ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়।

পারিবারিক গল্প বলা উচিত নাকি থ্রিলার- সেই নিয়ে একপ্রকার ধন্দে ফেলে দিল ইন্দ্রাশিষ আচার্য পরিচালিত, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত বাংলাা ছবি ‘পার্সেল’। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন ঋতুপর্ণা ওরফে নন্দিনী রায়। স্বামী সৌভিক পেশায় একজন ডাক্তার। নন্দিনীর জন্মদিনের সন্ধেবেলায় ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আচমকাই আসে একটা পার্সেল। এই শুরু, তারপর থেকে কখনও কুরিয়ার মারফত বা কখনও বাড়ির সামনেই কেউ রেখে দিয়ে যাচ্ছে একটা করে পার্সেল। কে পাঠাচ্ছে, কোথা থেকে পাঠাচ্ছে কিছুই লেখা নেই। কিন্তু সব পার্সেলে থাকা উপহারগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে নন্দিনীর অতীতজীবনের কিছু প্রতিচ্ছবি।যেগুলো সম্পর্কে প্রথম থেকেই ধন্দে দর্শকরা।

দিনের পর দিন এভাবে একের পর এক পার্সেল আসার ফলে একপ্রকার বিরক্ত নন্দিনীর স্বামী সৌভিক। উপহারগুলি থেকে বোঝা যাবে কেউ যেন ফলো করছে নন্দিনীকে। তবুও স্ত্রীকে অযথা অতিরিক্ত না ভাবারই পরামর্শ দেয় সৌভিক। কিন্তু নন্দিনীর মনে প্রশ্ন জাগে, এসবের জন্য কি তবে সৌভিক তাকে সন্দেহ করে! যদিও এই পার্সেলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কিছু অতীতের সঙ্গে যুক্ত নিজের দুই বন্ধু সুব্রত এবং অরুন্ধতীকে সন্দেহ করে সে। অরুন্ধতীর জীবনেও রয়েছে ক্রাইসিস। তবে সেই তুলনায় সুব্রত তেমন একটা স্পেস দেওয়া হয়নি ছবিতে। পার্সেল নিয়ে রহস্যের সমাধান হবে হবে- এমন সময় আরও একটা পার্সেল- মাঝে মাঝেই বড্ড বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছিল দর্শকের! তাঁদের বিস্ময় থেকেই সেকথা স্পষ্ট।

মাঝে মাঝে ছবিটি দেখতে দেখতে আপনার মনে হবে এটা রহস্য গল্প নয় বরং এখানে সম্পর্কের টানাপোড়েনটাই বেশি। কিন্তু কোনও রহস্যজনক কারণেই সেই সম্পর্কগুলোর ওপরে কালো মেঘ জমেছে। নন্দিনী যখন স্বামীর পরকীয়া সম্পর্কে একপ্রকার নিশ্চিত, তখন বৈবাহিক জীবন থেকে একপ্রকার ছুটি নিতে চাওয়ার কথাও স্বামীকে জানান নন্দিনী। তবে পিছুটান হয়ে দাঁড়ায় ছোট্ট মেয়ে সাজু। একটা সময়ে নিজের জীবনের জটিলতাগুলোকে কাটিয়ে উঠতে গিয়ে যেন মিছিমিছি অন্যের জীবনের জটিলতা বাড়িয়ে তোলে নন্দিনী। তারপরই চরম হতাশা।

গল্পের বাঁধন ঠিকঠাক। কিন্তু সিনেমাটোগ্রাফিতে যেন কোথাও একটা বড় গলদ থেকে গিয়েছে। কিছু দৃশ্যে ছবি খুবই ভিস্যুয়াল জার্ক তৈরি করে। কোথাও আবার সম্পাদনার গলদ চোখে পড়েছে। ঋতুপর্ণার অভিনয়টা বাড়তি পাওনা। ডি-গ্ল্যাম লুকে বড্ড মানানসই ঋতুপর্ণা। শাশ্বত চ্যাটার্জীর অভিনয় এই সিনেমাতে খুব মানানসই। যেন ওটাই দরকার ছিল। বিরতির আগের অংশটাই দর্শকদের বোর করল অনেকটা। ফলে অনেকেই পরের অংশটুকুর অপেক্ষা না করেই প্রেক্ষাগৃহ থেকে বের হয়ে গেলেন। অথচ বিরতির পরের অংশেই মূল বিষয় লুকিয়ে আছে। পার্সেলে থাকা উপহারের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কোন অজানা ইতিহাস- তা নিয়ে দর্শকদের একটু হিন্ট দিলেও হয়তো অনেকের কাছে ২ ঘণ্টা বসে থাকা সার্থক হত বলেই মনে হচ্ছিল। অভিনেত্রী শ্রীলা মজুমদারকে আর একটু ব্যবহার করলে ভাল লাগতো। নাট্য ব্যক্তিত্ব অদিতি মুন্সি ছোট্ট অভিনয় সমাজের শ্রেণী দ্বন্দ্বকে প্রকট করল। সিনেমার আবহ সংগীতের একটা সুযোগ ছিল ছবির সেই থ্রিল বা রহস্যকে আরও একটু চালিত করার, তবে সেদিক থেকে ব্যর্থ বলাই ভাল।

দর্শক হিসেবে এই সিনেমাটা মানুষের মন কি আদৌ ছুঁতে পারবে? কারণ আম দর্শকরা সিনেমা মানেই বুঝে একটা গল্প। যেখানে শেষ না থাকলেও অন্তত একটা ফাঁকা ক্যানভাস দিয়ে দিতে হয়। অন্তত একটা সূত্র, যেটাকে অনুসরন করে দর্শক নিজেই গল্পের শেষটুকু অনুধাবন করতে পারবে। কিন্তু এখানে সেটাও ছিল অনুপস্থিত।  ফলত প্রেক্ষাগৃহের বাইরে সকলের মধ্যে একটাই গুঞ্জন ‘বিষয়টা ঠিক বোঝা গেল না।’ তবে একাধিক সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে একটি ‘আউট অব দ্য বক্স’ ছবি তৈরি করার যে সাহস পরিচালক দেখিয়েছেন তার জন্য তাঁকে কুর্নিশ।