আদিত্য গুপ্ত|



পুরোনো সময় জলছাপের মতো লেগে থাকে শহরের বুকে।
ভিড় বাস-ট্রেনের দমবন্ধ অস্বস্তির ভেতর, ফুটপাতের হকারদের ‘এই চল্লিশের মাল কুড়ি’-র চিৎকারের কর্কশতায়, মাল্টিপ্লেক্সের ঝাঁ চকচকে শরীরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা এই যে তরতাজা শহর, এর একদম উল্টোদিকে রয়ে গেছে আর একটা শহর। সেই শহরের মধ্যে রাতের বেলা আচমকা অন্ধকার ফুঁড়ে উঠে দাঁড়ায় কোনও অশরীরী আগন্তুক, বেজে ওঠে কবেকার কোন এক হারিয়ে যাওয়া মায়াবী সুর! এই দুই শহর মিলেই তৈরি হয়েছে আমাদের কলকাতা। যার অর্ধেকটা ঘোর বাস্তব। আর অর্ধেকটা গল্পকথার কুয়াশার মতো ছড়িয়ে আছে এই ‘বাস্তব’ কলকাতারই মধ্যে।

কলকাতার কোথায় ‘ভূত’ নেই? প্রায় সব পুরনো জায়গাকে ঘিরেই অলৌকিকতার আবর্তন। সে গার্স্টিন প্লেস হোক বা ন্যাশনাল লাইব্রেরি। হাল আমলের রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশনকে ঘিরেও কত সব রোমাঞ্চকর গল্প। তা সে সব অনেকেই জানেন। আমরা যখন সেসব গল্প করতেই বসেছি, তখন ঝুলি থেকে অপেক্ষাকৃত না শোনা গল্পই না হয় কিছু বের করা যাক।

চলুন আমরা চলে যাই এক ঝাঁ চকচকে স্থানে। সল্ট লেকের উইপ্রো অফিস। চোখ কপালে তুলবেন না। এই উইপ্রো অফিসকে ঘিরেও ছড়িয়ে আছে গল্পের কুয়াশা।
এক সময় এখানে ছিল জঙ্গল আর জলাভূমি। স্বাভাবিক ভাবেই এই স্থানে নানা রকম খুন-জখম-ধর্ষণের ঘটনা ঘটত। অনেকে আত্মহত্যাও করতে আসতেন এই পাণ্ডব বর্জিত স্থানে এসে। পাশাপাশি রয়েছে এক অন্য গুঞ্জন। এখানে নাকি ছিল কবরখানা! আর তার উপরেই সময়ের পথ পেরিয়ে এসে গজিয়ে উঠেছে গগনচুম্বী অত্যাধুনিক এক বহুতল।
এই ঝকঝকে বহুতলের অন্দরে আজও মিশে রয়েছে কবেকার ফেলে আসা ছায়া-কায়া-মায়ার সব গা শিরশিরে মিথ। খুব নতুন কিছু নয়। যে ভূতুড়ে বাড়ির মতো এই বাড়ি ঘিরেও গুঞ্জন, গভীর রাতে হঠাৎই এন নারীকণ্ঠের তীক্ষ্ণ চিৎকার বাতাসে এসে মেশে! অফিসের চারতলা থেকে নাকি আসে সেই চিৎকার। কিন্তু সেই চিৎকারটা কার তা আজও জানা যায়নি। এখানকার নৈশ প্রহরীরাই জানান এমন অভিজ্ঞতার কথা।

কেউ কেউ জানিয়েছেন রক্তে ভেসে যাওয়া এক অল্পবয়সি মেয়ের কথা। শেষ রাতে তাকে নাকি দেখা যায়। তারপর দিনের আলো ফুটলে সেই মেয়েটিও উধাও। আর রক্তের দাগ? বলাই বাহুল্য সেসবও অদৃশ্য।

তাছাড়া আচমকা কাগজপত্র ওলোটপালট হয়ে যাওয়া কিংবা জিনিসপত্র নিজে থেকেই স্থান পরিবর্তন করার মতো গুঞ্জনও রয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। ভোরের দিকে অফিসে কারা যেন ব্যস্ত হয়ে ওঠে! তারা যেন চলে যেতে চাইছে। কারা তারা? সে খবর কেউ রাখে না। আসলে সবারই জানা। তারা ফিরে যেতে চায় সেই জগতে। তারা এখন যেখানকার বাসিন্দা। এই ধুলোমাটির পৃথিবী যে আর তাদের আসল বাসস্থান হতে পারে না। তাই হয়তো সেখানেই ফিরে যেতে চায়।

এখানকার নৈশকর্মীরা একা একা ওয়াশ রুমে যেতে বা লিফটে উঠতে ভয় পান। তাঁদের মনে হতে থাকে, কেউ বুঝি রয়েছে। যাকে দেখা না গেলেও অনুভব করা যায়।
এমনই সব গল্প। এমনই সব রোমহর্ষক ঘটনার ঘুরপাক কলকাতার এই ঝকঝকে শরীরের ভিতরেও পুঁতে রেখেছে একটা অন্য শহরকে। কলকাতা পৃথিবীর বিখ্যাত শহরগুলির তুলনায় নেহাতই ‘ছোকরা’। তবুও রহস্য কিছু কম নেই এই শহরের আত্মার গভীরে। কবীর সুমন লিখেছিলেন ‘‘তিন শতকের শহর তিন শতকের ধাঁধা।’’ এও তেমনই এক ধাঁধা। রাত বাড়লে এই সব ধাঁধারাও ঘুরপাক খায় শহরের অলিন্দে। আগেই বলেছি, গল্পকথার কুয়াশার মতো তা ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের এই চিরচেনা ‘বাস্তব’ কলকাতারই মধ্যে।

(ঋণ: অশরীরী আতঙ্ক পৃথিবীর রহস্যময় ঠিকানা/ উপমন্যু রায়)