রানু ভট্টাচার্য|

সিরিয়াল কিলিং কথাটা এখন জলভাতের মতোই সহজলভ্য।  কিন্তু যে সময়ের কথা আজ আমরা আলোচনা করছি, তখন এমন কথা ভাবাও যায় না। তাছাড়া একজন মহিলা একের পর এক খুন করতে পারে একথা সে সময় যেন অনেকটা ‘সোনার পাথরবাটি’র সমান।  কিন্তু তেমনি ঘটনা ঘটিয়েছিলেন এই মহিলা।  যিনি পরবর্তীকালে গ্রেপ্তার হন দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের হাতে।  

ত্রৈলোক্য রাঁড়, এই নামেই পরিচিত ছিলেন বাংলার সর্ব প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার।  পুরো নাম ত্রৈলোক্য তারিনী দেবী।  বর্ধমানের এক ব্রাহ্মণ পরিবারের কন্যা। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ৫০ বছরের এক প্রৌঢ়র সঙ্গে বিবাহ হয় সেই মেয়েটির। বিয়ের ২-৩ বছরের মধ্যেই মারা যান তার স্বামী। বিধবা ত্রৈলোক্য একটি পর পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে আসেন কলকাতার সোনাগাছি বা সোনাগাজি অঞ্চলে। তারপর অনেকদিন বেশ্যাবৃত্তি করে অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারীনি হন ত্রৈলোক্য। 

বেশ্যাবৃত্তির সুত্রেই আলাপ হয় কালিবাবুর সাথে। কালিবাবু তার জীবনে শুধু প্রেমিক হয়েই আসেনি, এসেছিলেন অপরাধ জীবনের সঙ্গী হিসাবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্রৈলোক্যর  যৌবনে ভাঁটা পড়ে, দেখা দেয় অর্থাভাব।  আর তখনই কালীবাবুর যোগসাজশে নানা অপরাধ শুরু করে সে। কিন্তু চরম অপরাধে হাত পাকায় কালীবাবুর ফাঁসির পর।  

কালীবাবুর ফাঁসি হওয়ার পর, ত্রৈলোক্য যেমন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে ঠিক তেমনি আর্থিক ভাবেও সর্বস্ব হারিয়ে প্রায় ভিখিরির দশা হয় তার। আর ঠিক সেই সময়েই তার মাথায় আসে অদ্ভুত আইডিয়া। সোনাগাছির মহিলাদের ভুলিয়ে নিয়ে এসে তাদের সমস্ত গয়না লুঠ করে তাদেরকে পুকুরে ডুবিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করাই ছিল তার পরিকল্পনা।  

ত্রৈলোক্যর প্রথম টার্গেট ছিল কুসুম নাম্নী নামক এক বেশ্যা। গুরুদেবের দর্শন করাবে এবং গুরুর আশীর্বাদে তার সব গয়না দ্বিগুন হয়ে যাবে, কুসুমকে এই লোভ দেখিয়ে নিয়ে এসে পুকুরে ডুবিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করে সে। তার পর গয়না নিয়ে চম্পট দেয়। এভাবে পরপর পাঁচটা খুন করে সে। রাজলক্ষ্মী নামক একটি মেয়েকে খুন করতে গিয়ে তাকে দেখে ফেলে একজন যুবক। তার পরেই ধরা পড়ে যায় ত্রৈলোক্য।  

শেষ পর্যন্ত তার সব অপরাধ স্বীকার করে নেয় সে। বিচারে রাজদণ্ড হয় তার। তবে সে অনুতপ্ত হয়েছিল। বারবার প্রিয়নাথ দারোগার কাছে বলেছে সে কথা। কিন্তু তাতে কি এত বড় অপরাধ কমে যায়? যায় না বোধয়! 

নারীকে আমরা অবলা, মায়ের অন্যরূপ বলেই জেনে এসেছি এতদিন। সেই নারী যে প্রয়োজনে কতটা ভয়ংকর হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই ঘটনা। পুরনো কলকাতার ইতিহাসে এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা সত্যিই বিরল। তাই ত্রৈলোক্য রাঁড় হয়ে উঠেছিল আতঙ্কের অন্য নাম। 

 তথ্যসূত্র : পাহাড়ি মেয়ে, দারোগার দপ্তর – রায়বাহাদুর শ্রী প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

ছবি – পিক্সাবে, গুগল,