রুমেলা দাস।
সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৮, শনিবার
আচ্ছা আপনারা সত্যি সত্যি কখনও ভূত দেখেছেন? মানে এমনটা কি কোনওদিন হয়েছে যে, তিনি বা তাঁরা আচমকা আপনাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আর আপনি এক সেকেন্ডে কুপোকাত। কী ভাবছেন? মজা করছি? না, মজা করার মুডে আমি নেই। একটা ব্যাপার একটু খোলসা করতে চাই। তবে ভূত বললেই যে শ্যাওড়া গাছের পেত্নী বা মামদো হতে হবে এমন কোনও মাথার দিব্যি নেই। ভূত হচ্ছে অতীত। যা কিছু ঘটে গেছে তাকেই আমরা ভূত বলি। এই যে আমি লিখছি, সেকেন্ড পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটাও অতীতই হয়ে যাচ্ছে। ঠিক যে কায়দায় বসে, যে জামা পরে আজ আমি লিখছি। বেশ কয়েকদিন পরে হুবহু এমন কায়দার ‘আমি’কে যদি আমারই সামনে একইভাবে লিখতে দেখি, বসে থাকতে দেখি, বুক ধরফরিয়ে উঠবেই। অস্বাভাবিক এমনই একটা কারণের জন্যই আজ ডায়েরি লিখতে বসেছি।
চরকির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি বছর কুড়ি হল। ভারত তো বটেই, বিদেশেও যেতে হয় জরুরী স্কুপ নিতে। মশাই এই সব চক্করে বিয়েটাই করা হয়ে উঠল না। মাঝে মাঝে সুন্দরী ট্রেনি জার্নালিস্ট অফিসে ঢুকলে বুকটা চলকে ওঠে। ওটুকুই। এই পঞ্চাশে এসে নতুন করে কিছু শুরু করার নেই। ও হ্যাঁ, অন্য ট্র্যাকে চলে গিয়ে আমার নামটাই তো বলা হয়ে ওঠেনি; আমি সিনিয়র জার্নালিস্ট, শতরূপ সান্যাল। বেজায় বেপরোয়া, আঁতেল, নাস্তিক মেন্টালিটির মানুষ।
বেশ কিছুদিন যাবৎ বড়সড় একটা কনফিউশনে পড়েছি। তাই রাত একটায় নিজের কাগজের আর্টিকল শেষ করেও এসব লিখছি। কী করব, ঘুম পাচ্ছে না যে! চোখ বুজলেই শুধু…
কিছুদিন আগের ঘটনা। যদি স্কুপ হিসেবে ধরে নিই, তাহলে বেশ টাটকাই বলা চলে। আমি আর ক্যামেরাম্যান সঞ্জয় যে ত্রাণশিবিরে উঠেছিলাম জায়গাটার নাম থানেরমুককুম। কেরালার এক ছাপোষা গ্রাম। আমরা পৌঁছেছিলাম ২২ আগস্ট ২০১৮। বিপর্যয় যা ঘটার তার আগেই ঘটে গেছে। কেরল রাজ্যের ৩৮৮৫২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবিরত বৃষ্টিপাত হয়েছে ৯-১৫ আগষ্ট। গ্রামকে গ্রাম ভেসে গেছে। ১ লাখ মানুষকে মৎস্যজীবীরা ট্র্যাকে চড়িয়ে তাঁদের নৌকা নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে অপেক্ষাকৃত উঁচু বাড়ির ছাদে। ২৫৭ শতাংশ বেশি বৃষ্টি তো কোনও সামান্য ঘটনা নয়।
কিন্তু মানুষের মন শ্রী বৃন্দাবন। ভয়াবহ বন্যাতেও কেরলের মানুষ কীভাবে ‘ওনাম’ পালন করছে, সেই দেখতেই আমাদের যাওয়া।
ওনাম, সারা বছর এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে থাকে কেরল। কেরলের মালওয়ালি সমাজ, কিন্তু বন্যা পাল্টে দিয়েছে পুরো ছবিটাই।
যে দিনের কথা দিয়ে শুরু করব, স্থানীয় ভাষায় সে দিনের নাম ‘চোধি’। মানে দশদিনের ‘ওনাম’ উৎসবের তৃতীয় দিন। শুনেছিলাম অন্য ত্রাণশিবিরে যাঁরা তুলনামূলক ভাল অবস্থায় আছে, তাঁরা কোনওমতে ‘কাসাভু’ (ওনামের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, মেয়েদের সোনালী পাড় সাদা রেশমের শাড়ী), ‘মুন্ডু’ (পুরুষদের সাদা সিল্কের লুঙ্গি আর ঊর্ধাঙ্গের সোনালী জামা) পরে নিজেদের আশ্রয়হীন, গৃহহীন জীবনেও টুকরো আলো খুঁজে চলেছেন।
আমাদের ত্রাণশিবিরে ছিল জনা পঞ্চাশ মানুষ। তার মধ্যে কুড়ি জনেরও বেশি এই গ্রামেরই নন। কারোর গবাদি হারিয়েছে, কারোর সাধের বসত।
আর জীবন?
বুক কেঁপে উঠেছিল, মুল্লাপাল্লি রামচন্দ্রণের ঘটনা শুনে। গ্রামে সম্পদ বলতে ছিল তাঁর মাটির ঘর। আর জোয়ান ছেলে। বউ দশ বছর হল মারা গেছে। জুন থেকেই ভারি বর্ষণ হওয়ায় খেতির ক্ষতি হচ্ছিল। তবু বুকে বল ছিল, ছেলে তো আছে। বাপ-ব্যাটায় জোট বেঁধে থাকলে ঠিক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
হয়নি। গ্রামে বসবাসের জায়গায় বুক অবধি জল উঠে গেছিল যেদিন, সেইদিন ২৪ ঘন্টা বাপ-ব্যাটা এক গাছের মোটা গুঁড়ির মগডালে উঠে বসেছিল। রাতের মাঝ বরাবর চোখ বুজে এসেছিল রামচন্দ্রণের। রাত তখন কত হবে কে জানে! প্রচন্ড বাজ পড়ার শব্দে তাকিয়ে দেখে, কোথায় গাছ? কোথায় মগডাল? সব যে জলে জল! হাকুপাকু করে নিজে কিছু একটা ধরে ভাসার চেষ্টা করেছিল ভোর অবধি।
ছেলে…? নেই… কোত্থাও নেই! গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়েও কোনও লাভ হয়নি। সর্বশক্তি দিয়ে জল ঘেঁটে ঘেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সেও, কিন্তু ছেলেকে আর খুঁজে পায়নি। শেষমেশ উদ্ধারের নৌকা তাঁকে এখানে পৌঁছে দেয়। বিলাপের মতো মাথা চাপড়াচ্ছিল বৃদ্ধ। নোনা জলের সারি নামছিল গাল বেয়ে। হতাশায়, যন্ত্রণায় রাতজাগা চোখগুলো ফুলে উঠেছিল রক্তজবার মতো। বুকের খাঁচাটা ওঠা-নামা করছিল হাপরের মতো। হঠাৎ আমার হাত ধরে বলেছিল, “আমি বিশ্বাস করি অনুজ ফিরে আসবে। ও কখনই এই বুড়ো বাপকে ছেড়ে যাবে না। কি বলো? তিনি যে আমাকে কথা দিয়েছেন। ছেলেকে ঠিক ফিরিয়ে দেবেন।”
শেষের কথাগুলো বলতে বলতে ওঁর চোখদুটো আচমকাই ধক করে জ্বলে উঠেছিল। কী জানি কেন, আমি আর একমুহূর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি।
সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৮, রবিবার
থানেরমুককুমের জল কমছিল না। বুঝতে পারছিলাম পরিস্থিতি এমন, আরেকটু জল বাড়লে শিবিরই ভেসে যাবে। আশেপাশের সবকটা নদী ভেসে যাওয়ায় অবস্থা আরও শোচনীয় হয়। সঞ্জয় আমাকে বলেছিল, “দাদা আমাদের এবার অন্য জায়গায় যেতে হবে। না হলে বুঝতেই পারছ…”
বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু অজানা এক অনুভূতি আমাকে ভেতর থেকে নিষেধ করে চলেছিল। ওর ওপর রাগ দেখিয়ে বলেছিলাম, “পালিয়ে যাব? এদের একটা ব্যবস্থা না করে! আমরা শহরের লোক আছি বলে ওরা একটু ভরসা পাচ্ছে। কোনও উঁচু স্কুলবাড়ি বা পঞ্চায়েত…”
এখানে আর একদিন থাকা মানে ভয়াবহ রিস্ক। কিন্তু মন, শরীর কিছুতেই আমার বশে আসছিল না। মানুষগুলোর পাশে থাকতে থাকতে ওদেরই একজন বলে মনে হচ্ছিল নিজেকে। যে আমি ছোট থেকে মন্দিরে ঢুকি না আজ পর্যন্ত, সেই আমি হাঁ করে পূজা-আচ্চার গল্প শুনছিলাম। সংস্কারে চোবানো পুরাণ শুনে শিহরিত হচ্ছিলাম। কেন? দুর্ভাগ্যবশত সেদিন ছিল ওনামের ‘ভিসাকাম’ অর্থাৎ মহাভোজের দিন। ভোজ তো দূরের কথা, সারাদিন এক দানা অন্ন কারোর পেটে পড়েনি। বিকেলের দিকে হেলিপ্যাডে কিছু শুকনো খাবার, জল আসে। হাতে হাতে সবাইকে তা দিতে রাত অনেকটা বেড়ে গেছিল। বৃষ্টিটা সামান্য ধরে আসলে আধখানা মুড়ির প্যাকেট জোগাড় করে সঞ্জয়কে ধরিয়ে সবেমাত্র শিবিরের পেছনে একটু ফুঁকতে গেছি। একটা কুকুর আমাকে দেখে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে চিৎকার করে ওঠে। বেশ ভয় পেয়ে গেছিলাম। ওরাও তো অভুক্ত। যদি কামড়ে দেয়! মুখ দিয়ে চুক চুক আওয়াজ করে সরে যাই। খানিকটা দূরে একটা ঝোপের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াই। সিগারেটে কয়েক টান দিতেই গা-টা শিরশিরিয়ে ওঠে। মনে হচ্ছিল, আমাকে ঘিরে একটা পচা গন্ধও পাক খাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে মোবাইলটা অন করি। চার্জ তখনও কিছু অবশিষ্ট, ২০%। হল কী আমার? এরকম অনুভূতি তো বাপের জন্মে হয়নি! নিজেকে বোঝালাম। সারাক্ষণ ‘নেই নেই’ এই অসহায়তার মাঝে থাকলে নেগেটিভ ভাবনা আসতে বাধ্য। আর ঠিক তখনই কাঁধের কাছে কারোর গরম নিঃশ্বাস টের পাই।
কে?
কোনও চোর-টোর নয় তো?
ঘাড় ঘোরাতেই টলে গেছিল গোটা শরীরটা। হাত-পায়ের পাতা ভিজে উঠেছিল ভয়ে। দমকা জলো হাওয়ায় অচেনা স্থলভূমিতে হাতে ধরা মিইয়ে যাওয়া আলোয় সেই সময় মনে হয়েছিল কোনও মানুষ নয়। আমার থেকে ঠিক দশ হাত মত দূরে দাঁড়িয়ে আছে কোনও মানুষরূপী প্রাণী। যার শরীর থেকে ভেসে আসছে উৎকট একটা গন্ধ, আর ঘুটঘুটে অন্ধকারে আগুনের মতো জ্বলছে চোখের কোটর দুটো।
সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৮, সোমবার
কুকুরটা থামছিলই না। আরও দ্বিগুণ শব্দে কাঁদছিল। মনে হচ্ছিল ও আমাকেই আক্রমণ করে বসবে। ভাবতে ভাবতেই আঙুলে সাংঘাতিক ছেঁকা খাই।
আরে! কোথায় কে? কেউ তো নেই! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী আমার চোখ লেগে গেছিল? তাই বা কী করে হয়?
এতক্ষণ কী দেখলাম? কাকে দেখলাম? ওটা স্বপ্ন ছিল?
সিগারেটটা ঝোপের মধ্যে ফেলে ভাল করে দেখার চেষ্টা করি। তেমন কিছু দেখতে না পেলেও একটা অন্যরকম… মনে হয়, কিছু একটা অন্যরকম আমার চারপাশে ঘিরে। অস্বস্তি হয়। ঠিক কী? মাথাটা তালগোল পেকে যাচ্ছিল। মোবাইলে দেখি রাত অনেকটাই বেড়েছে, বারোটা। শিবিরের ওদিক থেকে হাল্কা কথাবার্তা ভেসে আসছিল।
কিছু কী হয়েছে? সঞ্জয়ের গলাও পাচ্ছি…
এগোতে যাব, সেই উগ্র ঝাঁঝালো গন্ধটা চারদিক থেকে এসে আমাকে ঘিরে ধরে। খালি পেটে গা গুলিয়ে উঠছিল। কী দুর্গন্ধ, কী দুর্গন্ধ! মনে হচ্ছিল, পেটের নাড়ি-ভুঁড়ি আরেকটু হলেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে। মাথার মধ্যেটা কেমন করে উঠেছিল। নিজের ব্যালেন্স রাখতে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করি। হোঁচট খেয়ে পড়ি খোয়া ওঠা ভাঙা রাস্তায়। সজোরে ডান হাতটা গিয়ে পড়ে ভেজা কোনও জিনিসের ওপর। মোবাইলের টর্চটা ছিটকে গড়িয়ে যায়। ওটাকে তুলতেই দেখি, আমার ঠিক পায়ের কাছে রাখা একটা কলাপাতা। আর তাতে সামান্য কিছু লাল চালের আঠালো ভাত, সঙ্গে কী একটা ভাজা। আরে! এই খাবারটা এখানে… এমনভাবে রাখা যেন আমার জন্যই কেউ যত্ন করে দিয়ে গেছে। অল্প অল্প ধোঁয়াও বেরোচ্ছে ভাত থেকে। এখানে তো কেউ রান্না করেনি। তবে? শিবিরের গুঞ্জনটা বাড়ছিল। কী যেন হয়েছে। কীসের যেন উত্তেজনা।
কেউ কাঁদছে কি?
আমাকে ওদিকে যেতে হবে।
যা কোনওদিন করিনি তাই করি। যেতে গিয়েই থমকে দাঁড়াই। হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়ানোর আগে আমার পাশে পরে থাকা খাবারটা তুলে নিই। হাল্কা ভাতের গন্ধে নাক ছোঁওয়া পচা গন্ধটা কম হয়ে আসে। মনে মনে বেশ একটু আরামও বোধ করি।
সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৮, মঙ্গলবার
“ওই তো, ওই তো… ‘সাদ্যা’র ভোগ দেখেছো? ওকে ভগবান প্রসাদ দিয়েছে। কেউ মানতে চাইছে না। আমি জানি… আমি জানি…, অনুজ আসবে…. তিনি ওকে আনবেন ঠিক। তিনি কখনও মুখ ফেরাতে পারবেন না।”
বৃদ্ধ চিৎকার করছিল। লোকজন সরিয়ে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল। শুনেছিলাম, বৃদ্ধ হঠাৎ করে শুয়ে থাকতে থাকতে উঠে বসে বলতে শুরু করে, তাঁর ছেলে আসবে। তাঁর ছেলেকে পৌঁছে দিতে আসছে…
বৃদ্ধর অসংলগ্নতা স্বাভাবিক, কিন্তু আমার হাতের কলাপাতায় ধরা খাবারটা দেখে এক প্রৌঢ় জিজ্ঞেস করে, “বাবা তুমি এই খাবার পেলে কোথায়? এ যে আমাদের ভগবানের ভোগ ‘সাদ্যা’ (ওনামের পূজ্য দেবতার মহাভোগ)! এখানে তো আমরা পুজো করতে পারিনি।”
আমি সবিস্তারে সবটা বলাতেই শিবির জুড়ে নেমে এসেছিল নিস্তব্ধতা। কেন জানি না, সবাই নিজেদের কথা থামিয়ে চরম বিস্ময়ে তাকিয়েছিল আমার দিকে।
সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৮, বুধবার
মানুষের হৃদয়ের রুদ্ধ আবেগ কোনও না কোনও উপায়ে আনন্দ প্রকাশের পথ করে নেয়। তার চারদিন পরের সূর্য ত্রাণশিবিরে তেমনই উচ্ছাস নিয়ে এসেছিল। টানা ১৫-২০ দিন তুমুল বৃষ্টির পর আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছিল। কোথাও কোথাও থেকে জল কমারও খবর পাচ্ছিলাম।
কিন্তু আমার মনের অন্ধকার?
সেও হয়তো আবছা আলোর রেখাপাত ঘটিয়ে একটা গল্প শুনিয়েছিল, “সে আসে। আজও সে আসে। যখনই প্রজাদের কষ্ট তাঁর কান অবধি পৌঁছায়, যখনই তাঁর মাতৃভূমির অসহায়তা দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ে, হ্যাঁ ঠিক তখনই। হতে পারে এগুলো হাস্যকর। হতে পারে নেহাতই গল্পকথা, তবু আমি এগুলো শুনেছিলাম অন্তর থেকে। হয়তো বা কিছুটা অনুভব থেকেও।
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, পুরাকালে বর্তমান কেরলে রাজত্ব করতেন অসুররাজ বলি। তিনি ছিলেন প্রজাবৎসল ও দানবীর। তাঁর শক্তি ও তেজে দেবতারা সর্বদা তটস্থ থাকতেন। বলিকে দমন করার জন্য বিষ্ণু স্বয়ং বামন অবতারের রূপে কেরল আসেন। বলিরাজার ছিল দানের দুর্বলতা। কোনও সাহায্যপ্রার্থীকে ফেরাতেন না। সুযোগ নেন বিষ্ণু। বলি যজ্ঞ করছিলেন। এইসময় বামনবেশী বিষ্ণু প্রার্থী হয়ে হাজির হন। বামনের দাবি, বসবাসের জন্য মাত্র ত্রিপাদ ভূমি। বলীরাজ সম্মতি হলেই বামন এক পদ ভূমিতে ঢেকে ফেললেন সসাগরা পৃথিবী। দ্বিতীয় পদে স্বর্গ ও পাতাললোক। তৃতীয়পদ ভূমি প্রার্থনায় সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন বলির দিকে। সুকৃতিবলে মহাবলী ততক্ষণে বুঝেছেন বিষ্ণুর লীলা, কিন্তু পিছু হাঁটার পাত্র তিনি নন। তাঁর কাছে বীরের মরণও শ্রেয়। শেষে বামনের উদ্যত পায়ের নীচে বলীরাজ অবনত মস্তকে প্রবেশ করলেন রসাতলে। মৃত্যুর আগে বলীরাজ বামনরূপী বিষ্ণুকে বলেছিলেন, “প্রজারা আমার সন্তান। ওদের না দেখে আমি থাকতে পারব না। বছরে একদিন কেউ যদি তার কষ্টের কথা জানিয়ে আমাকে ডাকে, হে দেব! আমি বারেবারে ফিরে আসব।”
বিষ্ণু তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন কিনা আমার জানা নেই। জানা নেই ‘ওনাম’ উৎসবে সত্যি কেউ তাঁদের আরাধ্য রাজাকে মনেপ্রাণে ডাকলে তিনি আসেন কিনা! জানা নেই বৃদ্ধ রামচন্দ্রণ তার প্রিয় পুত্র অনুজকে ফিরে পেয়েছিল কিনা।
তবে এটা জানি, কলকাতায় ফিরেও আমি একমুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি সেই অন্ধকারের স্বপ্নময়তায় দেখা মানুষ মানুষ চেহারার অদ্ভুত দর্শন প্রাণীকে। ভুলতে পারিনি জ্বলন্ত সেই চোখরূপ আগুনকে…
ভুলতে পারিনি আচমকা হাতে পেয়ে যাওয়া ধোঁয়া ওঠা খাবারকেও…
ভুলতে পারিনি সেই উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধকেও…
আজও চোখের সামনে সব… সবটা ভেসে ওঠে…
এটাকে কী বলব?
কোথায় পাব এর উত্তর?
আপনারা জানেন কি?