শুভজিৎ দে|

আগামীকাল ২৫শে বৈশাখ, রবি ঠাকুরের ১৫৯ তম জন্মবার্ষিকী। তবে বিশ্ববাসীর কাছে আজও তিনি চির নবীন। রবি ঠাকুরের অসামান্য সৃষ্টিগুলির মধ্যে সহজ পাঠ একটি। পশ্চিমবঙ্গে সরকারী ও সরকারী সাহায্য প্রাপ্ত স্কুলগুলিতে সহজ পাঠ আবশ্যিক পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হয়। বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের ভাষা যতটা উচ্চতর, সহজ পাঠের ভাষা ততই সহজ ও সাবলীল। চলতি ভাষায় লেখা এই সহজ পাঠ, “ছোটো খোকা বলে অ-আ” দিয়ে শুরু।

সঠিক শিক্ষাই শিশুর ভবিষ্যতের শিক্ষা ক্ষেত্রের পরিধি নির্মাণ করে। সুতরাং শিশু পাঠদানের পর্ব পৃথিবীর সব শিক্ষিত সমাজে একটি অপরিহার্য কর্ম বলে গণ্য হয়। এই বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়, তবে বলা বাহুল্য অভিভাবকগণ যতটা না শিশুর ভবিষ্যতের কথা ভাবে তার চেয়েও বেশি ভাবে একটি নির্দিষ্ট সময় শিশুকে দূরে রেখে নিজেদের প্রয়োজনীয় কাজ করার কথা। বর্তমান দিনে পরিবার ছোটো হতে হতে বাবা-মা ও সন্তানে এসে ঠেকেছে। ফলে আগেকার দিনে বাড়ির শিশু শিক্ষার পরিবেশ বর্তমান ফ্ল্যাট সংস্কৃতিতে অধরা। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিশু শিক্ষাপাঠের অবনির্মান, যা পুরনো ঐতিহ্যকে ভাঙতে শুরু করেছে।

বিংশ শতাব্দীতেও বেশ কয়েকটি প্রাক প্রথমিক বই প্রকাশিত হয় তার মধ্যে সর্ব শ্রেষ্ঠ সংযোজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠ (প্রথম ভাগ)।অন্যান অনেক বই থাকা স্বত্বেও আজও সহজ পাঠ প্রাসঙ্গিক, এই বই শিশুদের খাবার, প্রকৃতি, গ্রাম বাংলার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। সহজ পাঠ পড়তে খুবই সাধারণ লাগলেও এর গভীরে প্রবেশ করলে মনে হবে, এটি কোনো উপন্যাসের থেকে কম নয়। বিদ্যাসাগর আমাদেরকে বর্ণপরিচয় দিলেও, রবি ঠাকুর সেই বর্ণগুলিকে দিয়েছেন সুরের ছন্দ, শব্দের জাদু। সহজ পাঠ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের (১৯৩১) বৈশাখ মাসে।

জানা গিয়েছে সহজ পাঠের দুইটি ভাগের কথা (প্রথম ও দ্বিতীয়)। কিন্তু অনেকের মতে সহজ পাঠের চারটি ভাগ। গুগল এ বিষয়ে তথ্য দেয় কেবল চারটি ভাগের ছবি দিয়ে, যেহেতু এই প্রতিবেদনটি লেখার জন্য চারটি ভাগ পাওয়া যায়নি, তাই দুইটি ভাগ নিয়েই আলোচনা করা হল। অনেকেই বলেন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগ রবীন্দ্রনাথ লিখলেও চতুর্থটি তিনি লেখেননি, লিখেছেন কোনো এক শিক্ষক। তবে এই বক্তব্য এই মুহূর্তে অনুমেয়।

সহজ পাঠের প্রথম ভাগ ৫৩ পাতার। প্রথম দিকে সব পাতায় নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি। চিত্রশিল্পের দিক থেকে এই সব চিত্রের অনেক গুণ আছে। তবে বলা বাহুল্য, ওই প্রতিটি ছবিই যে সহজ পাঠের কথা অনুযায়ী আঁকা, এমনটা নয়।

দ্বিতীয় ভাগ ৬০ পাতার বই, প্রথম ভাগের মতো এতেও অনেক ছবি আছে। তবে এসব ছবির ধরন একটু ভিন্ন। দ্বিতীয় ভাগে আছে রেখায় আঁকা ছবি। ছবিতে এমন পরিবর্তন কেন? এই প্রশ্ন মনে জাগাটাই স্বাভাবিক। রবি ঠাকুর বলেছিলেন, শিশু বই পড়ার সঙ্গে ছবিগুলো রাঙিয়ে নিতে পারে। অর্থাৎ তিনি শিশুদের রঙের সঙ্গেও পরিচয় করাতে চেয়েছিলেন।

অতি সাধারণ কথা যা বুঝতে অসুবিধা নেই, ছোট শিশুরা নিজেরাই বানান করে সহজ পাঠ পড়ে, অন্যদের পড়া শোনে, খাতায় লেখে, সেখানে তাদের বাক্যগঠন, যুক্তাক্ষরের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার সঙ্গে শিশু মনে চিরকালীন ছাপ রেখে যায় সহজ পাঠের সেই ছবিগুলি।

এর বিভিন্ন পাতায় ধরা পড়ে পশুপ্রেম, যারা পশুপাখির কষ্ট বোঝে না, তারা মানুষকে অন্তর থেকে ভালোবাসতেও শেখে না। সহজ পাঠের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগে এই মানবিক শিক্ষার প্রসঙ্গ বারবার এসেছে।

দ্বিতীয় ভাগের একাদশ, দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ পাঠে তিনটি গল্প আছে, যেখানে আছে পারস্পরিক সাহায্যের শিক্ষার কথা। আর এখানেই সহজ পাঠ কৃতিত্ব রাখে। ছেলেবেলায় পড়া সব কিছু ভুলে গেলেও, সহজ পাঠের সেই শিক্ষা ভোলা যায় না।

প্রথম ভাগের তিপান্ন ও দ্বিতীয় ভাগে ষাট, সর্বমোট একশো তেরো পাতা। তার মধ্যে ছবি, বড় বড় অক্ষর, ছাড়া ছাড়া লাইন, কতটাই বা আর লেখা! তবু যতবার পাতা ওল্টানো যায় ততবারই যেন নতুন কিছু চোখে পড়ে।  

কিন্তু আমরা কি রবীন্দ্রনাথের সেই সহজ পাঠের শিক্ষার মান রেখেছি? এখানেই মনে পড়ে অপূর্ব দত্তের লেখা একটি কবিতার কথা। বাংলা টাংলা কবিতার একটি লাইন যেখানে কবি শিশুর মায়ের মুখে কথা বসিয়েছেন তাও ছোট্ট শিশুর সামনেই সেই মা, শিশুটির বাংলা বিষয়ের প্রতি অনীহাকে তুলে শিশুটির বাবাকে বলছে, “চুপ করো তো, ওর ফল্টটা কিসে, স্কুলে কেন বেঙ্গলিটা পড়ায় না ইংলিশে?” আর এই ইংলিশে “বেঙ্গলি সহজ পাঠ” পড়াবার চক্কোরে আমরা করছি না তো রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান? এই উদ্বেগের কারণ বিগত কয়েক বছর বই মেলা বা কলেজ স্ট্রিটে খুঁজলেই পাওয়া যাবে, সহজ পাঠের ‘বেংলিশ’ সংস্করণ। বাংলা উচ্চারণ ইংরেজী শব্দে (Bengali Phonetic Language) যেমনটা আমরা মেসেজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করি। আর এখানেই প্রশ্ন, সেই শিশু কি প্রকৃত সহজ পাঠ শিখছে? পরিচিত হচ্ছে গ্রাম বাংলার প্রকৃত রসের সঙ্গে? সেটা আপনারাই বিচার করুন।

তথ্যসূত্রঃ সহজ পাঠ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর থেকে বেগম রোকেয়া শিশু শিক্ষার সারথি – কাজী সুফিউর রহমান, সহজ পাঠ – অচিন্ত্য দাস এবং উইকিপিডিয়া

ছবিঃ উইকিপিডিয়া