শুভজিৎ দে|

কলকাতার এই প্রাচীন ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে চলেছে চিরতরে। এই অসময়ে (করোনা, লকডাউন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে) জানি না কেমন আছেন তারা? যারা এক সময়, বর্তমানের অ্যাপ নির্ভর ক্যাবের মতো পরিষেবা দিয়ে গেছে এই শহরকে। এক সময় কলকাতায় প্রায় ৩০ হাজারের বেশি হাতে টানা রিকশা ছিল, তবে এই যানবাহনের জন্ম কিন্তু এই শহরে হয়নি। এর জন্ম জাপানে। সেখানে একে বলা হত ‘জিন-রি-কি-শ’, এই কথাটির মানে হচ্ছে  ‘মানুষের টানা গাড়ি’। রাধারমণ মিত্র তার কলিকাতা দর্পণ গ্রন্থে এমনটাই বলেছেন। জাপান থেকে এই গাড়ি প্রথমে যায় সাংহাইতে, সেখান থেকে ১৮৮০ সাল নাগাদ এই গাড়ি আসে ভারতের সিমলায়। এই রিকশার আগমনের কথা লর্ড ডাফরিন তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন।

এদেশে এই গাড়িকে প্রথমিক পর্যায়ে বলা হত ‘জেনি রিকশা’ বা ‘জিন রিকশা’। তার পর কালের স্রোতে জেনি বা জিন শব্দ হারিয়ে গেলেও রিকশা শব্দটি রয়ে গিয়েছে। W. LESLIE & CO. -এর একটি বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, প্রতিটি জিন রিকশা বা Jin Rickshaws-এর কলকাতাস্থ দাম যথাক্রমে – ১৬০ টাকা, ১৭০ টাকা, ১৮০ টাকা।

১৯০০ খ্রিঃ নাগাদ কলকাতার আশেপাশের গোটাকয়েক কলকাতাস্থ চৈনিক বাসিন্দা তাঁদের নিজেদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য এই রিকশার আমদানি করে। ১৯১৩-১৪ সাল নাগাদ কলকাতাস্থ চৈনিক বাসিন্দাদের আমদানি করা সেই টানা রিকশা, শহর জুড়ে সাধারণ মানুষদের থেকে ভাড়ার বিনিময়ে পরিষেবা দিতে শুরু করে। এর পর ১৯২০ সালের মধ্যে এই হাতে টানা রিকশার ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে ভারতীয়দের হাতে চলে আসে।

ইংরেজ শাসনের শেষদিকে এই দেশে হাতে টানা রিকশায় দু’জনের বসে যাওয়ার নূন্যতম ভাড়া ছিল দূরত্ব অনুযায়ী, মাইলপিছু ৩ আনা। এক মাইলের অধিকে দিতে হত অতিরিক্ত ৩ আনা। সময়ের হিসেবে ঘন্টায় ৬ আনা, এক ঘন্টার বেশি হলে প্রতি ঘন্টায় ৩ আনা। আবার অন্যদিকে রিকশায় একজনের বসে যাওয়ার নূন্যতম ভাড়া ছিল দূরত্ব অনুযায়ী, মাইল পিছু ১.৫ আনা, এক মাইলের অধিকে দিতে হত অতিরিক্ত ১.৫ আনা। যা সময়ের হিসেবে দাঁড়ায় ঘন্টায় ৩ আনা, এক ঘন্টার বেশি হলে প্রতি ঘন্টায় ১.৫ আনা।

‘ক্যালকাটা হ্যাকনি ক্যারেজ অ্যাক্ট’ চালু হয়েছিল ১৯১৯ সালে। সেই আইনে ইংরেজ সরকার কলকাতা শহরে ঘোড়া, গরুর গাড়ি, পালকি এবং হাতে টানা রিকশার উপর হ্রাস টেনেছিল। তখন থেকেই কলকাতা শহরে লাইসেন্স সহ হাতে টানা রিকশা চলাচল শুরু হয়।

২০০৬ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এমন রিকশা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, এবং বাতিল করে দেওয়া হয় স্বাধীনতাপূর্ব ইংরেজদের ১৯১৯ সালের ‘হ্যাকনি ক্যারেজ’ আইনও। কিন্তু তার পরেও কলকাতায় সেই প্রাচীন রিকশাগুলি পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়নি। এখন শহরে এই রিকশার সংখ্যা বিশাল ভাবে কমে গিয়েছে, যারা এই রিকশার চালক তারা বেশিরভাগই বৃদ্ধ। তাই মানবিকতার খাতিরে লাইসেন্স না থাকলেও তাদের রিকশা চালাতে বাধা দেওয়া হয়নি। এছাড়াও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশায় আসতে চায় না, হয়তো টানা রিকশার এটাই শেষ প্রজন্ম। এরপর এই রিকশা বইয়ের পাতাতেই শুধু থেকে যাবে, হয়তো এ শহরের আগামী প্রজন্ম শুনতেই পাবে না টানা রিকশার সেই ঠুং-ঠুং শব্দ।

তথ্যসূত্র: কলকাতা দর্পণ – রাধারমণ মিত্র, শ্রীপান্থের কলকাতা – শ্রীপান্থ, পুরনো কলকাতার কথাচিত্র – পূর্ণেন্দু পত্রী

ছবিঃ মিস্টে (Mistay), উইকিপিডিয়া, কমনস উইকিমিডিয়া