জয়িতা সেনগুপ্ত|
“যাহ্! এই বাসটাও চলে গেল!”
হতাশ ভঙ্গিতে পা ফেলে একটা ঝাঁপ নামানো দোকানের বাইরে ভাঙা বেঞ্চিতে বসে পড়ল সায়ন। এই নিয়ে পরপর দুটো বাস মিস করল সে। সামনের সপ্তাহ থেকে ক্লাস টুয়েলভের টেস্ট পরীক্ষা শুরু, তাই কিছু লাস্ট মিনিট সাজেশনের আশায় ক্লাসের সেকেন্ড বয় রাহুলের বাড়ি এসেছিল সে; কিন্তু রাহুল কয়েকটা কেজো কথা বলে,পড়ার অজুহাতে বিদায় করে দিয়েছে তাকে। আসলে, রাহুল ছেলেটা খুব স্বার্থপর আর অহংকারী। ওর মেলামেশার গণ্ডিটাও ক্লাসের প্রথম দশজন ছাত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে ফাষ্ট বয় অর্ককে বিশেষ পছন্দ করে না রাহুল। সেটা অর্ক ফাষ্ট বয় বলে নাকি রাহুল ফাষ্ট বয় নয় বলে, তা স্পষ্ট না বুঝলেও এটুকু সায়ন বোঝে যে রাহুলের চেয়ে অর্ক অনেক বেশি মেধাবী। রাহুলের অনেক প্রাইভেট টিউটর আছে। অন্যদিকে অর্কদের বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ ভাল নয়, তার একজন মাত্র টিউটর; তাও অঙ্কের। বাকি বিষয়গুলো সে স্কুল থেকেই বুঝে নেয়। তাও প্রত্যেক বছর রাহুলের চেয়ে অন্তত কুড়ি নম্বর বেশি পেয়ে ফাষ্ট হয় অর্ক। ছেলেটাও খুব হাসিখুশী। তাই অর্ককে খুব ভাল লাগে সায়নের।
যাই হোক, এক অসম্ভব আশার পিছু ধাওয়া করে আজ শিমুলপুরে রাহুলদের বাড়ি এসে পড়েছিল সায়ন। আশা পূরণ না হলেও আশা করার মোক্ষম মাসুল এখন গুনতে হচ্ছে তাকে। ভগবান জানেন, এ মাসুল গোনার মেয়াদ কতক্ষণ?
ভাবতে ভাবতে চোখে পড়ল, বাস আসছে। সামনে এসে দাঁড়াতেই তাতে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল সায়ন। ধুলো উড়িয়ে ছুটতে লাগল বাস।সায়নের মাথায় একরাশ চিন্তা। কী হবে, কে জানে!
২
রাত আটটা। বইয়ের পাতাতে চোখজোড়া গেঁথে রাখলেও কিছুতেই তাতে মনঃসংযোগ করতে পারছিল না সায়ন। অন্যমনস্ক ভাবে পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ ফোনটা বিপবিপ করে জানান দিল, মেসেজ এসেছে। মেসেজটা খুলতেই দেখল, অপরিচিত নম্বর থেকে লেখা, “মেলটা চেক কর। অর্ক।”
মেসেজটা পড়ে খানিক হকচকিয়ে গেল সায়ন। অর্কর তো নিজস্ব ফোন নেই! তাহলে কি অন্য কারুর নম্বর থেকে পাঠিয়েছে? তড়িঘড়ি নম্বরটায় ডায়াল করল সায়ন, কিন্তু সেটা সুইচড অফ।
যাই হোক, আপাতত অর্ক যেটা বলছে সেটাই করা যাক…
কম্পিউটার অন করে মেলবক্সটা খুলল সায়ন। সারি সারি না পড়া মেল জমে আছে। প্রথম মেলটা খুলতেই দস্তুর মতো চমকে গেল সে। এ যে ইতিহাসের সাজেশান! কিন্তু অর্ক জানল কী করে? সায়ন গতকাল বিকেলে যখন অর্কদের বাড়ি গিয়েছিল, তখন তো অর্ক বাড়ি ছিল না! তাই তো আজ বাধ্য হয়ে তাকে ছুটতে হয়েছিল রাহুলদের বাড়ি। তাহলে কি রাহুলই জানিয়েছে অর্ককে?
নাহ্, রাহুল তেমন ছেলে নয়। তাহলে?
ভাবতে ভাবতে মেল লিস্ট ব্যাক করতেই সায়নের চোখে পড়ল, একই আইডি থেকে আরও ক’টা মেল এসেছে। সবকটা খুলতেই তাজ্জব বনে গেল সে। একেকটাতে একেকটা বিষয়ের সাজেশান রয়েছে। চমকটা অচিরেই সামলে নিয়ে প্রত্যেকটা সাজেশনের প্রিন্ট নিয়ে নিল সায়ন।
৩
“অ্যাই চল, এবার দেরি হয়ে যাবে!”
ছেলেকে তাড়া দিলেন বাবা। সায়নের হাত-পা যেন আজ আর চলতে চাইছে না। তাও,যতটা সম্ভব দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।
আজ থেকে টেস্ট পরীক্ষা শুরু সায়নদের। পরীক্ষা নিয়ে প্রবল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সে কোনওদিনই নয়, কিন্তু তাও একটা অদ্ভুত অনিশ্চয়তা আজ আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরছে মনকে। সাজেশানগুলো পাওয়ার পরদিনই অর্কর বাড়িতে গিয়েও দরজায় তালা দেখে আবার ফিরে এসেছিল সায়ন। সেই থেকেই মনটা খুঁতখুঁত করছে। ঠিক করেছে আজই স্কুলে গিয়ে অর্ককে ধরবে।
স্কুলে পৌঁছে নিজের ক্লাসে ঢুকেই চারপাশে একবার চোখ বোলালো সায়ন। অর্ক এখনও আসেনি। একটু অবাক লাগল তার। অর্কর বাড়ি তো স্কুলের সবচেয়ে কাছে। তাছাড়া ওকে একটা ধন্যবাদ জানানো দরকার। শেষ মুহূর্তে সাজেশানগুলো না পেলে সত্যি খুব বিপদে পড়তে হত সায়নকে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বইয়ে চোখ বুলাতে লাগল সায়ন। কিছুক্ষণ পর ক্লাসে ঢুকল রাহুল। তাকে কেমন অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। সন্ত্রস্ত চোখে তাকাচ্ছে আশেপাশে। কথাও বলছে না বিশেষ। স্যার ঢুকতেই সবাই খাতা পেন গুছিয়ে বসে পড়ল নিজের নিজের জায়গায়। সায়ন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, অর্ক তখনও আসেনি। স্যার খাতা দেওয়ার সময় একবার খালি ডেস্কটা দেখলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। যত্ন করে খাতায় মার্জিন টানতে লাগল সায়ন।
আজ বাংলা পরীক্ষা। প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে মনটা খুশিতে ভরে উঠল সায়নের। সবগুলো তার জানা। এবার শুধু লেখা শুরু করার অপেক্ষা, কিন্তু লেখা শুরু করতেই হঠাৎ কি যেন হয়ে গেল । নিজের নাম, রোল লেখার পরই পেন সহ সায়নের ডান হাতের আঙুলগুলো যেন চলে গেল অন্য কারোর নিয়ন্ত্রণে। সে উপলব্ধি করল,যা যা লিখছে তা তার সম্পূর্ণ অজানা। এমনকি যে প্রশ্নগুলো সে লিখবে বলে ঠিক করেছিল, বেশ কিছু ক্ষেত্রে লিখছে অন্যগুলো। নিজের পড়া উত্তরগুলো কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে। অন্য কেউ অশরীরে তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে নিজের পছন্দের উত্তর।
গলা শুকিয়ে গেছে সায়নের। নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। একটু জল খেলে ভাল হতো। যেই না মনে করা, সামনে রাখা জলের বোতলটা তুলে নিলো হাত। হ্যাঁ, হাত। কারণ হাতের উপর এই মুহূর্তে সায়নের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। উল্টে সেটাই নিয়ন্ত্রণ করছে সায়নকে। খানিকটা জল খেয়ে, বোতল বন্ধ করে স্বস্থানে রেখে ফের শুরু হয়ে গেল লেখা। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে সায়নের নিজের হাত তার নিয়ন্ত্রণে ফিরল। এভাবে ঝড়ের মতো লেখার অভ্যাস তার নেই, কারণ যতো ভালই প্রস্তুতি হোক পরীক্ষার খাতায় লেখার সময় কেমন খেই হারিয়ে ফেলে সে। যদিও আজ তেমন কিছুই হয়নি কারণ, বস্তুত আজ সায়ন নিজে কিছুই লেখেনি। সবাই রিভিসান করছে। ওর সে সবের বালাই নেই। চুপচাপ পেন বন্ধ করে বসে রইল সায়ন।
পরীক্ষা শেষে বেরিয়ে আসতে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন হল?”
সায়নের মুখ ফস্কে জবাব এল, “ভাল।”
ছেলের আত্মবিশ্বাসে খুশি হলেন বাবা। বাড়ি ফেরার পথে সায়নের মনে পড়ল অর্কর কথা। ছেলেটা পরীক্ষা দিল না কেন?
৪
আজ পরীক্ষার শেষ দিন। প্রথম দিনের পর থেকে সায়ন একাই যাতায়াত করেছে এবং প্রতিদিনই তার হাত তাকে দিয়ে উত্তর লিখিয়ে নিয়েছে, কিন্তু প্রথম দিনের ভয়টা বাকি দিনগুলোতে আর গ্রাস করেনি। সেদিন ফেরার পর বাবা-মাকে কিছু জানায়নি সায়ন। ঠিক করেছে পরীক্ষা শেষ হলে জানাবে। ফাঁক তালে যদি ক’টা ভাল উত্তর লিখে নেওয়া যায়, মন্দ কী? কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ক্লাসের ফাষ্ট বয় অর্ক এবার পরীক্ষা দেয়নি।
আজ অঙ্ক পরীক্ষা। পরীক্ষা শুরু হতেই হাত যথারীতি সায়নকে দিয়ে সব কটা অঙ্ক করিয়ে নিয়েছে। তবে আসল ঘটনাটা ঘটল খাতা জমা দেওয়ার পর।
স্যার জমা নেওয়া উত্তরপত্রগুলো গোছাচ্ছিলেন। আর ছেলেরা অপেক্ষা করছিল স্যার বেরলেই ক্লাস থেকে বেরোবে বলে। হঠাৎ বাইরে থেকে একটা হইচইয়ের আওয়াজ শুনে ছাত্রদের মৃদু ধমক দেবেন বলে ক্লাসের দরজাটা খুলতেই স্যারের চোখে পড়ল, একটা বড়সড় জটলা, তাঁর ক্লাসের দিকেই এগিয়ে আসছে এবং দলটির অন্তভাগে রয়েছেন হেডস্যার সহ একদল পুলিশও। ক্লাসের সামনে এসে একজন অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, “রাহুল দত্ত এই ক্লাসে পড়ে?”
স্যার জবাব দিলেন, “হ্যাঁ!”
– “ওকে একটু ডাকুন প্লিজ!”
– “কী ব্যাপার অফিসার, কী হয়েছে?” চিন্তিত স্বরে জানতে চাইলেন স্যার।
– “এই ক্লাসে অর্ক মিত্র বলে কেউ পড়ে?”, পাল্টা প্রশ্ন করলেন অফিসার।
– “হ্যাঁ! ও তো ক্লাসের ফাষ্ট বয়!”
– “পরীক্ষা দিচ্ছে এবার?”
– “না, দিচ্ছে না।”
– “কেন?”
– “সেটা তো আমরাও ঠিক বুঝতে পারছি না!”
– “রাহুলকে ডাকুন!” এবার কড়া গলায় আদেশ করলেন অফিসার।
স্যার ক্লাসে ঢুকে রাহুলকে ডাকলেন। রাহুলের পিছুপিছু বেরিয়ে এল সবাই। অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, “অ্যাই, অর্ক কোথায়?”
“আ আ.. আমি কি জানি.. আআ.. আমি ওর বাড়ি চিনি না.. আ আমি জানি না..” হঠাৎ তোতলাতে লাগল রাহুল।
সায়নের অবাক লাগল। অর্কর খবর রাহুল জানবে কী করে? তার মনের কথাটাই জিজ্ঞাসা করলেন স্যার, “অফিসার, অর্কর কথা ও জানবে কী করে? আর কী-ই বা জানবে? অর্কর কি কিছু হয়েছে?”
– “সেটা ও-ই বলবে।” কঠিন গলায় জবাব দিলেন অফিসার।
– “রাহুলের বিরুদ্ধে কি কেউ কোনও অভিযোগ এনেছে? ও কিন্তু খুব ভাল ছাত্র!”
– “ভাল ছাত্র হলেই ভাল ছেলে হবে তার কোনও মানে আছে কি?” তির্যক স্বরে প্রশ্ন করলেন অফিসার।
– “না, তা নয়।” কিঞ্চিৎ থতমত খেলেন স্যার, জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু ওর বিরুদ্ধে অভিযোগটা কী? কী করেছে ও?”
– “রাহুল অর্ককে খুন করেছে!”
৫
আজ সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে। ঝাঁকেঝাঁকে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তাঘাটেও বিক্ষিপ্তভাবে জমে আছে জল। আজ সায়নদের রেজাল্ট বেরবে। সকাল থেকেই সায়নের মনটা ভার হয়ে আছে। সে জানে, আজ সে যা পেতে চলেছে তা প্রকৃতপক্ষে অন্য কারোর প্রাপ্য, কিন্তু তাকে অপ্রত্যাশিতভাবে এটা পাইয়ে দেওয়ার কারণটা এখন অজানা সায়নের। হয়তো কোনওদিনও জানা যাবে না কারণ, উত্তরদাতা আজ আর বেঁচে নেই।
সেদিন পুলিশের জেরার মুখে রাহুল নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছিল। যেটুকু জানা গেছে, যেদিন সায়ন অর্কর বাড়ি সাজেশন আনতে গিয়েছিল, সেদিন দুপুরেই রাহুল অর্ককে একটা নির্জন জায়গায় ডেকে পাঠিয়ে, ওই একই সাজেশন চেয়েছিল অর্কর থেকে। আসলে, প্রত্যেকবার অর্কর ফার্স্ট হওয়াটা কিছুতেই মন থেকে মানতে পারত না রাহুল। হিংসা জমতে জমতে পরিনত হয়েছিল রাগে। ফলে, অর্ক রাহুলকে সাজেশনগুলো দিতে না চাওয়ায়,শুরু হয় হাতাহাতি। আর,ধস্তাধস্তির সময়ই অর্কর তলপেটে আচমকা বেমক্কা ঘুঁষি মেরে বসে রাহুল। মেরে ফেলার উদ্দেশ্য না থাকলেও ঘটনা সেদিকেই গড়ানোর দরুন রাহুল ভয়ের চোটে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মারামারি সময় পকেট থেকে পড়ে যায় মোবাইলটা এবং পালানোর সময় সেটা সেখানেই ভুলে ফেলে এসেছিল সে।
সায়ন জেনে অবাক হয়ে গিয়েছিল, যে মোবাইল নম্বর থেকে সায়নের কাছে মেল চেক করার মেসেজ এসেছিল সেটাই নাকি রাহুলের নম্বর। পুলিসও সেই সূত্র ধরেই অনুসন্ধান চালিয়ে চিহ্নিত করতে পেরেছে খুনিকে।
অর্কর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হওয়ার পর তাদের বাড়ির সামনে ভেঙে পড়েছিল স্কুল, কিন্তু সায়ন যায়নি। অর্কর সেই হাসিখুশি উজ্জল রূপটাই মনে রাখতে চায় সে।
এরই মধ্যে আর একটা দূর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে। পুলিস অ্যারেস্ট করার দিন মাঝরাত থেকেই অসংলগ্ন আচরন করতে শুরু করে রাহুল। বর্তমানে সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে ভর্তি আছে মানসিক হাসপাতালে। থানা থেকেই সেখানে পাঠানো হয়েছে তাকে। একদল শিক্ষকের মতে, পাপের ফল। অন্যদলের মতে, দুটো ভাল ছাত্রের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে গেল। কয়েকদিন স্কুলের পরিবেশ থমথমে ছিল। এখন আবার সব কিছু সমে ফিরছে।
প্রত্যেকবারের মতো মায়ের সঙ্গে রেজাল্ট আনতে যাচ্ছিল সায়ন। যদিও ফলাফল তার জানা, কিন্তু এ সাফল্যের প্রকৃত দাবিদার সে নয়। অন্য কেউ নিজের সাফল্য তার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেছে মাত্র। নিজের দীর্ঘ পরিশ্রম অধ্যাবসায় ফুটিয়ে তুলেছে তার মধ্যে দিয়ে। এই জয় তারই প্রাপ্য। মনে মনে অর্ককে বেস্ট অফ লাক জানাল সায়ন।
কমেন্টস
ফাটাফাটি 👍🏻👍🏻👍🏻👍🏻
Very very nice