রুমা প্রধান|

এমনই শীতের দিনে হানা দিতেন ‘তারা’। কুয়াশামোড়া কাকভোরে গঙ্গার বুকে উঁকি দিত মাস্তুল। অন্ধকারের চাদর ভেদ করে ক্রমে ঘাটের দিকে এগিয়ে আসত প্রকাণ্ড এক রাক্ষস। দু’একজন সবে হয়তো নিমের ডাল হাতে নিয়েছে। জাহাজখানার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকত বোকাসোকা লোকগুলো।   

ক্যারিবিয়ানের দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি নয়, খোদ গঙ্গাও বহুবার সাক্ষী থেকেছে নির্মম জলদস্যুর। বাংলার মাটিতে পায়ের ছাপ ছেড়ে গেছে পর্তুগিজ কিংবা ফরাসি দস্যুরা। বঙ্গোপসাগর দিয়ে সরাসরি তারা ঢুকে পড়ত গাঙ্গেয় সীমানায়। রূপকথার ক্যারিবিয়ান জলদস্যুর মতো উদারনীতি ছিল না তাদের। গ্রামে ঢুকে চলত ব্যাপক লুটপাট-খুনোখুনি। ব্রিটিশ শাসিত ভারত বা তারও বহু আগে থেকেই চলে আসছে এই নির্মম পরম্পরা।

সাল ১৪৯৮, ভাস্কো-দা-গামা জলপথে ভারতে আসেন। এরপর, ১৫১২-১৩ সালে সুলতান হুসেন শাহের রাজত্বকালে পর্তুগিজদের আগমন ঘটে অবিভক্ত বাংলায়। ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে গঙ্গায় এসে পৌঁছায় পর্তুগিজ জাহাজ। পর্তুগিজ নাবিক ‘যোয়াও ডি সিলভেরিয়া’ ইউরোপীয় বনিক ‘গিওভান্নি দি এম্পলি’-র নেতৃত্বে চারটি জাহাজ নিয়ে নোঙর করে চট্টগ্রাম বন্দরে। সেই সঙ্গে হামলা চালিয়ে লুঠ করে ওই বন্দরে অবস্থানরত অন্যান্য দেশীয় জাহাজ। পর্তুগিজরা তাদের একচেটিয়া বানিজ্যের প্রসার করতে জলপথে লুঠ করতে শুরু করে বিভিন্ন জাহাজ। জলপথে লুণ্ঠনকারী এই বিদেশী দস্যুরা ‘হার্মাদ’ নামে পরিচিতি পায়। হার্মাদ শব্দটি এসেছে পর্তুগিজ শব্দ ‘আর্মাডা’ থেকে। যার অর্থ যুদ্ধজাহাজ। তবে বাংলায় হার্মাদ কথার অর্থ জলদস্যু। সেই সময়ে বাংলায় বিদেশি জলদস্যু হিসাবে চিহ্নিত ছিল শুধুমাত্র পর্তুগিজরাই নয়, আরাকানের (মায়ানমার) মগরাও এই তালিকাভুক্ত ছিল। গঙ্গাকে কেন্দ্র করে পর্তুগিজ এবং মগরা মিলিত ভাবে লুণ্ঠন কার্য চালাত।

বাংলায় হার্মাদদের মূল ডেরা ছিল চট্টগ্রাম, সপ্তগ্রাম ও হুগলিতে। মুঘল আমল থেকে ব্রিটিশ শাসনকালের শুরু পর্যন্ত এরা বাংলায় লাগামছাড়া ভাবে লুঠপাট চালায়। শুরুর দিকে জলপথে এদের লুণ্ঠন সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে তারা গঙ্গার উপকূলবর্তী এলাকাগুলোয় হানা দিত। সেখান থেকে বিশেষত লুঠ করত খাদ্য সামগ্রী। এছাড়াও তারা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলা থেকে নারী,পুরুষ ও শিশুদের আপহরণ করে দাস হিসাবে বিক্রি করে দিত দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন বন্দরে। এই দাস ব্যবসায় পরবর্তীকালে অংশ নেয় দেশীয় বণিকরাও। তাদের থেকেই বাংলার বিভিন্ন ক্ষমতাসম্পন্ন পরিবারের পুরুষরা নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য দাসীদের কিনে নিয়ে যেত।

সেই আতঙ্কের জেরে নদীর উপকূলবর্তী এলাকা প্রায় জনমানব শূন্য হয়ে যায়। তৎকালীন হিন্দু সমাজে মগ সম্প্রদায় ছিল সমাজে অস্পৃশ্য। কোনও মানুষকে মগেরা স্পর্শ করলে তাকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হত বা একঘরে করে দেওয়া হত। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর শিকার হত নারীরা।

বাংলায় হার্মাদদের ক্রিয়াকলাপে ইন্ধন যোগাত ‘বুলখক খানা’ বা সপ্তগ্রামের দণ্ড প্রাপ্ত আসামিরা। লুঠ করার পর দস্যুরা লুণ্ঠিত ধন-সম্পদ ও বন্দিদের নিয়ে নিজেদের বন্দরে ফিরে আসত। তারপর জয়ের ধ্বজা উড়িয়ে গান-বাজনা, মদ-মাংস সহযোগে মজলিশে মেতে উঠত তারা।

এক সময়ে পর্তুগিজ ও মগ দস্যুদের সম্পর্কে চিড় ধরে। দুই পক্ষের মধ্যে বিবাদ বাধে পর্তুগিজ অধিকৃত সন্দীপকে কেন্দ্র করে। ১৬১৮ সালে ওলন্দাজদের সহায়তায় মগরা সন্দীপ দখল করে। পরে পর্তুগিজ এবং মগ বাংলা থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের জমি হারাতে থাকে। মুঘল সম্রাট  আকবরের রাজত্বকালে পর্তুগিজ দস্যুরা সরাসরি কোন যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। সম্রাট আকবরের প্রয়াণের পর জাহাঙ্গীরের আমলে বাংলায় জলদস্যুদের উপদ্রপ বিপুল মাত্রায় বেড়ে ওঠে। সেই জন্য জাহাঙ্গীর বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেছিলেন। ঢাকায় যার নাম রাখা হয় ‘জাহাঙ্গীর নগর’। শাহজাহান তাঁর শাসনামলে হুগলি থেকে পর্তুগিজদের বিতাড়িত করতে তৎকালীন বাংলার সুবাদারকে আদেশ দেন। এর পরেই মুঘল ও পর্তুগিজরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দীর্ঘ তিন মাস ব্যাপী এই যুদ্ধ চলেছিল। এই যুদ্ধেই মুঘলরা ব্যান্ডেল থেকে পর্তুগিজ দুর্গ ধ্বংস করে দেয়। ১৬৬৬ সালে বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খানের নেতৃত্বে, ২৮৮টি রণতরী নিয়ে মুঘল সেনাপতি চট্টগ্রাম দখল করে সেখান থেকে হার্মাদদের বিতাড়িত করেন।

পরবর্তী সময়ে ইংরেজসহ অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে না পেরে পর্তুগিজরা চন্দননগরে চলে যায়।

ইংরেজ শাসনকালেও কলকাতার জনসমাজে হার্মাদ ও মগ দস্যুর ভয় থেকে গিয়েছিল। ১৭৯০ সালে ইংরেজ সরকার হাওড়ার শিবপুরে গঙ্গায় একটা বাঁধ নির্মাণ করে মগ ও পর্তুগিজ দস্যুদের অবাধ যাতায়াতের পথ চিরতরে বন্ধ করে দেয়। বাংলার বুকে অবসান ঘটে এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের।