ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়।

হাতে আর একদিন, তারপরই আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এমনই এক নারী দিবসকে উপলক্ষ্য করে মুক্তি পেয়েছিল শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা রায় প্রযোজিত ছবি ‘মুখার্জ্জী দা’র বউ’। আর এবারের নারী দিবসে তাঁদের হাত ধরেই নবাগত পরিচালক অরিত্র মুখোপাধ্যায় উপহার দিলেন ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’। আজ ২০২০ সালে এসে দাঁড়িয়েও শবরীমালা মন্দিরে মেয়েদের প্রবেশ বা পাবলিক প্লেসে ব্রেস্ট ফিডিং-এর মতো বিষয়গুলি বাড়ির মা-জেঠিমাদের কাছে একটা চর্চার বিষয়, সেখানে মেয়েদের ‘পিরিয়ড শেমিং’ তো একটা স্বাভাবিক বিষয় বলেই মনে হয়! তা নয় কি? মাসের ওই ক’টা দিন ঠাকুর ঘরে ঢোকা এমনকি রান্নাঘরে ঢোকা, বা ঠাকুরকে নিবেদন করা প্রসাদও গ্রহণ করায় নিষেধাজ্ঞা, পাশাপাশি বিয়েতে কন্যাদানের মতো আচার যে আসলে কোথাও গিয়ে মেয়েদের আড়াল করে রাখার একটা পন্থা- সেই বার্তাই উঠে এসেছে এই ছবির মধ্যে দিয়ে। শুধু তাই নয়, সামাজিক সচেতনতা তৈরির জন্য নাটকের মঞ্চে যখন স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা হয় তখন একজন মহিলাই তা সহ্য করতে পারেন না। আসলে সেইদিক থেকে দেখতে গেলে শাস্ত্র, সমাজ লোকাচারের থেকেও মেয়েরাই মেয়েদের পিছিয়ে রাখাতে উৎসাহ দেয়।

ছবির গল্পের শুরুতেই সংস্কৃতের অধ্যাপিকা শবরীর সঙ্গে বিয়ে হয় বাতাসীপুরের বিক্রমাদিত্যের। নিয়ম মেনে সব আচার পালন করলেও কন্যাদান করা হয়নি শবরীর। যা কোনওভাবেই মেনে নিতে পারেননি শবরীর শাশুড়ি মা, (যিনি আবার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান)। তাই নববধূ বরণের সময় বউমার মুখে জল-মিষ্টি ঠুসে দিয়ে তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, শবরীকে তাঁর বাড়িতে ঢুকতেই দেওয়া উচিত নয়। কারণ তাঁর বিবাহই সম্পন্ন হয়নি। প্রথম প্রথম চুপ করে থাকলেও পরে শবরী বুঝিয়ে দেন যে, বিবাহ কথার অর্থ হল বিশেষভাবে বহন করা। তবে আজকাল অবশ্য স্বামী তাঁর স্ত্রী-কে বহন করেন না। বরং তাঁরা একে অপরকে সঙ্গে নিয়ে চলেন আজীবন। আর সবথেকে বড় কথা হল, গো এবং কন্যাই যে কেবল সম্প্রদানযোগ্য- এবিষয়ে মত বদলাতেই চলতে থাকে শবরীর লড়াই। চুরি-ডাকাতি নয়, সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করে, শুদ্ধ মন্ত্র উচ্চারণ করে একটি মেয়ে যদি পৌরোহিত্যের ভার গ্রহণ করে, তাহলে কীসের এত সমস্যা?- এ প্রশ্নই বারবার ঘুরে-ফিরে এসেছে এই ছবিতে।

ছবিতে গোঁড়া ব্রাহ্মণের চরিত্রে অভিনয় করেছেন শুভাশিষ মুখোপাধ্যায়। আর আমি হলফ করে বলতে পারি তাঁকে ছাড়া এই চরিত্রে আর কাউকে মানাতো না। আর শবরীর চরিত্রে ঋতাভরিও অসাধারণ। আদ্যোপান্ত সাবেকি সাজপোশাকে, ভঙ্গিমায় তাঁকে মানিয়েছেও চমতকার। তবে বলিউডের পাশাপাশি বাংলা ছবিও যে একজন প্রমিসিং অভিনেতা পেতে চলেছেন তা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন সোহম মজুমদার। এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে মানসী সিনহা, সোমা চক্রবর্তী, অম্বরিশ ভট্টাচার্য-এর অভিনয়ও খুব ভাল। ছবির সম্পাদনায় বেশ কিছু গলদ থাকলেও তা চোখ এড়িয়ে যায় ছবির গল্পের কারণেই। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা সে নেতা-মন্ত্রী, সেনা, মহাকাশচারী- এসকলক্ষেত্রে মহিলাদের বিচরণ পর্দায় তুলে ধরা হলেও মহিলা পুরোহিত নিয়ে ছবি এই প্রথম।

সত্যি করে হাতে সময় নিয়ে একবার ভেবে দেখবেন, যে দেবীর পুজো আপনি করেন, তিনিও কিন্তু কন্যা, তিনিও ঋতুমতী হন। ধুমধাম করে পালিত হয় অম্বুবাচীর পুজোপাঠ। কিন্তু রক্ত-মাংসের নারী যদি সেই একই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যান, তাহলে তার ক্ষেত্রে এমন গণ্ডি কি আদৌ যুক্তিযুক্ত। গোটা ছবি জুড়ে চলতে থাকা এক ধর্মীয়-গোঁড়ামি এবং আধুনিক মনোস্কতার মধ্যেকার সংঘাত শেষ হয় এক পর্যায়ে, যা দেখার জন্য অবশ্যই একবার হলেও ছবিটা দেখতে হবে। তবে সবশেষে একটা কথা বলতেই হয়, শুচি-অশুচি কিন্তু তথাকথিত ‘মেয়েছেলে’র শরীরে নয়, লুকিয়ে থাকে মানুষের মনের কোনও এক অন্ধকার কোটরে, যেখানে একটিবার হলেও আলো ঢোকা দরকার।