ধ্রুবজ্যোতি বোস|

হাতে যদি তিন দিনের ছুটি থাকে আর ঘরে যদি মন না টেকে, এবং আপনি যদি বাঙালি হয়ে থাকেন, তাহলে দিঘার কথা আপনার সবার আগে মনে পড়বে। কলকাতা থেকে ১৮৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত সৈকত শহর দিঘা। দিঘা আবার দুই ভাগে বিভক্ত, পুরনো দিঘা ও নতুন দিঘা। কিন্তু শুরুর দিকে এমনটি ছিল না। বীরকুল নামের একটি গ্রাম থেকে আজকের সৈকত শহর দিঘা অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের গোয়া হয়ে ওঠার পেছনে ইংরেজদের অবদান রয়েছে।

তখন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য জাঁকিয়ে বসেছ, তৎকালীন চতুর্থ গভর্নর ও ৭৩-এর রেগুলেটিং আ্যক্ট অনুযায়ী, প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস দিঘার আবিষ্কর্তা। এই জায়গাটিকে তিনি বলতেন ‘ব্রাইটন অফ ক্যালকাটা’। সমুদ্রস্নান, মাছ ধরা ও মনোরম পরিবেশে ছুটি কাটাতে তিনি ১৭৭৫ সালে একটি বাংলো বানান। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যান্য অফিসাররাও এই বাংলোতে তাদের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ছুটি কাটাতে আসতেন। সে সময় বীরকুল হয়ে উঠেছিল ইংরেজদের কাছে গরমের ছুটি কাটানোর একটা আদর্শ জায়গা। কিন্তু সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস এবং পাড় ভেঙে যাওয়ার ফলে হেস্টিংসের সাধের বাংলোটি সমুদ্রের জলে তলিয়ে যায়।

কাঁথি প্রভাতকুমার কলেজের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রেমানন্দ প্রধানের ‘হিজলিনামা’ বইতে তিনি বলেছেন, “অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সরকারের সেটলমেন্টের রেকর্ড হয়। সেই রেকর্ড অনুযায়ী, বীরকুল নামে ওড়িশার জলেশ্বর চাকলার অধীনে থাকা একটি পরগনার উল্লেখ ছিল। ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ভ্যালেন্টিন ও ১৬৬৮ সালের টমাস বৌরির মানচিত্রে বতর্মান কাঁথি মহকুমা শহর থেকে ২৪ মাইল দূরে দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে ‘নরিকুল’ বলে একটি সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের অস্তিত্ব নজরে আসে। ১৭০৩ সালে পাইলট মানচিত্রে ‘নরিকুল’ জায়গার পাশেই ‘বিটকুল’ নদীর অবস্থান দেখা যায়। পরে রেনেলের মানচিত্রে নরিকুলের জায়গায় বীরকুলের অস্তিত্ব ধরা পড়ে।”

আবার, মুগবেড়িয়া কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ এবং লেখক হরিপদ মাইতি-এর  ‘মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ গ্রন্থ থেকে জানা গিয়েছে, “১৭৬০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বদলে মীরকাশিম দ্বিতীয়বার বাংলা, বিহার ও ওড়িশার নবাব হওয়ার প্রতিদানে ‘চাকলা মেদিনীপুর’, ‘চাকলা বধর্মান’ ও ‘চাকলা চট্টগ্রাম’-এর অধিকার ছেড়ে দেন। সেই সময় চাকলা মেদিনীপুরের ৫৪টি পরগনার মধ্যে একটি পরগনা ছিল বীরকুল। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ওড়িশার উপকূলকে লিজ নেওয়ায় ব্যর্থ হন বাংলার তৎকালীন গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস। সেই সময় দক্ষিণ পশ্চিম মেদিনীপুরের ওড়িশা সীমান্ত লাগোয়া উপকূল অঞ্চল বীরকুল পরগনা তাঁর নজরে আসে।”

এছাড়া, জেমস অগাস্টাস হিকি সস্পাদিত বেঙ্গল গেজেট পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বীরকুল গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেটি মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত। তবে ওয়ারেন হেস্টিংস দিঘার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন না। দিঘার প্রথম বাসিন্দা হলেন কলকাতার জুয়েলারি ও ঘড়ি তৈরির একমাত্র স্বনামধন্য কম্পানির (হ্যমিলটন অ্যান্ড কোম্পানি) মালিক ফ্রাঙ্ক স্নেইথ।

১৯২৩ সালে বিভিন্ন নথিপত্র ঘেটে তিনি বীরকুলের কথা জানতে পারেন। তারপর যখন হাতির পিঠে চেপে তিনি বীরকুলে এসে উপস্থিত হন তখন তিনি সমুদ্রের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বীরকুলকে দেখে সমুদ্রের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই তিনি থাকার জন্য একেবারে সমুদ্রের পাড় লাগোয়া ১১.৫ একর জমি লিজ নেন। তারপর সেখানেই তৈরি করেন তার পছন্দসই কলোনিয়াল রাজের ছাপে রানসউইক হাউস। যদিও বছরের ছ’মাস তিনি এই বীরকুলে থাকতেন। তবে বীরকুলের নাম কীভাবে দিঘা হল তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। অনেকের মতে দিঘার মোহনায় বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে বীরকুলের যে নদীটির (চম্পা) সংযোগ রয়েছে তাকে স্থানীয় বাসিন্দারা আগে দিঘি বলতেন। মনে করা হয়, সেই দিঘি থেকেই ওই জায়গা পরে দিঘা নামে পরিচিতি লাভ করে।

এমনটাও জানা যায়, ফ্রাঙ্ক স্নেইথ বেহালা ফ্লাইং ক্লাব থেকে প্লেনে চেপে দিঘায় যাতায়াত করতেন। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধানচন্দ্র রায়’কে  দিঘা শহরকে জনপ্রিয় সৈকত নগরী ও পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য ও কলকাতা-দিঘা সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা উন্নতির জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন।

১৮ ডিসেম্বর, ১৯৬৪ সালে ফ্রাঙ্ক স্নেইথ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে, দিঘাতে তার প্রিয় রানসউইক হাউস বাংলোতেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। তবে জানা গিয়েছে পরে এটি বিক্রি হয়ে যায়। দিঘা ঢোকার মুখে অবস্থিত বর্তমান সরকারের তৈরি দিঘার প্রবেশদ্বার পেরিয়ে কিছুটা এগোলে রাস্তার বাঁ দিকে ফ্রাঙ্ক স্নেইথ সাহেবের রানসউইক হাউস অবস্থিত, বর্তমানে এখন এটি রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

তথ্যসূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা (সুব্রত গুহ-র রিপোর্ট), উইকিপিডিয়া

ছবিঃ উইকিপিডিয়া এবং ভ্রমণ গাইড, গুগল ম্যাপ