শুভজিৎ দে|
আজ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস। বাঙালি জাতির সংগ্রামী ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন একটি যুগান্তকারী ঘটনা। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার এই আন্দোলনে তৎকালীন ছাত্র-যুব নেতাসহ অনেকেই নানাভাবে ভূমিকা রেখেছেন। বুকের রক্ত দিয়ে ইতিহাস হয়ে রয়েছেন সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত, শফিউর সহ আরও অনেকে। এই আন্দোলনের সূচনাকাল থেকে পরিণতি পর্যন্ত সকলের ভূমিকার কথা যেভাবে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, লেখালেখি বা স্মৃতিচারণের মধ্যে উঠে আসে সেভাবে উঠে আসে না সমকালীন ছাত্র ও যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকার কথা।
কেউ কেউ বলে থাকেন, “শেখ মুজিবুর তো তখন জেলে ছিলেন, তিনি আন্দোলনে থাকবেন কী করে!” অথচ ভাষা আন্দোলনের সূচনাকালে বিভিন্ন স্থানে মিছিল, সমাবেশ থেকে শুরু করে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও সাধারণ ধর্মঘট চলাকালীন পুলিশের হাতে প্রথম যারা গ্রেফতার হন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
সমগ্র পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬.৪০ ভাগ মানুষ ছিল বাংলা ভাষাভাষী। দ্বিতীয় স্থানে ছিল পাঞ্জাবি ভাষাভাষী ২৮.৫৫ ভাগ মানুষেরা এবং পঞ্চম স্থানে ছিল উর্দু ভাষাভাষী মাত্র ৩.২৭ ভাগ মানুষ। অথচ সেই সংখ্যালঘু মানুষের ভাষা উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতির প্রতিক্রিয়ার কথা সামান্যটুকু না ভেবেই ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক সমাবেশে করেছিলেন তিনি। সেখানে জিন্নাহ বলেছিলেন, “পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনও ভাষা নয়।” এ ব্যাপারে ভিন্ন মত প্রকাশকারীদের তিনি ‘রাষ্ট্রের শত্রু’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ওই সভাতেই জিন্নাহ’র বক্তব্যের প্রতিবাদে ‘না-না’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছিল।
২৪ মার্চ কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও জিন্নাহ যখন একই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেন, সেখানেও ছাত্র নেতৃবৃন্দ ‘না-না’ ধ্বনির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলেন।
অবশ্য বাংলা ভাষা আন্দোলনের বীজ রোপিত হয় আরও আগে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে কথা বলার সুযোগ রাখা হয় কেবল উর্দু এবং ইংরেজিতে। কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু এবং ইংরেজির সাথে বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষারূপে সরকারি স্বীকৃতির দাবি তুলেছিলেন। যদিও তাঁর দাবিকে প্রাধান্য দেননি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও অনেকে।
ভাষা নিয়ে মুসলিম লীগ নেতারা যে ষড়যন্ত্র করেছিল তার প্রতিবাদ করে যে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল সেখানে ধীরেন্দ্রনাথসহ নিজের ভূমিকার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে শেখ মুজিবুরলিখেছিলেন, “আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে উর্দুকে স্বীকৃতি দেওয়ার পিছনে। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভার আহ্বান করে ‘রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল।”
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করা হল। এদিকে আন্দোলনের প্রাথমিক স্তরে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত ছাত্র সমাজের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও সাধারণ ধর্মঘট চলাকালীন পুলিশি আক্রমণে বহু ছাত্র আহত হন এবং শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শামসুল হক, শওকত আলী ও গোলাম মাহবুবসহ বিপুল সংখ্যক ছাত্র নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বিচারে গ্রেফতার ও নির্যাতনের কারণে বিক্ষোভ প্রশমিত না হয়ে আরও তীব্র হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে পদ্মায় বয়ে গেছে বহু জল। বস্তুত, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে যে রক্ত ঝরে, তার উত্তপ্ত ধারার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, পাক শাসকগোষ্ঠীর নেতৃত্বে বাঙালিরা কোনও দিন তাদের মান-মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না।
শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় বাঙালি জাতি। অবশেষে তাঁর নেতৃত্বে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করে এবং সেই সাথে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলার মর্যাদা। বলা যতটা সহজ কাজটা ততটাও সহজ ছিল না। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারের মতো অনেকেরই রক্তের বিনিময়ে পাওয়া গিয়েছিল এই মিষ্টি বাংলা ভাষা ও স্বাধীনতা। পরিশেষে তাই হৃদ্বয় বলে ওঠে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি!”
তথ্য সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম: রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ফিরে দেখা : আশীষ কুমার দাস (সম্পা.)