শুভজিৎ দে|
১৮৫৬ থেকে ১৮৬২, এই সময়কালের প্রথম দু’বছর ভারতের গভর্নর-জেনারেল এবং পরের চার বছর ভাইসরয় ছিলেন চার্লস জোহান আর্ল ক্যানিং। পরবর্তীতে তিনি লর্ড উপাধি গ্রহণ করেন। এই সময়ই তৈরি হয়েছিল পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি। আর সেই কোম্পানি নিজের সুবিধার্থে বাংলার মাতলা নদীর ধারে তৈরি করে স্ট্যান্ড, হোটেল ও কিছু বাড়ি। কিন্তু ১৮৬২ সাল নাগাদ নদীর পথ পরিবর্তনের জন্য সে সব ভেঙে যায়। আজ কথা বলব তেমনই একটি বাড়ি নিয়ে, যার সঙ্গে আজও ক্যানিংয়ের নাম জুড়ে রয়েছে। কিন্তু তা আর কতদিন; সেটাই এখন প্রশ্ন। কারণ ওই বাড়িটিও মাটিতে মিশে যেতে চলেছ। চলুন সেই বাড়ির গল্প জানা যাক।
শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে ক্যানিং পৌঁছাই, লর্ড ক্যানিংয়ের এই বাসভবনটি ক্যানিং স্টেশন থেকে মিনিটখানেকের দূরে। স্টেশন থেকে নেমে RPF OFFICE -এর পাশে সিমেন্টের পাকা রাস্তা ধরে সোজা মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই পাবেন এক চারমাথার মোড়, সেখান থেকে বাম দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন পোর্ট ক্যানিংয়ের সদর দপ্তর বা লর্ড ক্যানিংয়ের বাড়ি।

ক্যানিং মহকুমায় একটি সুপ্রাচীন জনপদ গড়ে উঠেছিল বড়লাট লর্ড ক্যানিংয়ের নামানুসারে। মাতলা নদীর তীরে এই জায়গাটি বর্তমানে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার নামে খ্যাত। ভারতবর্ষের তৃতীয় শহর হিসেবে ক্যানিংয়ে রেলপথ স্থাপন হয়, তৎকালীন ক্যানিং বন্দরের সুবিধার্থে ১৮৬২-১৮৬৩ সালে। উল্লেখ্য এ রাজ্যের ইতিহাসে ক্যানিংই ছিল প্রথম পুরশহর। যদিও পরে সেই তকমা মুছে যায়। স্বাধীনতার পরে মহকুমা শহর হিসাবে গড়ে উঠলেও পুরসভার তকমা এখনও ফিরে পায়নি এই শহর। লর্ড ক্যানিংয়ের একটি বাড়ি ক্যানিং শহরে এখনও বর্তমান। এই বাড়িটি সে যুগের প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হত।

কীভাবে বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ক্যানিংয়ের স্মৃতি? এ বিষয়ে সুন্দরবন নিয়ে গবেষণা করা এক গবেষক দেবব্রত ঘোষাল বলেন, “বাড়িটি ছিল পোর্ট ক্যানিং কোম্পানির সদর দপ্তর। ১৮৭২ সালে এই সংস্থা বন্ধ হয়ে যায়, আর এখানেই প্রশ্ন কেন? তার উত্তর দিতে হলে বলতেই হয়, একটি বন্দর চালাতে লাগে প্রচুর পরিমাণে অর্থ, সে অর্থের জোগান নিয়েই পোর্ট ক্যানিং বন্দর কাজ শুরু হয়। এই বন্দর থেকে ছোট ছোট জাহাজে করে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকের নামে আদতে কৃতদাস বিভিন্ন ইংরেজ উপনিবেশে পাঠানো হত। এমনই সময় জানা যায় একটি জাহাজ শ্রমিক সমেত ডুবে যায়। এর পর থেকেই সরকারের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী, এই পোর্ট ক্যানিং বন্দর থেকে এই চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক রপ্তানি বন্ধ হয়। সেই চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক সরবরাহের কাজ চলে পরবর্তীকালের সুরিনাম ঘাট থেকে। অন্যদিকে পোলির কারণে পোর্ট সংলগ্ন নদীগর্ভের নাব্যতা কম হওয়ায়, বড় জাহাজগুলিও এখানে আর নোঙর করত না। এছাড়াও স্থানীয় ঠিকা শ্রমিক ও মাঝিদের অসহযোগিতা ছিল এই পোর্ট বন্ধ হওয়ার পিছনে অন্যতম একটি কারণ।”

পোর্টের কর্মচারিগণ ইচ্ছা মতো জঙ্গলের গাছ কেটে নিজ ব্যবসা সিদ্ধি করতেন, ফলে এই উপকূলবতী অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হওয়ার শক্তি হারায়। ফলে যখন সাইক্লোন পুরো শক্তি নিয়ে ক্যানিং তথা উপকূলীয় অঞ্চলের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, পোর্টের কর্মচারিদের কৃতকর্মের জন্য এই উপকূলীয় অঞ্চল সেই সাইক্লোনকে বাধা দিতে পারেনি, পোর্টের জেটিগুলোতে ৬ থেকে ৭ ফুটের উপরে জলোচ্ছাস হয়েছিল। অবস্থার একটু উন্নতি হলে, সরকার সব ঠিকঠাক করে আবার পোর্টটি চালু করে। কিন্তু ১৮৬৮ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে মাত্র ৩টি জাহাজ আসে ক্যানিং পোর্টে। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার ক্যানিং পোর্টকে ‘নিঃশুল্ক বন্দর’ ঘোষণা করে দেন, কিন্তু কোনো লাভ হয় না। অবশেষে ১৮৭০ সালে সরকার পোর্ট ক্যানিং বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
নামমাত্র টাকায় ওই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় দু-তিনজন বাড়িটি ও সংলগ্ন জমি কিনে নেন। লেডি ক্যানিং যখন এই এলাকায় আসতেন তখন এই বাড়িতেই থাকতেন বলে অনুমান করা হয়। বর্তমনে বাড়িটির তৎকালীন কেয়ারটেকার জিতেন্দ্রমোহন ঘোষের পুত্রবধূ সবিতাদেবী থাকেন। এক সময় দোতলা বাড়িটিতে মোট ১১টি ঘর ছিল, যার মধ্যে আজ শুধু দুটি ব্যবহারযোগ্য আছে।

প্রাচীন ভবনটির অবস্থা খুবই জীর্ণ। খসে পড়ছে দেয়ালের পলেস্তারা। লোহার মূল ফটকটি বহুকাল আগেই উধাও হয়ে গিয়েছে। পুরু দেয়ালের বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। বাড়ির তিন দিকে বিভিন্ন জায়গায় বটবৃক্ষ বাড়িয়ে চলেছে সেই ফাটলের মাত্রা। উঁচু স্তম্ভগুলোর ইট খসে পড়ছে। কড়ি কাঠের ছাদের উচ্চতা অন্তত ১৫ ফুট। ভূগর্ভের নীচে একটি তল আছে, যেটি সেই সময়ে ব্যবহার হত। বহুকাল ব্যবহৃত না হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে সেই সুরঙ্গ পথটিও।
এই বিষয়ে ক্যানিং পশ্চিম -এর বিধায়ক শ্যামল মন্ডল বলেন, “ক্যানিংয়ের আরো একটি ঐতিহ্য সম্পন্ন বাড়ি ছিল মাতলা নদীর তীরে। অযত্ন-অবহেলায় দীর্ঘকাল পড়ে থাকায় সেটি ভেঙে যায়। যারা সেটির মালিক বলে দাবি করতেন তারা সেই জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। এই হেরিটেজ ঘোষণা হওয়া বাড়িটির বিভিন্ন অংশ ইতিমধ্যেই দখল হয়ে গেছে।
ইংরেজ আমলের ব্যবহৃত বহু জিনিসপত্র এই বাড়িটিতে ছিল। যা ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে বা বিক্রি হয়ে গেছে প্রশাসনের অজান্তেই। ভয়ানক আমপান ঝড়ে অর্ধ-ভগ্নপ্রায় সেই বাড়িটি এবার সত্যি সত্যি ভেঙে পড়তে চলেছে। ইতিহাসের পাতা থেকে কিছু তথ্য আবার মাটিতে মিশে যেতে চলেছে, আমাদের কাছে এ খুব হতাশার খবর।
তথ্যসূত্রঃ দক্ষিণ ২৪ পরগণা সমগ্র : জেলার ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব – মহাদেব গুড়িয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা (অশোক সেনগুপ্ত), একটা বিলুপ্ত বন্দর, আর একটা ভাঙা বাড়ির গল্প – সলিল হোড়