আদিত্য গুপ্ত |
প্ল্যানচেট। একটি ঘরে টেবিলের বিভিন্ন প্রান্তে কতগুলি আলো-অন্ধকারময় মুখ। জ্বেলে রাখা মোমবাতির আলোয় সেই মুখগুলিতে কাঁপা কাঁপা আলোর রেখা। মৃত্যুর ওপারে রাখা জীবনের সন্ধানে উন্মুখ তারা। নিজে কখনও ট্রাই করুন বা না করুন, আপনি নিশ্চয়ই জানেন প্ল্যানচেট ব্যাপারটা কী। কেননা বিস্তর গল্পগাছা ও সিনেমাতে প্ল্যানচেটের দৃশ্য আমরা পেয়েছি।
উনবিংশ শতাব্দী থেকে বাংলার বুকে প্রেতচর্চার এক ধারার সূচনা হয়। ১৮৮০ সালে প্যারীচাঁদ মিত্র, শিশিরকুমার ঘোষ প্রমুখ স্থাপন করেন ‘ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশন অফ স্পিরিচুয়ালিস্টস’। বছর পাঁচেকের মধ্যেই প্রয়াত হন তিনি। কিন্তু ততদিনে প্ল্যানচেট বাঙালির মনে জায়গা করে নিয়েছে।
সেই সময়ের তরুণ এক কবিও সমকালীন প্রেতচর্চার এই ধারা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। কিন্তু সেই সময় নয়, তাঁর মধ্যে প্ল্যানচেটের নেশা ঘন হয় অনেক পরে। তখন তিনি নোবেলজয়ী সত্তর ছুঁই ছুঁই এক বিশ্বকবি। প্রবল খ্যাতিমান। কিন্তু মনের গহীনে একের পর এক প্রিয় মানুষের মৃত্যুতে তৈরি হয়েছে দগ্ধ ক্ষতমুখ। ১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্ল্যানচেট করা শুরু করেন। উদ্দেশ্য চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়া মানুষদের আবারও ক্ষণিকের জন্য পাওয়া। তাঁদের সম্পর্কে সামান্য খোঁজখবর নেওয়া।
কৈশোরে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে প্ল্যানচেটে ডাকার সাক্ষী ছিলেন তিনি। আসলে ঠাকুরবাড়িতে একটা প্রেতলোকচর্চার আবহ ছিল। ১৩০১ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল এক যন্ত্রের বিজ্ঞাপন। সেই যন্ত্র নাকি ভৌতিক! তার সাহায্যে নাকি যোগাযোগ করা যায় পরপারের বাসিন্দাদের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ এর নাম দিয়েছিলেন ‘প্রেতবাণীবহ চক্রযান’। ওই যন্ত্রের সাহায্যেই মাইকেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় রবীন্দ্রনাথের।
পরে কুড়ি-একুশ বছর বয়সেও প্ল্যানচেট করেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেই চক্রের অন্যতম উদ্যোক্তা হেমেন্দ্রনাথের মৃত্যুর ফলে তখনকার মতো যবনিকা পড়ে গিয়েছিল কবির প্রেতলোকচর্চায়।
আগেই বলেছি, তা ফের জেগে ওঠে ১৯২৯ সালে। বন্ধু মোহিতচন্দ্র সেনের সুন্দরী যুবতী কন্যা কবি বুলা হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সেই প্ল্যানচেটের ‘মিডিয়াম’। এই মিডিয়ামদের জীবন খুব আশ্চর্য ও বিষাদবিধুর। বলা হয়, এঁরা স্বল্পায়ু হন। বুলার জীবনেও তার অন্যথা হয়নি। মাত্র ২৭ বছর বয়সেই প্রয়াত হয়েছিলেন তিনি।
১৯২৯ সালের শেষদিকে প্রায় দু’মাস নিয়মিত প্ল্যানচেটে বসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সাদা কাগজে পেন্সিল হাতে বসে থাকা বুলার শরীরে ভিড় করে আসত বিদেহী আত্মারা। রবীন্দ্রনাথ কথা বলতেন তাদের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য একা থাকতেন না। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, নন্দলাল বসু থেকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর— কবির সঙ্গী ছিলেন অনেকেই।
সত্যিই কি প্ল্যানচেটে আত্মা আসে? মৃত্যুর পরেও কি থাকে জীবন? রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘‘জানাটা এতটুকু, না জানাটাই অসীম। সেই এতটুকুর উপর নির্ভর করে চোখ বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া চলে না। তাছাড়া এত লোক দল বেঁধে মিছে কথা বলবে, এ আমি মনে করতে পারিনে।’’
বুলা সম্পর্কে কবির বক্তব্য, ‘‘ও কেন মিছে কথা বলবে? কী লাভ ওর ছলনা করে? এমন সব কথা বলছে যা ওর বিদ্যাবুদ্ধিতে সম্ভব নয়।’’
কারা কারা এসেছেন কবির ডাকে? তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবী, দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ আরও অনেকে। পরিবারের লোকরা ছাড়াও এসেছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতচন্দ্র সেন। এবং এসেছেন সুকুমার রায়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কের কথা সকলেই জানেন। সুকুমারের মৃত্যুশয্যায় রবীন্দ্রনাথ গান শুনিয়েছিলেন। প্ল্যানচেটে সাড়া দিয়ে সুকুমার আবারও গান শুনতে চান কবিগুরুর কাছে।
রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন, ‘‘তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়।’’ সেই গান অবশ্য মাঝপথে থামাতে হয়। তিনি গানের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে সুকুমার জানিয়েছিলেন, ‘‘আমার পৃথিবীর নেশা আজও কাটেনি। তাই পরলোকের সুর আজও মনে লাগে না।’’ ‘‘কেমন আছ’’, কবির এই প্রশ্নে সুকুমার জানান, ‘‘অন্য কথা বলুন।’’
রবীন্দ্রনাথের এই প্রেতলোকচর্চা দীর্ঘদিন চলেনি। ১৯৩০ সালে তিনি ইউরোপে যান। আর ১৯৩১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মারা যান বুলা। ফলে বরাবরের মতো যবনিকা পড়ে যায় কবির প্রেতলোকচর্চায়।
কমেন্টস
Um valo laglo pore..
বেশ আগ্রহের কথা । প্রেতচর্চাটা শুরু করবো ভাবছি। ভালো Refernce পাওয়া যাবে?
Truth Indeed
Darun
বাহ, খুবই ভালো লাগলো পড়ে। কিন্তু, উৎস দিলে আরো ভালো লাগতো।
নাকি, ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ !!
রবীন্দ্রনাথের পরলোক চর্চা পড়ে দেখবেন ভালো লাগবে।
Besh bhalo laglo,e prosonge aro information pele bhalo lagbe
Valo..
পড়ে ভালো লাগলো । এখনকার দিনেও যদি এভাবে মহাপুরুষদের এনে কিছু কথা লিপিবদ্ধ করা যায় । তাহলে মন্দ হয় না ।
Valo laglo aggge jantam na uni erkom korten
It’s true and I believe in the life after death.
বাহ, অসাধারণ!! খুব ভালো লাগলো ।
‘রবীন্দ্রনাথের পরলোক চর্চা’ পড়ে দেখবেন ভালো লাগবে।
Want to hear more. Very interesting.
সেই জন্তরটি এখন কোথায় ? যেটা ব্যবহার করে প্রেত লোকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা হতো।