাড়ির খড়ের চালা ছাইত। এইসব করে যা আয় হত আর কী! হঠাৎ একদিন বলা নেই, কওয়া নেই সিমলাগড়ের কালীমন্দিরে গিয়ে দুম করে বিয়ে করে ফেলল রতু আর মধু। আর ঠিক সেই দিনই মধুর বাপের বাড়ির দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। ওর বাবা পরিষ্কার জানিয়ে দিল, জীবনের মতো মেয়ের মুখদর্শন করবে না আর। মধুর মায়ের উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি হল, কোনওভাবেই আর মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না।যদিও মধুর মা আড়ালে-আবডালে মধুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখত।

“শোন মধু, আজ সন্ধের দিকে আমার সঙ্গে একবার দেখা করিস। তোকে জব কার্ডটা বানিয়ে দেব। দিন সাত-আট বাদ থেকেই একশো দিনের কাজে লেগে যাস। পেটটা তো চালাতে হবে, নাকি!” পঞ্চা বাউলদাসের কথায় সম্বিৎ ফেরে মধুর। মা এখন রান্নাঘরে। কখন পঞ্চা বাউলদাস এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি মধু। লোকটাকে ওর ভালো লাগে না। খুব গায়ে পড়া স্বভাব। কম বয়সী মেয়ে দেখলে নোলা লকলক করে একেবারে।পঞ্চার কথার কোনও জবাব দেয় না মধু। 

একশো দিনের কাজের কথা বলতেই মধুর মনে পড়ে গেল বেশ কিছুদিন আগের একটা ঘটনা। রতুর পাশে শুয়ে সোহাগ খেতে খেতে মধু বলেছিল, “আমিও একশো দিনের কাজ করলে মন্দ হয় না কিন্তু! কাজ তো সেরকম বিশেষ কিছু থাকে না। আরও একটু বেশি উপার্জন করতে পারতাম আমরা।”

কথাটা শুনেই ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল রতু। বলেছিল, “মেয়েমানুষের অত টাকার আহিঙ্কে কীসের? আমি যা আয় করি তাতে কি হচ্ছে না তোর? ডাল-ভাত তো রোজই জুটিয়ে দিচ্ছি আমি। উপোস-তাপাস করে তো আর থাকতে হচ্ছে না। আর আমাদের তো ছানাপোনাও নেই যে, তোকে একশো দিনের কাজ করে বাড়তি উপার্জন করতে হবে।”

শেষ কথাটা রতু ভাবনা-চিন্তা না করেই বলেছিল, কিন্তু মধু ওই শেষ কথাটাতেই তির বেঁধা পাখির মতো ছটফট করে উঠেছিল। আবার শুরু করেছিল নিজেকে দোষারোপ করতে।কাঁদতে কাঁদতে ভিজিয়ে দিচ্ছিল রতুর বুক। সেই গভীর রাতে রতু কাছে টেনে নিয়েছিল মধুকে। আদরে আদরে পাগল করে দিয়েছিল ওকে। আস্তে আস্তে সেদিন রতু মধুকে ভুলিয়ে দিয়েছিল সন্তান না থাকার যন্ত্রণার কথা। শূন্যতার কথা ভুলিয়ে দিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল রতু।

সে কথা খুব বেশিদিন আগের নয়। কী দিন ছিল তখন! মধুকে ছাড়া রতুর এক মুহূর্ত চলত না। সকালে কাজে যাওয়ার সময় মধুর হাত থেকে জিনিসপত্তর না নিলে ওর নাকি জমাটি কাজ হয় না, তাই মধুকেই প্রতিদিন সকালে কাস্তে-কাটারি প্রভৃতি প্রযোজনীয় জিনিসগুলো হাতে হাতে এগিয়ে দিতে হত। মধুর তৈরি এক কাপ চা খেয়ে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে পড়ত রতু। ফিরত সেই দুপুর পেরিয়ে গেলে। মধুও খাবার আগলে না খেয়ে বসে থাকত ওর জন্য। কতবার আগে খেয়ে নিতে বলে মধুকে ধমকেছে রতু, কিন্তু কোনও ফল হয়নি। অপেক্ষাতে কোনও ক্লান্তি থাকে না মধুর। অপেক্ষা করতে করতেই তো সাতটা বছর পার করে দিল ও। 

চোখের জলটা মুছে নিয়ে মধু দেখল পঞ্চা বাউলদাস তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পাশে।মধুকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার মেপে নিল পঞ্চা। তারপর হাতে খৈনি ডলতে ডলতে বলল, “কেঁদে কেটে আর কী করবি রে! সে কী আর তোর কথা ভাবল, বল! সুন্দরী কনকটাকে নিয়ে হাপিস হয়ে গেল মালটা। অমন ডবকা মেয়েছেলে দেখে রতু নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি রে মধু! তবে তুই চিন্তা করিস না। আমি আছি তোর পাশে। তোর যখন যা দরকার হবে আমাকে বলিস, টুসকি মেরে সমাধান করে দেব সব। আর শোন, আজ সন্ধেতে অবশ্যই যাস। তোর জব কার্ডটা তাড়াতাড়ি বানিয়ে ফেলতে হবে।” কথাগুলো বলে পঞ্চা বাউলদাস গায়ের গামছাটা ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে দরজার দিকে চলে গেল। যাওয়ার সময় একবার দাঁড়াল পঞ্চা। ঘাড় ঘুড়িয়ে মধুকে বলল, “সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ যাস। তখন আমি ফাঁকাই থাকব।”

কনকদিদি সত্যিই খুব সুন্দরী। পানপাতার মতো মুখ। টানাটানা চোখ। টিকালো নাক। কী সুন্দর সাজানো ঝকঝকে সাদা দাঁত। কনকদিদি উচ্চমাধ্যমিক পাশ। আশা কর্মীর কাজ করে কনকদিদি। পাড়ায় ছোটখাটো কারোর কোনও অসুখ-বিসুখ হলে ও-ই ওষুধ দিয়ে সারিয়ে তোলে। মধুর সঙ্গে কনকদিদির কোনও তুলনাই চলে না। কনকদিদি শহরে যায় মাঝেমধ্যে। কী সুন্দর হেসে হেসে কথা বলে সকলের সঙ্গে। তবে গায়ের রংটাতে কী একটু হলেও এগিয়ে নেই মধু? মধুর গায়ের রং দেখেই তো রতু একবার বারোশো পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ময়ূরপঙ্খী রঙের একটা শাড়ি কিনে এনে দিয়েছিল ওকে। অত দামি শাড়িটা মধু টিনের বাক্সটা থেকে বের করতে চায় না সচরাচর; কিন্তু ও ভালোভাবেই জানে, শাড়িটা পড়লে রতু ওর দিক থেকে পলক ফেরাতে পারে না।

সন্ধের দিকে দাওয়াতে একাই বসেছিল মধু। বাড়িতে যেন উৎসব লেগেছিল আজ সকাল থেকে। বহু লোকজনে পরিপূর্ণ ছিল আজ বাড়িটা। এখন শূন্য। সবাই নিজের নিজের মতো করে জ্ঞান বিতরণ করে ফিরে গেছে বেশ খানিকক্ষণ আগে। মাও বাবার ভয়ে চলে গেছে সন্ধের আগেই। এখন ফাঁকা বাড়িটা একা মধুকে যেন গিলে খেতে আসছে। রতুর সঙ্গে আলাপের একেবারে প্রথম দিনটা থেকে শুরু করে, কত সোহাগের কথা, মান-অভিমানের কথা, হাসি-ঠাট্টার কথা মধুর স্মৃতিতে ভেসে ভেসে উঠছে এখন। 

আজ সকালে তো কম অপমানিত হয়নি মধু! ‘বাঁজা মেয়েছেলে’ শুনতে শুনতে একসময় মরে যেতেও ইচ্ছে হচ্ছিল মধুর। এই কথাটা ওই মানুষটা ওকে কোনওদিন বলেনি। পাশের বাড়ির সীতানাথকাকা একবার কথাটা বলেছিল বলে রতু ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সীতানাথকাকার উপর। মধুই সে যাত্রায় রতুকে টেনে এনে সীতানাথকাকাকে বাঁচিয়েছিল। কী যে ভালোবাসত মানুষটা ওকে! এখনও ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না মধু যে, মানুষটা কনকদিদিকে নিয়ে একটা নতুন সংসার পাততে শহরে পাড়ি দিয়েছে। মানুষটাও তো কনকদিদিকে মধুর মতো কনকদিদিই বলত। কনকদিদিও ভাইয়ের মতোই ভালোবাসত রতুকে। সেই জন্যই তো ওদের দু’জনের নামে কানাঘুঁষো শুনেও সেসব কথাকে কোনও গুরুত্বই দেয়নি মধু এতদিন। না দিয়ে কী তবে ভুলই করেছে মধু?

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন দাওয়াতেই ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। খুট করে টিনের দরজাটাই আওয়াজ হতে ঘুমটা ভেঙে গেল মধুর। কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ আজ তাঁর মায়াময় জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দিচ্ছে গোটা পৃথিবীতে। শিরশিরে একটা হাওয়ায় বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে মধুর। মধু দেখল, দরজা থেকে একটা ছায়ামূর্তি ধীর পায়ে দাওয়ার দিকে এগিয়ে আসছে। রাত এখন কত সেটা আন্দাজ করতে পারছে না মধু, তবে চাঁদের আলোয় ছায়ামূর্তিটাকে চিনতে কোনও ভুল করেনি ও। সাত বছর ধরে একসঙ্গে ঘর করে চিনতে ভুল করবেই বা কী করে মধু!

রতু ধীরে ধীরে এগিয়ে এল মধুর দিকে। মধুর পায়ের দিকে বসল ও, তারপর ক্ষীণস্বরে বলল, “আমাদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল রে মধু!”

লোকটা সারাদিন ছিল কোথায়, এল কোত্থেকে, এই সব বহু প্রশ্ন একসঙ্গে করার জন্য কোমর বেঁধে উঠে দাঁড়াল মধু। আজ লোকটার জন্য বহু ভাবে লাঞ্ছিত আর অপমানিত হতে হয়েছে মধুকে, সে এর যোগ্য জবাব চায়। একটা হেস্তনেস্ত আজ করতেই হবে। 

কিছু বলতে যাচ্ছিল মধু, কিন্তু তার আগেই রতু বলতে শুরু করল, “সাত-সাতটা বছর ধরে তুই মিছেই বাচ্চার জন্য অপেক্ষা করলি রে মধু! কেন যে বিয়েটা আমায় করেছিলি!” একটু থেমে রতু আবার বলল, “অনেকেই বলছিল আমাকে পরীক্ষা করানোর কথা। সাত বছর ছেলেপিলে হল না বলে কম কষ্ট তো পাসনি তুই! একটু টাকা-পয়সা জমিয়ে কনকদিদির সঙ্গে পরামর্শ করে কলকাতা চলে গেলাম আজ সকালে। তোকে বললেই বাগড়া দিতিস, তাই বলিনি।” মাটির কলসিতে রাখা জলটা গ্লাসে ঢালতে ঢালতে রতু আবার বলল, “কনকদিদির শহরটা চেনা। তাই নিয়ে গেলাম সঙ্গে করে। গেলাম বলেই সত্যিটা জানতে পারলাম।”

“সত্যিটা কী?” উত্তেজনায় ছটফট করতে করতে জিজ্ঞাসা করল মধু।

“আমাদের ছেলেপিলে হবে না রে মধু কোনওদিনও, আমার বীর্য পরীক্ষা করে তাই জানিয়ে দিয়েছে ডাক্তারবাবুরা।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল রতু।

কথাটা শুনে মধুর বুকে যেন সাত সমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল। মনে হল পৃথিবীটা টলে গেল যেন। সন্তানহীন সারাটা জীবন কীভাবে কাটাবে মধু? সাতটা বছরের প্রতিটি দিন সে একটা অপেক্ষার স্বপ্ন নিয়ে বেঁচেছিল, এবার কীভাবে বাঁচবে সে? ডুবন্ত যাত্রীর খড়কুটো আগলে বাঁচার মরিয়া চেষ্টার মতোই মধু বলল, “ওষুধের দ্বারা…”

“সারানো সম্ভব নয়” মধুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রতু জবাব দিল। “স্বাভাবিকের থেকে আমার অনেক কম।” একটু থেমে রতু আবার বলল, “অন্য পদ্ধতিতেও বাচ্চা হয়।তার জন্যে কয়েক লক্ষ খরচ। আমাদের কাছে সে সব স্বপ্ন।”

কথাটা শুনে মুহুর্তের মধ্যে মধুর  চোখের সামনে যেন সব আলো নিভে গেল। একটা দমবন্ধ কষ্ট বুকের কাছে এসে থমকে গেল ওর। এতদিন ধরে তিল তিল করে জমানো স্বপ্নটা ভেঙে গেল এক লহমায়। আজকের সারা দিনের এত অপমান, লাঞ্ছনা, ভুল বোঝাবুঝি সব অর্থহীন মনে হল মধুর।

মধু দেখল ওর চোখের সামনে জোয়ান মরদ ছেলেটা যেন মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কান্নায় ফুলে ফুলে উঠছে ওর শরীরটা। মধু এগিয়ে গিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরল রতুর মুখটা।কপালে নেমে আসা রতুর চুলগুলোকে ঠিক করে দিতে দিতে ওর মাথায় আলতো করে চুম্বন করল মধু। এতক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলা রতুর চোখের জল বন্যার মতো আছড়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে।

রতুর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বিড়বিড় করতে লাগল মধু, “আমরা তো দু’জনে রইলাম দু’জনের জন্য। বাচ্চা না হোক, আমরা দু’জনে ঠিক বেঁচে থাকব, দেখো…” কথাটা বলে মধু আরও আঁকড়ে ধরল রতুকে। মধু জানে কিছুক্ষণ আগে পঞ্চা বাউলদাস ওর জমিতে বীজ পুঁতে দিয়ে গিয়েছে, সেখান থেকে ফসল ফলতেও পারে। এক অদ্ভুত আত্মতৃপ্তি অনুভব করল মধু।

কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ তখন তার স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে শূন্যতার সঙ্গে সহবাস করতে থাকা দুই নারী-পুরুষের শরীরে। রাতজাগা পাখিটা ডেকেই চলেছে একটানা!