ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়।
বিষয়টা ‘ইয়ে’ নয় ‘গে’, আর এটা জীবনের কোনও সিদ্ধান্ত নয় যে তা পূর্বপরিকল্পিত হতে হবে, কেউ কখনও ঠিক করে না যে সে জীবনে গে হবে কি না…-এই বার্তাই রয়েছে আয়ুস্মান খুরানা এবং জিতেন্দ্র কুমার অভিনীত ছবি ‘শুভ মঙ্গল জাদা সাবধান’-এ। সত্যি বলতে, সমাজের কাছে যেগুলি ট্যাবু বা যেসব বিষয়গুলি মানুষ আড়াল করা পছন্দ করে, সেইসব বিষয় দর্শককের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সবচেয়ে ভাল মাধ্যম হল ‘হাস্যরস’। হাসতে হাসতে কিন্তু কঠিন থেকে কঠিন সত্যও খুব সহজে বলে দেওয়া যায়। আর সেই ফর্মুলাই এই ছবিতে ব্যবহার করেছেন পরিচালক হিতেশ কেওয়াল্যাল।
ছবির শুরুতেই পর্দাজুড়ে প্রতিভাত কার্তিক(আয়ুস্মান)-অমন(জিতেন্দ্র)-এর প্রেম। প্রথমেই দর্শকদের আভাস দিয়ে দেওয়া হয় যে, তাদের সম্পর্ক নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে কিছু একটা জট পাকতে চলেছে। তবে কার্তিকের পরিবারের কাউকেই ছবিতে দেখানো হয়নি। ছবির গল্প আবর্তিত হয় অমনের পরিবারকে কেন্দ্র করেই। কার্তিক আর আমান দিল্লিতে একসঙ্গে থাকে। কিন্তু সমস্যা শুরু হয়, তার বাড়ি ফিরে আসার সময় থেকেই। আমানের বিজ্ঞানী বাবা (গজরাজ রাও) এবং ঠোঁটকাটা মা (নীনা গুপ্তা) ছেলে অমনের বিয়ে কুসুমের সঙ্গে দিতে চায়। কিন্তু নিজের ভালবাসার কথা বাবাকে বলতে ভয় পায় অমন। কারণ সে মনে করে বাবার দেওয়া একটা শুক্রাণুর ঋণ তাঁকে মিটিয়ে যেতে হবে আজীবন। তাই ‘হোমোফোবিয়া’য় আক্রান্ত পরিবারের কাছে নিজের মনের কথা খুলে বলার চেষ্টা করলেও তাতে বড় একটা কিছু করে উঠতে পারে না অমন।
ছবিটি যেহেতু একটি পরিবার কেন্দ্রিক তাই ছবির গল্প অনেকটাই প্রসারিত হয়েছে পার্শ্ব চরিত্রগুলির হাত ধরে। সুনীতা রাজওয়ার, মানভী গাগরু, মনু ঋষি নিজেদের চরিত্রে যথাযথ। কিন্তু সত্যি বলতে ছবির অন্যতম ভীত হল এইসব পার্শ্ব চরিত্রগুলির অসাধারণ অভিনয়। তবে কিছু দৃশ্যে সবাই একে অপরের সঙ্গে খানিক বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। কীসের এত ঝগড়াঝাঁটি তা মাঝে মাঝে যেন খেই হারিয়ে ফেলে। ছবিতে আমানের বিজ্ঞানী বাবা শঙ্কর ত্রিপাঠির কালো ফুলকপির উৎপাদন, এরপর ছেলের মন থেকে সমপ্রেমের ভূত তাড়াতে তার শ্রাদ্ধশান্তির কাজ করার মতো বিষয়গুলি রূপকের আঙ্গিকে তুলে ধরা হলেও চিত্রনাট্যের নিরিখে তেমন জোড়ালো নয়। গজরাজ রাও-এর অভিনয়দক্ষতা সম্পর্কে আলাদা করে বলার কিছু নেই, কিন্তু ভদ্রলোকের অভিনয় টানটান হলেও তিনি চিত্রনাট্যের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য ছিলেন, যার ফলে কিছু কিছু দৃশ্য সপ্রতিভ মনে হলেও জোলো হয়ে গিয়েছে বেশ কিছু দৃশ্য। তবে ছেলের বয়ফ্রেন্ডকে অমনভাবে নাচের তালে মারধর করা বা কার্তিকের সঙ্গে সাংকেতিক ভাষায় নাচ করা বা কার্তিক আর অমনকে চুম্বনরত অবস্থায় দেখে বমি করে ফেলার মতো দৃশ্যগুলি বেশ ইউনিক। অন্যদিকে নীনা গুপ্তার অভিনয়ও একইরকম প্রশংসনীয়। এর আগে ‘বধাই হো’ ছবিতে তাঁদের জুটি ভীষণভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। আয়ুস্মানের অভিনীত প্রত্যেকটি ছবিই দর্শকদের কিছু না কিছু বার্তা দেয় তা সমাজ নিয়েই হোক বা মানুষের মধ্যে বাসা বাধা হীনমন্যতা নিয়েই হোক। তবে এই ছবিতে একজন সমকামী চরিত্রে আয়ুস্মানের অভিনয় যথাযথ ও নিয়ন্ত্রিত এবং খুব সাবলীলও বটে। হাঁটা-চলা, শরীরের ভাষা, পোশাক পরিচ্ছদ আর নোজ-রিং সবমিলিয়ে আয়ুস্মান দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ছবি জুড়ে। আর তাকে একইভাবে সাপোর্ট দিয়ে গিয়েছেন জিতেন্দ্র। যথাযথ অভিনয় গুণেই পর্দায় জিতেন্দ্রর উপস্থিতি আলাদাভাবে অনুভব করেছেন দর্শকরা।
পরিচালক হিতেশ কেওয়াল্যাল কোথাও গিয়ে গল্পটা একটু ছড়িয়ে ফেলেছেন বলেই মনে হল। কারণ, ২ ঘণ্টার ছবিতে মূল বিষয়টিতে আসতে প্রায় ১ ঘণ্টার বেশি সময় কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি(তার ওপর মাল্টিপ্লেক্সে ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো-তে যে পরিমাণ বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, তাতে সময়টা প্রায় দ্বীগুণ!)। তবে অমন-কার্তিকের ছোটবেলা নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি, শুধু দেখানো হয় যে, কার্তিক যখন তার বাবাকে নিজের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন সম্পর্কে জানায়, তখন বেধড়ক মার খেতে হয়েছিল তাকে। গল্পের বুনট আর একটু টানটান হতে পারতো। তবে সমপ্রেম নিয়ে মানুষের মানসিকতা যে খানিকটা হলেও বদলাচ্ছে। বহু ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে ভালবাসাই যে জয়ী হচ্ছে সেই বার্তা খুবই ইতিবাচক। তাই যুক্তি-তক্কো পকেটে রেখে নির্ভেজাল মজা নিতে দেখে আসুন শুভ মঙ্গল জাদা সাবধান।