শুভজিৎ দে|
তাঁকে ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল প্রাণের চেয়েও প্রিয় অওয়ধ। নবাবি চলে যাওয়ার মুহূর্তেও চোখে জল আসেনি। তিনি মনে করতেন, একমাত্র সঙ্গীত এবং কবিতাই প্রকৃত পুরুষের চোখে জল আনতে পারে। তিনি অওয়ধের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। রাজ্য হারা নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ জীবনের শেষ তিরিশ বছর কাটিয়েছিলেন কলকাতাতেই।
সে উনিশ শতকের কথা। তখন বাংলা বানানে লখনউ ছিল অন্য রকম, “লক্ষ্ণৌর বাদশা কয়েদ থেকে খালাস হয়ে মুচিখোলায় আসায় শহর বড় গুলজার হয়ে উঠল।”, লিখছেন হুতোম। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ দিয়েই মুখপাত শ্রীপান্থের ওয়াজিদ-দর্শনের। অযোধ্যার সদ্য রাজ্য হারা নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ, কোম্পানির পেনশন নিয়ে লখনউয়ের কোনও প্রাসাদে নিশ্চিন্তে থাকতেই পারতেন। তা না করে ছুটলেন কলকাতায়। ইচ্ছে, কাউন্সিলের কর্তাদের কাছে সওয়াল করবেন সিংহাসন উদ্ধারের জন্য। সফল না হলে যাবেন লন্ডনে, রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে। ইংরেজের ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে তাঁর মোহ তখনও কাটেনি। পরিস্থিতির চক্রব্যূহে কোনও কিছুই শেষ পর্যন্ত কাজে এল না, পেনশন নিতে রাজি হয়ে কলকাতাতেই জীবনের বাকি তিরিশটা বছর কাটিয়ে দিলেন ওয়াজিদ আলি। সেটাই হল কাল, লখনউ থেকে সরে গিয়ে মূল স্রোতের ইতিহাস থেকেও হারিয়ে গেলেন তিনি।

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জ্বলে উঠল মহাবিদ্রোহের আগুন। তখনও কলকাতায় ভাল ভাবে থিতু হননি ওয়াজিদ আলি, নিতে রাজি হননি পেনশনও। কারণ লন্ডনে তখন ‘আউধ মিশন’ সক্রিয়, তাঁর হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন মা বেগম আউলিয়া এবং সহযোগীরা। সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাওয়ায় সে গুড়েও বালি পড়ল। ব্রিটিশ জনমত পুরোপুরি ঘুরে গেল ভারতীয়দের বিরুদ্ধে। এদিকে কোম্পানির সরকার হঠাৎ মেটিয়াবুরুজের অস্থায়ী বাসস্থান থেকে গ্রেফতার করল ওয়াজিদ আলিকে। ষড়যন্ত্রের অভিযোগ একটা তোলা হয়েছিল বটে, তবে তা ছিল ভিত্তিহীন। ওয়াজিদ নিজে বিদ্রোহ সমর্থন করেননি, লখনউয়ে তাঁর বেগম হজরত মহল, ছেলে বিরজিস কদ্রকে নতুন নবাব ঘোষণা করে। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিলেও পাছে বিদ্রোহীরা জোর করে ওয়াজিদকে নেতা হিসাবে তুলে ধরে, হয়তো সেই ভয়েই তাড়াতাড়ি ফোর্ট উইলিয়ামে গৃহবন্দি করা হয় তাঁকে। সেখানে থাকতে হল ২৫ মাস, বিদ্রোহ মিটে যাওয়ারও আট মাস পর তিনি ছাড়া পান, মেনে নেন পেনশনও। এই সময় থেকেই মেটিয়াবুরুজের নবাবির সূচনা। আর তাই ইতিহাসের বইয়ে বেগম হজরত মহল যেটুকু গুরুত্ব পেয়েছেন, রাজ্যচ্যুত নবাব তা-ও পাননি।
যখন বুঝলেন বাকি জীবনটা কলকাতায় কাটাতে হবে, ঠিক কী করতে চেয়েছিলেন ওয়াজিদ আলি? রাজ্য না থাক, মোটা মাসোহারা তো আছে। ফেরত পেয়েছেন রাজকীয় গয়না, মণিমুক্তোও। তাই দিয়ে আবার নতুন করে জীবন শুরু করলেন। ‘মেটিয়াবুরুজে যেন লক্ষ্মৌর সূর্যাস্তের আভা।’ আসলে মেটিয়াবুরুজের চার দেওয়ালে ঘেরা জগৎ ছিল বাইরের পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। ওয়াজিদ আলি (১৮২২-১৮৮৭) যত দিন জীবিত ছিলেন, সেখানে টিকে ছিল মুঘল দরবারি সংস্কৃতির শেষ ছায়া। যে ছায়া খোদ এই সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র দিল্লি থেকে বিদায় নিয়েছিল ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের অনেক আগেই।

মাঝের তিরিশ বছরে কত কী ঘটে গিয়েছে। ১৮৫৮-য় কোম্পানির হাত থেকে ভারত শাসনের দায়িত্ব রানির হাতে যাওয়া দিয়ে শুরু; শেষ পর্বে ১৮৮৫-তে তৈরি হয়েছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। মাঝে একের পর এক ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনে কলকাতা উত্তাল। বাংলায় নবজাগরণের ঢেউ। নবাব কিন্তু এ সবের বাইরে, কাছে থেকেও দূরে। পশ্চিমি কেতার প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল না। তাঁর আমলে লখনউয়ের সাংস্কৃতিক জীবনে হিন্দু-মুসলমানের পুরাণ, উপকথা, লোকগাথার বিশেষ প্রভাব। মেটিয়াবুরুজেও তা বদলায়নি।
ওয়াজিদ আলির বিরুদ্ধে কোম্পানির শাসনকর্তাদের অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ইংরেজের কাছে যে যে কারণে তিনি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেননি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই কারণগুলির জন্যই তিনি পথিকৃতের মর্যাদা পেতে পারেন। রমণীবিলাস (সারা জীবনে তাঁর স্ত্রীর সংখ্যা প্রায় ৩৭৫ জন) ছাড়া তাঁর নাচ-গানে অতিরিক্ত আসক্তিই ব্রিটিশের আপত্তির প্রধান কারণ ছিল।

তখনও তিনি নবাব হননি, ১৮৪৩ সালে ভাই সিকন্দর হাসমতের সম্মানে এক জলসার আয়োজন করেন ওয়াজিদ আলি। সেখানে নিজের লেখা নাটক ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ করেন। এই কিস্সাকেই বলা যায় প্রথম আধুনিক উর্দু নাটক। কৃষ্ণ ছিলেন তাঁর রোল মডেল। যমুনা তীরে পূর্ণিমা রাতে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলা নবাবের চিরকালীন অনুপ্রেরণা ছিল। কৃষ্ণের রাসলীলা থেকেই লখনউয়ে ‘রহস’-এর সৃষ্টি। ওয়াজিদ আলির রহস বস্তুত অপেরা, যেখানে তিনি ব্রজ অঞ্চলে কৃষ্ণের জীবন নিয়ে প্রচলিত নৃত্যের সঙ্গে নিজস্ব কত্থকের কম্পোজিশন মিলিয়েছিলেন। রহস নাটক হল নৃত্যনাট্য, যেখানে নির্দিষ্ট গল্প থাকত। লখনউয়ে নবাবির সময় ওয়াজিদ আলি মোট চারটি জলসার আয়োজন করেন, আর মেটিয়াবুরুজে ১৮৫৯ থেকে ১৮৭৫-এর মধ্যে অন্তত ২৩টি।
ইতিহাস বলছে, ১৮৫৬ সালের ৬ মে কলকাতায় পৌঁছান নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। মেটিয়াবুরুজে রাতারাতি যে ছোট লখনউ গড়ে তুলেছিলেন ওয়াজিদ আলি, তাঁর মৃত্যুর পর ততটাই দ্রুততায় তাঁর সব স্মৃতি মুছে ফেলেছিল ব্রিটিশ সরকার। সে সময়কার নবাবি দফতরের কোনও নথিপত্র রক্ষা পায়নি বললেই চলে, নবাবের লেখা কিছু বই ছাড়া। নবাব তৈরি করেন প্রাসাদ, বাগবাগিচা, চিড়িয়াখানা। এরই সঙ্গে অওয়ধ থেকে তিনি কলকাতায় এনেছিলেন ঘুরি ওড়ানো, কবুতরবাজি ৷ এখানেই শেষ নয়, এই ওয়াজিদ আলির জন্যই কলকাতা বিরিয়ানির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। তাঁর রসনা তৃপ্তির জন্যই এ শহরে ‘দমপোখ্ত’ বা ঢিমে আঁচে রান্না শুরু হয়। অনেকে বলেন, বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলন নাকি ওয়াজিদ আলি শাহই করেছিলেন।
তথ্যসূত্রঃ দ্য স্টেটস ম্যান, মুঘল ভারতের সঙ্গীত চিন্তা – রাজেশ্বর মিত্র, অযোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ – দিলীপকুমার মুখার্জী, মেটিয়াবুরুজে নবাব – শ্রীপান্থ, Oudh and the East India Company (1785-1801) lucknow – P. BASU
ছবিঃ স্টেটস ম্যান, শুভজিৎ দে (নবাবের সমাধি)