গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক|
ভারতবর্ষে আসমুদ্র-হিমাচলে বহু এমন হিন্দু মন্দির রয়েছে, যার দেবত্তোর সম্পত্তির পরিমাণ এতটাই বেশি যে তার হিসাব পাওয়া যায় না। বলা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত যত ধরণের হিন্দু মন্দিরের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ধনশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটি হল দক্ষিণ ভারতের শ্রী পদ্মনাভস্বামীর মন্দির। ভগবান বিষ্ণু এখানে পূজিত হন। ইতিবাসবিদরা মনে করেন, আঠারো ও উনিশ শতকে কেরলের মধ্য ও দক্ষিণাংশ নিয়ে গঠিত ত্রিবাঙ্কুরে শ্রী পদ্মনাভস্বামীর মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছিল। নির্দিষ্ট করে এই সময়কাল না জানা গেলেও খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ সাল থেকে খ্রীষ্টের জন্মের ৩০০ সালের মধ্যে রচিত ‘সঙ্গম’ তামিল সাহিত্যের বহু প্রাচীন গ্রন্থে এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে, যেখানে এই মন্দিরকে ‘স্বর্ণ মন্দির’ হিসাবে সম্বোধন করা হয়েছে। তবে মন্দিরের নির্মাণ সংক্রান্ত রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, দিবাকর মুনি কলিযুগ শুরু হওয়ারর পর এই মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেন এবং মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ হতে প্রায় ৯৬৪ দিন সময় লেগেছিল।
মন্দিরের ভেতরে ভগবান বিষ্ণুর একটি সুবিশাল মূর্তি রয়েছে। ভগবান শ্রী বিষ্ণুর ১০৭টি দিব্য দেশমের মধ্যে এই মন্দিরটি অন্যতম। ভগবান বিষ্ণু এখানে অনন্তশয্যায় সজ্জিত। তিনি নাগরাজ অনন্তের ওপর যোগনিদ্রায় নিদ্রিত। তিনি পদ্মনাভন কারণ শ্রী বিষ্ণুর নাভিমূল থেকে উদ্ভূত হয়েছে পদ্ম। ভগবান বিষ্ণুর পাশে বিরাজ করছেন ভূদেবী এবং শ্রীদেবী। তাঁর হাত শায়িত রয়েছে শিবলিঙ্গের ওপর। যত দিন গিয়েছে এই মন্দির ঘিরে ঘনীভূত হয়েছে রহস্য। বিশেষত ২০১১ সালে এই মন্দিরের রত্নভাণ্ডার আবিস্কারের পর থেকেই এই মন্দির নিয়ে ব্যপক আলোচনা শুরু হয়েছিল বিভিন্ন মহলে। কারণ এক জায়গা থেকে এমন বিপুল পরিমাণ রত্নভাণ্ডারের হদিশ এর আগে পৃথিবার কোথাও পাওয়া গিয়েছে বলে ইতিহাসে কোনও নজির নেই। এমনকি এও বিশ্বাস করা হয় যে, ভগবান পদ্মনাভ স্বামীই হলেন এই দেবত্তোর সম্পত্তির মালিক।
পদ্মনাভস্বামীর মন্দিরটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন, ত্রিবাঙ্কুরের রাজ পরিবারের তরফে পরিচালিত একটি ট্রাস্ট। ২০১১ সালে মন্দিরের অব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি মামলা দায়ের করেন আইনজীবি টি পি সুন্দররাজন। সেইবছরই সুপ্রিমকোর্ট মন্দিরের দেবোত্তর সম্পত্তির একটি তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দেয়। জানা যায়, এই মন্দিরের মাটির তলায় ৬টি গোপন কক্ষ রয়েছে। এইসব গোপন কক্ষ বা ভল্ট ইংরেজি বর্ণমালার ‘A’- থেকে ‘F’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরবর্তীকালে আবার ‘G’ এবং ‘H’ নামেও দুটি ভল্টের সন্ধান পাওয়া যায়। এইসব ভল্টের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি পরিমাপের জন্য সুপ্রিম কোর্টের তরফে গঠন করা হয় পাঁচ সদস্যের একটি দল। ২০১১ সালের ৩০ জুন তারিখে মন্দিরের ভল্টগুলি খুলতে যান তাঁরা। একে একে সবকটি ভল্ট খুলতে পারা গেলেও দুই নম্বর ভল্টটি তাঁরা কোনওভাবেই খুলতে পারেননি। বাকি পাঁচটি ভল্ট থেকে উদ্ধার হয়েছে সব অমুল্য এবং দুর্লভ মণি-মাণিক্য, রত্ন খচিত মূর্তি, সোনা, হীরে, পান্না, একগুচ্ছ তৈজসপত্র, প্রাচীন মুদ্রার মতো বিভিন্ন রকমের সম্পদের ভান্ডার। এই পাঁচটি ভল্ট মিলিয়ে সম্পদের আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২,২০০ কোটি মার্কিন ডলার।
কিন্তু দুই নম্বর ভল্টের ধনসম্পত্তির হিসাব কিন্তু আজও অধরা। কারণ সেই ভল্টের লোহার দরজা শত চেষ্টা করেও খোলা যায়নি। রাজপরিবার এবং মন্দির কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হয় যে, কোনও এক অজানা মন্ত্রবলে মন্দিরের ভেতরের এই দু’নম্বর ভল্টটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সেটা খুললে হয়তো দেবতার কোপ পড়তে পারে। শুধু তাই নয়, দু’নম্বর ভল্টের দরজার গায়ে আঁকা রয়েছে সাপের ছবি, যা দেখে বহু শাস্ত্রজ্ঞ জ্ঞানী মুনি-ঋষিরা বলেন যে, বিশালাকার গোখরো শাপ এই ভল্ট পাহাড়া দিচ্ছে। তাই এই ভল্টের দরজা খোলা কার্যত অসম্ভব। শুধু তাই নয়, একমাত্র গড়ুর মন্ত্র জপ করেই নাকি এই দরজা খোলা সম্ভব।
তবে জানা যায়, ১৯৩১ সালে রাজা চিথিরা থিরুনাল বলরাম ভার্মার আদেশে ভল্ট ‘বি’ খোলার প্রচেষ্টা হয়েছিল। ভল্টের বাইরের দিকের দরজাটি খোলা হয়েছিল। তবে তারও আগে ১৯০৮ সালে নাকি সেরাজ্যে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় ভল্ট ‘বি’ খোলার চেষ্টায় একদল লোক সুরঙ্গে প্রবেশ করে। কিন্তু সেখানে থাকা গোখরো সাপের কামড় থেক নিজেদের বাঁচাতে প্রাণ হাতে করে পালিয়ে আসেন তারা। বিভিন্ন গল্প-গাঁথা এবং রহস্যে মোড়া এই পদ্মনাভ মন্দির দর্শনে প্রতিবছরই বিশাল ভক্তের সমাগম হয়। কিন্তু সবকিছুর মাঝখানে অধরা থেকে যায় এই অপার রহস্যের ভাণ্ডার।