লেখক – আদিত্য গুপ্ত|
বাঙালি রাজা রামমোহন বলতেই বোঝে সতীদাহ প্রথা রদ, বিলেত গমন, অতঃপর প্রকাণ্ড তৈলচিত্রে পাগড়ি মাথায় এক মনীষী। কিন্তু রক্তমাংসের রামমোহন ছিলেন ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবন এক অনন্ত বিস্ময়ের আধার। আদ্যোপান্ত গতিময় এক মানুষ ছিলেন তিনি। আজকের বাঙালি জীবনে তাঁকে সত্যিই এক কল্পিত চরিত্রের মতো মনে হয়। রোজ এই মানুষটি খেতেন বারো সের দুধ, পঞ্চাশটা আম এবং একখানা গোটা পাঁঠা!
এমনই ছিলেন রামমোহন। বন্ধুর জমিতে নারকেল গাছের সারি দেখে ডাব খেতে ইচ্ছে হল। বন্ধুও তক্ষুনি একটা ডাব এনে দিলেন। রামমোহন হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘ও গুরুদাস, ওতে আমার কী হবে! কাঁদিশুদ্ধু নারকেল পেড়ে ফেল।’’
ছোটবেলা থেকেই তার্কিক রামমোহন কিশোর বয়সেই হিন্দুদের পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে একটি বই লিখে বাবার বিরাগভাজন হন। ১৬ বছরের রামমোহনকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন বাবা।
কোথায় গেলেন রামমোহন? সোজা তিব্বত! ভাবা যায়। সেখানে বৌদ্ধশাস্ত্রের পাঠ নিয়ে চার বছর পর ফিরে এলেন বাড়িতে। ক্রমে আত্মীয়সভা গঠন। তারপর সতীদাহ প্রথা রদ, বিলেত গমন। যাই হোক, সে গল্প তো সকলেরই জানা। একটু বরং জেনে নেওয়া যাক রামমোহনের রোজনামচা। এ লেখা সেই নিয়েই। রক্তমাংসের রামমোহন।
ভোর চারটেয় ঘুম থেকে উঠেই এক কাপ কফি। তারপর মর্নিং ওয়াক। ফিরে এসে চা খেয়ে ব্যায়াম। তারপর বিশ্রাম ও স্নান। রোজ এক ঘণ্টা দু’জন পালোয়ান তাঁকে দলাই মলাই করতেন সরষের তেল দিয়ে। তারপর শুরু হত দৈনন্দিন কাজকর্ম। কিন্তু সময় সময় জলযোগ, ফলমূল চলতই। শরীরটা ছিল পাহাড়ের মতো।
জানতেন শত্রুর শেষ নেই তাঁর। তাই বুকের মধ্যে চকচকে ছোরা লুকিয়ে রাখতেন সর্বক্ষণ! এখানেই শেষ নয়। আরও একটা অস্ত্র থাকত তাঁর কাছে। দেখলে মনে হবে সাধারণ লাঠি। কিন্তু তারই আড়ালে থাকত তরোয়াল। সর্বদা এমন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত থাকলেও কোনও রকম আশঙ্কার মেঘের ছায়া থাকত না তাঁর মুখে। এই বাগানে গিয়ে বাচ্চাদের মতো দোলনায় দুলছেন। আবার বন্ধুর বাগানে গিয়ে কাঁদিশুদ্ধ নারকেল পাড়িয়ে খেয়ে ফেলছেন।
ভাবলে অবাক লাগে। গল্পকথায় এই রকম চরিত্রের কথা শোনা যায়। তাঁকে নিয়ে কত গান। একটা গানের উদাহরণ দেওয়া যাক। সেই গানে ব্যঙ্গের তীক্ষ্ণ ফলায় তাঁকে বিঁধে বলা হল, ‘‘সুরাই মেলের কুল/ বেটার বাড়ি খানাকুল/ ওঁ তৎসৎ বলে বেটা/ বানিয়েছে ইস্কুল।’’ কিন্তু সেসব তিরে রামমোহনের কিস্যু যেত আসত না। যেমন চেহারা, তেমন দাপট। যাকে আজকের ভাষায় বলে ‘অ্যাটিচিউড’। কেউ যদি এসে বলত, কেউ বা কারা তাঁকে মারার পরিকল্পনা করছে তিনি বলতেন, ‘‘তাই নাকি? আমাকে মারবে এমন ক্ষমতা আছে তাদের?’’
ব্রিস্টলে আচমকাই মারা গিয়েছিলেন রামমোহন। কিন্তু মৃত্যুর ষাট বছর পরেও তাঁকে ঘিরে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিল। তাঁর শেষ জীবনের পাগড়ি বিলেত থেকে ফিরে এসেছিল কলকাতায়। তখন নাকি দেখা গিয়েছিল, সে পাগড়ি কলকাতার কোনও জোয়ান মানুষের মাথায় আঁটছে না! হয়তো এটা মিথ। কিন্তু মিথও তো এক ধরনের সত্যি। আক্ষরিকতায় না হোক, অনুভবে।
রামমোহনের পাগড়ি আজও বাঙালির কাছে অনতিক্রম্যই রয়ে গিয়েছে। উপাধি কেবল নয়, সত্যিই তিনি ছিলেন রাজা। মেনে চলতেন এই আপ্তবাক্য— ‘লিভ লাইফ কিং সাইজ।’
(ঋণ: পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কলকাতার রাজকাহিনী’)
কমেন্টস
রামমোহন বিলেত যান জাহাজে. সেকালে জাহাজে বিলেত যেতে ছয় মাস লাগতো. টাটকা দুধের জন্য তিনি জাহাজে তুলে নিয়েছিলেন একটি দুগ্ধবতী গাভী.
Nice ,I want more stories about him
খুবই সুন্দর । একটা জায়গায় ছোটোবেলা থেকেই আবার কিশোর বয়সেই একটু কেমন লাগলো ।