ধ্রুবজ্যোতি বোস|
বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজ ১৫৯ তম জন্মবার্ষিকী। তিনি শুধু একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকই ছিলেন না; তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, শিক্ষাবিদ, চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিকও।
ছোটবেলায় স্কুলের শিক্ষার প্রতি তাঁর অনীহা ছিল; চার দেওয়ালের আবদ্ধ পরিবেশে পড়াশোনর এই রীতি তাঁকে মোটেই পছন্দ ছিল না। পরে গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করে বাড়ির খোলা পরিবেশে তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান তিনি। সেখানে ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলেও ভর্তি হন তিনি। তারপর ১৮৭৯ সালে লন্ডনে তিনি আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু সাহিত্য চর্চার প্রতি আকর্ষণের কারণে তিনি সেই পড়াশোনা আর শেষ করতে পারেননি।
কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র মানুষদের শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে; রবীন্দ্রনাথ দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পূজার কথা বলেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক দর্শন ছিল অত্যন্ত জটিল। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার তথ্যপ্রমাণ এবং পরবর্তীকালে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ গদর ষড়যন্ত্রের কথা শুধু জানতেনই না, বরং উক্ত ষড়যন্ত্রে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন। আবার ১৯২৫ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে “চরকা-সংস্কৃতি” বলে বিদ্রুপ করে কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে তিনি বলেছিলেন, “আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলির রাজনৈতিক উপসর্গ”।
১৯১৬ সালের শেষ দিকে সানফ্রান্সিসকোয় একটি হোটেলে অবস্থানকালে একদল চরমপন্থী বিপ্লবী রবীন্দ্রনাথকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ উপস্থিত হওয়ায় তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড বর্জন করেন। নাইটহুড প্রত্যাখ্যান-পত্রে লর্ড চেমসফোর্ডকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌন যন্ত্রণার অভিব্যক্তি”।ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার ভূমিকা অনস্বীকার্য।রবীন্দ্রনাথের “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য” ও “একলা চলো রে” রাজনৈতিক রচনা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা সম্পর্কে প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তাভাবনা শুরু করেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমকে দেশ ও ভূগোলের গণ্ডির বাইরে বের করে ভারত ও বিশ্বকে একসূত্রে বেঁধে একটি বিশ্ব শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাও সেই সময়েই গ্রহণ করেছিলেন কবি।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক বছর আগে বোলপুরের শান্তিনিকেতনে এক বিশাল জমি কেনেন, সেখানেই ২০বিঘা জমির উপর ১৯১৮ সালের ২২ অক্টোবর বিশ্বভারতী নামাঙ্কিত তাঁর এই বিদ্যালয়ের শিলান্যাস করা হয়েছিল। এরপর ১৯২২ সালের ২২ ডিসেম্বরে এই বিদ্যালয়ের উদ্বোধন হয়েছিল। বিশ্বভারতীতে কবি সনাতন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্রহ্মচর্য ও গুরুপ্রথার পুনর্প্রবর্তন করেছিলেন। এই বিদ্যালয়ের জন্য অর্থসংগ্রহ করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন তিনি। নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে প্রাপ্ত সম্পূর্ণ অর্থ তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন এই বিদ্যালয়ের পরিচালন খাতে।
১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তাঁর ‘অভিলাষ’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ এবং অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তার মোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত। এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৪০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে শান্তিনিকেতনে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে “ডক্টরেট অব লিটারেচার” সন্মানে ভূষিত করে। ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের আঁকা একটা ছবি, লন্ডন ও প্যারিশে প্রদর্শিত হয়। এছাড়া ১৯৬১ সালে; ৭ই মে, ভারতীয় ডাকবিভাগ সম্মান জ্ঞাপনের উদেশ্যে তাঁর ছবি দেওয়া একটা ডাক টিকিট প্রকাশ করে।
যুগের চলমান সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রত্যক্ষ করেছিলেন সমাজের অবস্থাকে। তিনি দেখেছিলেন রোগে মানুষের যত না ক্ষত, তার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষত তৈরি হয় তার মনে। তাই তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসগুলোই হয়ে উঠেছে মনস্তাত্ত্বিক। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলি হল- বউ ঠাকুরানীর হাট, চোখের বালি, গোরা, নৌকাডুবি, ঘরে বাইরে, চতুরঙ্গ, শেষের কবিতা ইত্যাদি।
আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। কৈশোরে রবীন্দ্রনাথ কাব্য, কবিতার সঙ্গে প্রবন্ধ রচনায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি প্রাবন্ধিক ও সমালোচক রূপে আবির্ভূত হন। প্রায় ৬৫ বছর ধরে তিনি ক্রমাগত গদ্য-প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, চিঠিপত্র ইত্যাদি লিখেছেন, যার স্বল্পতম পরিচয় পাওয়া দুরূহ। তাঁর প্রবন্ধকে মোটামুটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায় – সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধ, রাজনীতি সমাজনীতি ও শিক্ষামূলক প্রবন্ধ, ধর্ম দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা বিষয়ক প্রবন্ধ, ব্যক্তিগত প্রবন্ধ ইত্যাদি।
তিনি আজও বাঙালি তথা বিশ্বের মানুষের হৃদয়ে চিরস্বরনীয় হয়ে আছেন তারই অমরসৃষ্ট বিভিন্ন উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, কবিতা ও সঙ্গীতের মাধ্যমে। বিশ্বসেরা কবির জন্ম সার্ধশতবার্ষিকীতে তাঁকে জানাই শত প্রণাম।
ছবিঃ উইকিপিডিয়া