লেখক – আদিত্য গুপ্ত|


মিছিল নগরী কলকাতা কি ভয়েরও শহর? বিশ্বের বহু বিখ্যাত শহরের কাছে কলকাতা একেবারেই ছোকরা শহর। যদিও এই অল্প বয়সেই তার আলোময় শরীরের ভিতরে সে লুকিয়ে রেখেছে কত সব ছায়াকে। যাদের আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছে ভয়ের গুল্মলতারা। কলকাতার  নামজাদা জায়গাগুলিকে ঘিরে কতই না ভৌতিক ফিসফিস, আবছায়া। তবে সব ছায়া অলৌকিকতার মোড়কে মোড়া নয়। আটের দশকের একেবারে শেষে ১৯৮৯ সালে এই শহরে দেখা দেয় ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ এক নির্মম হত্যাকারী। তার নাম ‘স্টোনম্যান’। এক বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিকই এই নাম দিয়েছিল। তারপর ক্রমে সেই নামই চালু হয়ে গেল।

একটা-দু’টো নয়, ছ’মাসে তেরোটা খুন করেছিল সেই ‘অদৃশ্য’ খুনি! অদৃশ্যই, কেননা কেউ তাকে দেখেনি। কলকাতার পথেঘাটে কত মানুষের বাস। কিন্তু কেউ কোনও খোঁজ দিতে পারেনি স্টোনম্যানের। যেন অন্ধকার কুঁদে নিজের শরীর গড়ে সে ঘুরে বেড়াত শহরের পথেঘাটে। ফলে তার খুনগুলো সত্যি হওয়া সত্ত্বেও সে হয়ে উঠল এক অলীক অস্তিত্ব! একের পর এক মানুষকে পাথর দিয়ে মুখ থেঁতলে খুন করত সে। আর তারপর কী এক মন্তরে হাওয়া হয়ে যেত শহরের ফিনফিনে হাওয়ার ভিতরে। কেউ তার নাগাল পায়নি।

এর আগে ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ বোম্বেতে (তখনও মুম্বই হয়নি) একই ভাবে খুন হয়েছিল! ওই ক’বছরে সে খুন করেছিল বারোটা। তারপর আচমকাই বন্ধ হয়ে গেল হত্যালীলা। পরের বছরই তা শুরু হল কলকাতায়। ফলে প্রশ্ন উঠে গেল, দুই শহরের ঘাতক কি একজনই? আবার এমন কথাও উঠল, এটা কোনও একজনের কাজ নয়। কোনও গোষ্ঠী এই কাজে লিপ্ত।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবারও পাথরে মুখ থেঁতলে খুন করার ঘটনার কথা শোনা গিয়েছিল। তবে এবার মুম্বই বা কলকাতা নয়। গুয়াহাটি। তারপর সেও অন্তর্হিত হয়। ঠিক যেমন মুম্বই বা কলকাতায় হয়েছিল।  
যাই হোক, কলকাতার কথা ফিরি। একটু নিরালাতে ঘুমোতে যেত যারা তারা আচমকাই খুন হয়ে যাচ্ছিল। প্রশ্ন উঠছিল, কেন? পথেঘাটে আশ্রয় নেওয়া অসহায় মানুষগুলোকে কেন এভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে? কার কী স্বার্থ জড়িয়ে থাকতে পারে তাতে? নাকি যে মারছে, সে এক ‘সাইকো’? যার রক্তের মধ্যে বিষিয়ে উঠেছে হত্যার নেশা। হাতের ভারী পাথরে তাই সে থেঁতলে দিচ্ছে অচেনা সব মুখ।
রাত তিনটে থেকে ভোরবেলা। এর মধ্যেই কাজ হাসিল করত স্টোনম্যান। কলকাতায় তার প্রথম শিকার একজন পথবাসী মহিলা। লালবাজারের পুলিশ সদর দফতরের একেবারে গা ঘেঁষে অবস্থিত লালদিঘি এলাকায় থাকতেন তিনি। আচমকাই ৪ জুন খুন হয়ে গেলেন সেই দুর্ভাগ্যবান মহিলাটি।

সেই শুরু। একটার পর একটা খুন হচ্ছিল আর কলকাতার রাত্তিরগুলো হয়ে উঠছিল আতঙ্কের আবাসভূমি।

পুলিশ যে এমন এক কেস পেয়ে হন্যে হয়ে উঠবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? নানা ছানবিন, তদন্ত, সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার— কিন্তু আজও ফয়সলা হয়নি স্টোনম্যানের। যেভাবে আচমকা সে এসেছিল, সেভাবেই যেন ফিরে গেল হাওয়ার ভিতরে!

খুন বন্ধ হওয়ার পর আস্তে আস্তে কাটতে শুরু করল ভয়। কিন্তু এখনও কোনও কোনও পুরনো দিনের গল্পকথায় ভূতের গল্পের পাশে জায়গা করে নেয় কঠোর বাস্তব স্টোনম্যান। তাকে নিয়ে সিনেমা হয়। সে বাস্তবে থাকলেও তাকে ঘিরে জন্ম নিতে থাকে নিত্যনতুন কল্পনা। আর প্রশ্ন ওঠে, কে সে? কোথা থেকে এসেছিল? গেলই বা কোথায়?

তিন দশক পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু স্টোনম্যান একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়নি। কলকাতার শেষ রাতের নির্জন অলিগলির ভিতরে এখনও এক দুঃস্মৃতির মতো পাক খায় সে।