শুভজিৎ দে|
অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার সুপ্ত বাসনা আমাদের সকলেরই আছে, আর এখানেই অনেকের প্রশ্ন, যদি মৃত্যুর পর কি হয় দেখা যেত! না এমন কোনো উপায় এখনও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারেনি। তবে কথায় আছে না বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। ঠিক তেমনই, বিজ্ঞান এমন কোনো উপায় বলাতে না পারলেও, পুরণ তা পেরেছে।
শুধু এ দেশে নয়, পৃথিবীর বহু দেশে বহু সভ্যতায় এর নানা বর্ণনা রয়েছে। যে মৃত্যুকে জয় করে আবার ফিরে আসে, এই প্রাণীটি হচ্ছে ‘ফিনিক্স পাখি’। ফিনিক্স পাখি সম্পর্কে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি এবং জনশ্রুতি রয়েছে।
আমরা যারা জানি, ফিনিক্স পাখির কথা শুনলেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে আগুন রঙা একটি পাখি। যে মৃত্যুর পরে আবার পুনর্জন্ম লাভ করে।

প্রচলিত লোককাহিনি মতে, ফিনিক্স পাখিকে হিংসুকেরা আঘাত করলে তার পালক থেকেও জন্ম নেয় নতুন প্রাণ। এদের চোখের জলও বদলে দিতে পারে কারোর জীবন। অগ্নি ও পবিত্রতার দৌলতে এরা মৃত্যু পথযাত্রীদেরও সাময়িক জীবন দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
প্রাচীন গ্রীক ও রোমক বইপত্রে ফিনিক্সের উল্লেখ মিলেছে বারংবার। কিন্তু কেমন পাখি এই ফিনিক্স? কেমন চেহারা তার? “এদেশে একরকম পাখিও আছে যার নাম ফিনিক্স, যাকে ভারি পবিত্র বলে মনে করা হয়”– মিশর সম্পর্কে লিখছেন হেরোডোটাস, তাঁর ইতিহাস বইতে।
ফিনিক্স পাখির কথা আগে থেকে জানলেও সম্প্রতি নতুনভাবে আমাদের সামনে চলে আসে ‘হ্যারি পটার’ সিরিজের কল্যানে। হ্যারি পটার সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে লেখিকা জে.কে. রোলিং আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন টুকটুকে লাল একটি ফিনিক্স পাখির, যার অশ্রুজলে সুস্থ হয়ে ওঠে মৃত্যুপথযাত্রী হ্যারি। ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য অর্ডার অফ দ্য ফিনিক্স’ (Harry potter and the Order of the phoenix) দেখা যায়, একটা পাখি নিজেই আগুনে পুড়ে ছাই গেল। তারপর সেই ছাই থেকে পাখিটি আবার পুর্নজন্ম লাভ করেছে! প্রফেসর, হ্যারির সঙ্গে পাখিটিকে ফিনিক্স নামে পরিচয় করান।
সর্বপ্রথম ফিনিক্স পাখির কল্পনা করেছিল ফিনিশিয় সভ্যতা। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হিসেবে আজও মিশরীয় সভ্যতা স্থান দখল করে আছে। প্রাচীন মিশরে ফিনিক্স ছিল ‘বেনু’ পাখি নামে। হলুদ, কমলা, লাল, সোনালি – হরেক রঙের মিশেলে রাঙা এক স্বপ্নিল পাখি বেনু। আবার কোথাও উল্লেখ আছে ধূসর, নীল, বেগুনী ও সাদার মিশেল হিসেবে। কেউ বলে বেনু বাঁচত ৫০০ বছর আবার কেউ বলত হাজার বছরের উপরে। যত বছরই বাঁচত না কেন, সময় হলেই জমদূত আসার আগে নিজেই নিজের আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যেত। সেই ছাই থেকে পুনরায় জন্মাত শিশু ফিনিক্স। বেনু শব্দের অর্থই হল, আগুন থেকে ‘সুন্দর করে বেরিয়ে আসা’।

নীল নদের শুকিয়ে যাওয়া ও আবার জলপূর্ণ হয়ে ওঠার সঙ্গে মিসরীয়রা ফিনিক্স পাখির মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মিল খুঁজে পেত। প্লাবনের সময় নীল রঙের সুন্দর এই পাখিটি আশ্রয় নেয় উঁচু জায়গায়। তখন মনে হয় জলেতে সূর্য ভাসছে। এই কারণে পাখিটির নাম হয়েছে ‘উদিত জন’ বা ‘দ্য অ্যাসেন্ডিং ওয়ান’, অর্থাৎ যা উঠছে, যা মনে করিয়ে দেয় সূর্য দেবতা ‘রা’কে।
পারস্য সভ্যতা অনুসারে ফিনিক্স পাখিকে আমরা ‘হুমা’ নামে পাই। হুমার অর্থ ‘স্বর্গের পাখি’। পারস্যের মানুষেরাও বিশ্বাস করত হুমা পাখি শতাধিক বছর বেঁচে থাকার পরে, আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যেত। পরে আবার সেই ছাই থেকে জন্ম নিতো। ধরনা করা হত ফিনিক্সে পাখি একই সঙ্গে নারী-পুরুষ স্বত্ত্বা বহন করত। এক পাখা ও এক পা হল পুরুষের, অন্য দুটি নারীর। এই পাখি কখনো কোনো প্রাণীর হত্যা করত না, বরং মৃত পশুর মাংস খেত। মানা হত, ফিনিক্সের ছায়ায় কেউ দাঁড়ালে তার সৌভাগ্যবান হয়। এমনও বিশ্বাস করা হত, ফিনিক্স পাখি মাথায় বসলে আপনি একদিন রাজা হবেন।
প্রাচীন গ্রিক পুরাণ অনুসারে, ফিনিক্স হল এক পবিত্র “আগুনপাখি”। গ্রিক ভাষায় phoenix মানে ‘দ্য ব্রিলিয়ান্ট ওয়ান’ কিংবা লাল এবং নীলের মিশ্রণে সৃষ্ট রং। প্রাচীন মিথ অনুসারে ওই আগুনরঙা পাখিটি নাকি ৫০০ বছর বেঁচে থাকত। গ্রিকরা বিশ্বাস করত, এই পাখি আরবে বাস করে। প্রতি ভোরে, ফিনিক্স তার বাসস্থানের পাশের এক কুয়া বা জলাশয়ের জলে যখন স্নান করে, সূর্য দেবতা তখন তার রথ থামাতেন ফিনিক্সের গান শোনানের জন্য। অন্যান্য পুরানের মতো, জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে পাখিটি দারুচিনি, গন্ধরস প্রভৃতি সুগন্ধী উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি করত একটি ঘর, তারপর সে ঘরে ধরিয়ে দিত আগুন। ঘরসহ পাখিটি পুড়ে ছাই হয়ে যেত। কিন্তু এখানেই সব শেষ নয়, কারণ ভস্মিভূত ছাই থেকে আবার জেগে উঠত আরেকটি প্রাণ।

রোমান চিত্রকলায় ফিনিক্স ঈগলরূপে প্রতিষ্ঠা পায়। অনেকে ‘গরুঢ়’ এবং ফিনিক্সের মিল খুঁজে পান। রামায়ণেও এর উল্লেখে মেলে। গরুঢ় হল দেবতা বিষ্ণুর বাহন। আর চিনে ফিনিক্স পাখি ‘ফেংহুয়াং’ নামে পরিচিত। রাশিয়ার ‘ফায়ারবার্ড’, জাপানিজ ‘হোও পাখি’, স্থানীয় আমেরিকানদের ‘থান্ডারবার্ডের’ সঙ্গে ফিনিক্সের মিল পাওয়া যায়।
ইহুদী পুরাণে ‘মিলহাম’ পাখি ফিনিক্স নামে পরিচিত। ইহুদী মতে, অ্যাডাম যখন স্বর্গে ছিলেন তখন শয়তানের ছলনায় পড়ে তিনি নিষিদ্ধ কোনো ফল খান। তখন নাকি তিনি খুব দুঃখিত হন এবং ঈর্ষান্বিত হয়ে স্বর্গের অন্য সকল প্রাণীকেও সেই ফল খাওয়ান। কিন্ত সে সময় মিলহাম (ফিনিক্স) বলে কেউ সেটি খায়নি। ফলে ঈশ্বর মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকে মরণশীল হিসেবে পৃথিবীতে পাঠালেও মিলহামের উপর খুশি হয়ে তাকে অমরত্ব দান করেন।
পুরাণ নিয়ে নানা আলোচনার পর বলা যায়, ফিনিক্স যেমন বারংবার ভস্মীভূত হওয়ার পরেও পুনরায় বেঁচে উঠত, ঠিক তামনই আমরাও বিভিন্ন পরিস্থিতির মোকাবিলা করে নতুন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখবো।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, ফিনিক্স – মহম্মদ জাফর ইকবাল
ছবিঃ মেডিয়াম, উইকিপিডিয়া, এনসিয়েন্ট অরিজিনস, টুওয়ার্ডস ডাটা সায়েন্স