গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক|

বাগান অনেকের বাড়িতেই রয়েছে। তবে সব মানুষের সখ বা চাহিদা এক নয়। এখন অনেক গাছপালাই ঘরের ভিতরে বেড়ে উঠছে, যার পোশাকি নাম হাউস প্ল্যান্ট। ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এই সকল গাছের জুরি মেলা ভার। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে মানুষের চাহিদাও। এই জন্যই হয়তো জীবন্ত পোকা ধরে খেয়ে ফেলা অদ্ভুত গাছগুলোর ইনডোর প্ল্যান্ট হিসেবে চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পতঙ্গভুক, মাংসাশী বা শিকারি গাছগুলোর কথা ভাবলেই সত্যজিৎ রায়ের লেখা ‘সেপ্টোপাসের ক্ষিদে’ গল্পের মাথায় আসে, যা বাস্তব অর্থে অনেকটাই কল্পনাপ্রসূত। আমরা প্রায় সকলেই জানি এই পতঙ্গভুক উদ্ভিদগুলি প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতেই পোকামাকড় শিকার করে খায়। এই কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জলাশয়ে যেখানে শিকড় বিস্তার করে পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করা খুবই কঠিন, সেখানে পতঙ্গভুক গাছগুলি জন্মাতে দেখা যায়। নিজেদের রঙিন সৌন্দর্যে মোহিত করে অথবা নিঃসৃত মিষ্টি রসের লোভে প্রলুব্ধ করে কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে বেশ বড় আকৃতির পোকাকেও ফাঁদে ফেলে হজম করে নেয় গাছগুলি। নিজেদের একঘেয়েমি কাটাতে এবং বাগানে অভিনবত্ব আনতে আজকাল খুবই পতঙ্গভুক উদ্ভিদের প্রতি ঝুঁকছেন বাগানিরা।

দেখতে গেলে সারা বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পতঙ্গভুক উদ্ভিদ রয়েছে। যেগুলির আকার-আকৃতি, গড়ন, রং-রূপ এবং শিকার ধরার কৌশল একটিকে অপরটির থেকে আলাদা করেছে। কেবলমাত্র চিরতুষারাবৃত অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই এই উদ্ভিদ জন্মায়। তবে এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতেই এদের বেশি দেখা মেলে। মূলত শরীরে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি মেটাতেই এসব শিকারি গাছগুলি শিকার ধরে থাকে। তবে পোকামাকড়ের পাশাপাশি কালেভদ্রে ছোট পাখি, ব্যাঙ বা ইঁদুরকেও ফাঁদে ফেলে খেয়ে নেয় এই মাংসাশী গাছগুলো। বলা বাহুল্য এদের সব প্রজাতি কিন্তু হাউস প্ল্যান্ট হিসাবে লাগানোর জন্য উপযুক্ত নয়। হাউস প্ল্যান্ট হিসেবে যে সকল শিকারি গাছ বাগানিদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষস্থান জুড়ে আছে সেগুলি হল – ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপ, পিচার প্ল্যান্ট, বাটার ওয়ার্ট, সানডিউ (সূর্য শিশির) প্রভৃতি।

ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপ

পতঙ্গভুক উদ্ভিদের মধ্যে বাগানিদের সবচেয়ে জনপ্রিয় হল ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপ। এই ভীষণদর্শন গাছটি কিছুটা হা করা চোয়ালের মতো পাতাযুক্ত। আবার রং-রূপে সত্যিই নয়ন মনোহর। এই পাতাগুলোর ধারজুড়ে চোখের পাপড়ির মতো অংশ থাকে, যা শিকারের উপস্থিতি সম্পর্কে গাছটিকে জানিয়ে দেয়। মিষ্টি গন্ধের রসের লোভে পড়ে এবং টুকটুকে রঙের মোহে পোকামাকড় এই হা-করা (খোলা) পাতার মাঝে গিয়ে বসলেই তা বুজে যায়। এবার পাচকরসের ক্রিয়ায় পোকাটিকে ধীরে ধীরে (প্রায় ১ সপ্তাহ ধরে) হজম করে ফেলে সুন্দরী ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপ। বাড়িতে রাখলে মশা-মাছি না থাকলে এতে কিছুটা নাইট্রোজেন জাতীয় সার প্রয়োগ করতে হয়।

কলসপত্রী বা পিচার প্ল্যান্টস

এই গাছ মাংকি কাপ নামেও পরিচিত। এর চোঙের ন্যায় লম্বা কলসি আকৃতির পাতার ভেতরে থাকে সুগন্ধি রস। আঠালো মধুর মতো মিষ্টি সেই রস খেতে গিয়ে পোকামাকড় সহজেই আটকে যায়। কারণ ওই কলসির মতো পাতার ভেতরে থাকে নিম্নমুখী মিহি কাঁটার মতো আঁশের স্তর। পিচ্ছিল এই স্তর পোকাকে দ্রুত কলসির ভেতরে নিয়ে যায় এবং বের হতে দেয় না। রস খেয়ে সেই রসেই পতঙ্গের করুণ মৃত্যু ঘটে কলসির ভেতরে। শুকনো পাতাচূর্ণ ওই কলসির ভেতরে পড়লেও নাইট্রোজেনের ঘাটতি কিছুটা দূর হয় এই জাতীয় গাছের। তাই ঘরের ভেতরে লাগালে পাতা চূর্ণ দিয়েও বাঁচে এই গাছ।

সানডিউ বা সূর্য শিশির

পতঙ্গভুক গাছের মধ্যে ঘরোয়া বাগানে রাখার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হল সানডিউ বা সূর্য শিশির। লম্বায় এক থেকে তিন ইঞ্চির হয় এই গাছগুলি। সবুজ পাতার গায়ে লালচে রোমে আবৃত থাকে। খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধিও করতে পারে এই গাছ। এর রোমগুলোর গায়ে শিশিরকণার মতো রসের বিন্দুগুলো থাকে, যা এতটাই আঠালো যে পোকামাকড় এতে আটকে পড়ে এবং পাচকরসে মারা পড়ে। সানডিউ বা সূর্য শিশির রাখতে বেশ আলোকোজ্জ্বল পরিবেশের প্রয়োজন। বারান্দা বা জানালার কার্নিশে রাখলে এই গাছ ভালো থাকবে।

বাটারওয়ার্ট

আপাতদৃষ্টিতে একেবারে সাধারণ গাছের মতো সবুজ বা লালচে পাতাওয়ালা হয় গাছগুলি। এতে কোনও পোকামাকড়র বসলেই আটকে যায়। কারণ, এই গাছের পাতা থেকে রেজিনের মতো আঠালো একধরনের রস নিঃসৃত হয়, যা একই সঙ্গে পোকাকে আটকে ফেলতে এবং হজম করতে সহায়তা করে।

ঘরোয়া বাগানে এক ব্যতিক্রমী আমেজ নিয়ে আসতে পারে পতঙ্গভুক উদ্ভিদ। আর সঙ্গে রোমাঞ্চকর ব্যাপারটি তো রয়েছেই। তবে খেয়াল রাখবেন, এই গাছগুলোকে যেন অতিরিক্ত পোকামাকড় না খাওয়ানো হয়।

সূর্য শিশির ছাড়া বাকি সব পতঙ্গভুক উদ্ভিদগুলি শীতকালে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। তবে একটু গরম পড়লেই শুরু হয় রূপ, রঙ এবং রসের ছলনায় শিকার প্রক্রিয়া। বর্তমানে বহু নার্সারিতেই শিকারি গাছ পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া অ্যামাজনের ন্যায় অনলাইন শপিং সাইটগুলিতেও এসব গাছের বীজ পাওয়া যায়। সর্বসাধারণের কাছে এই গাছ খুব একটা পরিচিত না হলেও ব্যতিক্রমী ইনডোর প্ল্যান্ট হিসেবে গাছগুলোর আলাদাই কদর রয়েছে অভিনব বাগানিদের কাছে।

ছবিঃ পিক্সাবে