সোনাদাদু নুয়ে নুয়ে হাঁটতেন। মাথার চুল ঝড়বৃষ্টির পরের দিনের কাশফুলের মতো। ফতুয়া আর ধুতি, সেও ওই অমনধারাই।
সোনাদাদু আমাদের বাড়িতে এলে, ঠাকুমা লাল রকের ওপর আসন এগিয়ে দিতেন, মা কাঁসার গ্লাসে জল, দিদি রেকাবিতে বাতাসা। বাবা বলতেন, সোনাকা, নাতিকে একটু ট্রানস্লেশন ধরো দিকি। টেন্স শিখছে।
টেন্সের নামেই সোনাদাদুর ঘোলাটে চোখ চিকচিক করে উঠত। …বলো তো দাদু, ইস্টিশনে পৌঁছে দেখি, ট্রেন ছেড়ে গেছে!
পাস্ট পারফেক্ট। কিছুতেই জুত করতে পারতাম না। ভুল হত। আর সোনাদাদু যেন সেইটা বুঝেই, বার বার ওই বাক্যটাই ধরতেন। ট্রেন ছেড়ে গেছে…
সোনাদাদুকে অপছন্দ করতাম খুব। একদিন বলেছিলাম, এমন ট্রেন কেন ধরতে যান যেটা ছেড়ে গেছে! একটু সময়মতো, হিসেব করে যেতে কী হয়? তাহলে তো টেন্সও ভুল হয় না!
বাবা অপ্রস্তুত। সোনাদাদু হাঁফের টানের মধ্যেই হেসে উঠে বলেছিলেন, ওরে, এ হিসেবি ছেলে! ট্রেন ফেল করবে না রে!


সোনাদাদু মারা গেছেন কত বছর হল? আজ আর হিসেব রাখতে পারি না। বাবারটা এখনও মনে আছে। একুশ বছর হবে, জুলাইয়ে। মা তেরো। দিদি গত বছর।
লাল রকটা কবে ভাঙা হল? সেটা আর মনেই নেই। গাড়ি কেনার পর ওখানে গারাজ তুলেছিলাম। সেও কত যুগ আগের কথা।
আমার নাতনি পামেলা এখন কনভেন্টে পড়ে। গড়গড়িয়ে চোস্ত ইংরিজি বলে। বছরে বার দুই এখানে নিয়ে আসে ওর বাপ, দেখা করিয়ে নিয়ে যায়। ইচ্ছে হয়— মজা করে ওই পুরনো ট্রানস্লেশনটা একটু জিগ্যেস করি, কিন্তু সাহস হয় না। টেন্স, বড় ঝামেলার জিনিস।


যে-ইস্টিশন আমার গন্তব্য ছিল, সেখানে আমি কিন্তু পৌঁছেছিলাম। চড়ে বসেওছিলাম ঠিকঠাক। সোনাদাদু ঠিকই বলেছিলেন। ট্রেন তো ফেল করিনি।
অথচ, বৃদ্ধাশ্রমের আলোগুলো আজকাল বড় কমজোরি লাগে! অন্ধকার পুরোপুরি কাটে না। তার মধ্যে কে যেন……কে ওখানে? কাচ-লাগানো গ্রিলের পাল্লায় যেন কার ছায়া! ঠিক দেখলাম, না ভুল? নুয়ে পড়া, সাদা ফতুয়া, সাদা চুল… ঠাহর হয় না ঠিকমতো। ছানি পেকেছে। আমি শুধু বসে বসে মশা মারি আর বিড়বিড় করি। একই কথা বলি কেবল।
তবু, টেন্সটা ভুল হয়ে গেল কেন, সোনাদাদু? টেন্সটা?