ঈপ্সিতা নায়ক |
সে এক যুগের অবসান। জীবনের মূল স্রোত থেকে হারিয়ে যায় এক প্রাণ। রওনা দেয় বৃহত্তর জীবনের উদ্দেশ্যে। শেষবারের মত তাঁকে একটি বার দেখতে কলকাতার রাস্তায় নেমেছিল জনস্রোত। দিনটা ছিল ১৯৪১ সালের ২রা অগাস্ট। তাঁর চলে যাওয়া আমাদের কাছে একটা এমন যন্ত্রণা যার কোন নিরাময় হয় না, শূন্যতা পূরণ সম্ভব নয়। কিন্তু আজ কবিগুরুর জন্মদিনে তাঁর শূন্যতায় পূর্ণতা খুঁজে নিতে চাই আমরা সকলে। নামটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না, তিনি বাঙালির আপন এক সম্পদ, বাঙালি বলে গর্ববোধ করার এক কারণ। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তিনি আজও আছেন সকলের মধ্যে। তাঁর “শেষের মধ্যে অশেষ আছে” যে! মন সহমত জানিয়ে বলে ওঠে “আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনই লীলা তব”।
কবিগুরুর জীবনের শেষ দিনগুলি কাটে তাঁর প্রাণের শান্তিনিকেতনে। তবে একই ঘরের চার দেওয়ালের দৃঢ় অভ্যাস তাঁর পছন্দ ছিল না। তাই তাঁর জন্য ছিল কয়েকটি বাড়ি। বয়সকে কখনো কর্তব্যের উপরে স্থান দেননি তিনি। ১৯৪১ সালের ৭ই মে, আশি বছর বয়স তখন তাঁর। এরই তিন মাস পরে অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে তাঁর জন্মস্থান জোড়াসাঁকোতে আনা হয়। অসুস্থ অবস্থায় শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে আসার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন আরো এক মানুষ যাঁর নামও বাঙালির কাছে একটা আবেগ। যাঁর স্মৃতির বাক্সে রয়েছে ছোটবেলা ও বড়বেলা দুই বয়সেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাটানো সময়।
শুরুটা হয় নিতান্তই শিশুবেলা থেকেই। তাই প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি একটু আবছা হলেও সাত বছর বয়সের কথা কিন্তু তিনি ভাগ করে নিয়েছেন সকলের সঙ্গে। সাথে ভাগ করেছেন তাঁর একান্ত নিজস্ব এক উপহার। ভাবছেন হয়তো কার কথা বলা হচ্ছে আর কেনই বা! নামটি সত্যজিৎ রায়, যিনি সাত বছর বয়সে শান্তিনিকেতন যান মা’র সাথে, পৌষের মেলায়। ছোট্ট মনের হাজারো শখের ভিড়ে একটি ছিল অটোগ্রাফ কালেকশন। হোয়াইটওয়ে লেডেল-এর দোকান থেকে কেনা একটি অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে হাজির হয় সে উত্তরায়ণে। খাতা দিলে তক্ষুনি কবিতা লিখে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- এই কথা যেই না শোনা! তখনই খাতার প্রথম পাতায় তাঁকে দিয়ে কবিতা লেখানোর শখ মনে নাড়া দিয়ে ওঠে ছোট্ট ছেলেটির।
অবশেষে তাঁর ঘরে গিয়ে টেবিলের স্তূপীকৃত বই খাতা চিঠিপত্রের মাঝে তার চোখে পড়ে যায় এক অভিনব জিনিস। দেশবিদেশের নানানরকমের রঙবেরঙের ডাকটিকিট। ছোট্ট ছেলেটির কাছে তা এক বাড়তি আকর্ষণ। শেষপর্যন্ত অটোগ্রাফের খাতাটা এগোলেও সাহস করে কবিতার আর্জি জানাতে পারল না সে, অগত্যা মা-ই উদ্ধারক। ফরমাসটা তিনিই করলেন। তবে তক্ষুনি নয় পরের দিন এসে খাতাটি নিয়ে যেতে বললেন লেখক। পরের দিন ভয়ে ভয়ে উপস্থিত হলে তিনি একরাশ বইয়ের মাঝে বেশ খোঁজাখুঁজি করে ছোট্ট ছেলেটির হাতে তুলে দিলেন তার বেগুনি রঙের খাতাটা। সেখানে লেখা ছিল আট লাইনের একটি কবিতা। সাথে তিনি বললেন, ‘এর মানে আর একটু বড় হলে বুঝবে’. এরপর থেকে বারো বছর অবধি তা ছিল সত্যজিৎ রায়ের নিজস্ব সম্পদ। ঠাকুরের মৃত্যুর পর তা জায়গা পায় পত্রিকা ও বইয়ের পাতায়, সাথে হাজারো মানুষের মনেও।
এর বহুবছর পর সত্যজিৎ রায় তাঁর মায়ের ইচ্ছায় ১৯৪০ সালে শান্তিনিকেতনে যান কলাভবনে ছবি আঁকা শিখতে। মায়ের কাছে তিনি এও শোনেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নাকি এই একই ইচ্ছা পোষণ করতেন। তিনিও চাইতেন যাতে সত্যজিৎ রায় কিছুদিনের জন্য শান্তিনিকেতনে গিয়ে থাকেন। প্রথমদিন গিয়ে যখন দেখা হয় তখন রবি ঠাকুর সিটিং দিচ্ছেন প্রখ্যাত এক বাঙালি ভাস্করকে যিনি তাঁর মূর্তি গড়ছিলেন মনোযোগ সহকারে। সেখানে থাকাকালীন দেখা করার অগুনতি সুযোগ থাকলেও বিশেষ সদ্ব্যবহার করতে পারেননি যুবক। ঠাকুরের পাহাড়প্রমাণ জ্ঞান, অস্মিতার সামনে সাহস হয় না অনেকেরই, ‘তাঁর সামনে গিয়ে কি যে বলব সেটা কোনো সময়েই ভেবে স্থির করতে পারিনি ‘- বলেন নিজেই। শেষ সাক্ষাৎ যখন হয় তখন তাঁর জন্মদিন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এবার আশি, আর তার মানেই তো আসি!’ এই তাঁদের শেষ কথোপকথন। দুই কালজয়ী স্রষ্টার শেষ সাক্ষাৎ। বড় হয়ে কবিতার মানে কিভাবে বুঝেছিলেন তা তাঁর নিজস্ব উপলব্ধি, তবে এই কবিতা সম্পদের ভাণ্ডারের যে এক গুরুত্বপূর্ণ রত্ন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই!
“বহু দিন ধরে’ বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।।”
ছবিঃ উইকিপিডিয়া, প্রিন্টেরেস্ট
কমেন্টস
উপরের ছবিটিতে কবিগুরুর সাথের বাচ্চা ছেলেটির নাম অভিজিৎ চন্দ, সত্যজিৎ রায় না| আগে ভালো করে সঠিক তথ্য জানুন, তারপর না হয় কল্পনার জাল বুনবেন |