গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক।
সারা পৃথিবীকে জালের মতো ঘিরে ফেলছে করোনাভাইরাস। মঙ্গলবার সন্ধে সাতটা পর্যন্ত পাওয়া পরিসংখ্যান বলছে সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৯৫,৫৩২ জন এবং প্রাণ হারিয়ছেন ১৭,২২৯ জন। তবে আশার কথা এই যে এই ভাইরাসের কবল থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১০৩,৭১৯ জন। তবে এই পরিসংখ্যান কিন্তু মিনিটে মিনিটে মিনিটে বদলে যাচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে যে খবর প্রচারিত হয়েছে তাতে, ২০১৯-এর ডিসেম্বরে চিনের উহান শহরে একটি বাজারে সামুদ্রিক প্রাণী এবং জ্যান্ত পশুর মাংস বিক্রির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস (যদিও এই বিষয়টি এখনও প্রমাণিত হয়নি)। বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল ‘নেচার’-এ চিনের গবেষকরা জানিয়েছেন, প্যোঙ্গোলিন নামে স্তন্যপায়ী প্রাণীটি COVID-19-এর জন্য দায়ি। নির্বিচারে প্রাণী হত্যা এবং প্রয়োজনে জ্যান্ত প্রাণী হত্যা করে তার মাংখ খাওয়া চিনাদের বহুদিনের রেওয়াজ। তবে করোনাভাইরাস ভয়াবহ আকার ধারণ করার পর চিন প্রশাসন বন্য প্রাণীর চাষ এবং তা খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন আমাদের প্রকৃতি এবং মারণাত্মক মহামারির মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে। বই পড়ে সেকথা জানা গেলেও মনে রাখেন আর ক’জন! কিন্তু মানুষের জন্য এই যোগসূত্র আজ অবহেলিত। আর এই অবহেলার ফল যে কী মারাত্মক এবার তা বোধ হয় এবার টের পাওয়ার সময় এসে গেছে। এই সূত্রেই বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে করোনাভাইরাস কিন্তু শেষ মহামারি নয়। ভবিষ্যতে মানবজাতি প্রত্যক্ষ করতে চলেছে ভয়ঙ্কর কিছু মহামারি!
সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রবিদ তথা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকসের ক্যাম্পেইন ফর নেচারের একজন সদস্য ডঃ এনরিক সালা দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টতে দেওয়া সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন, ‘আমরা যদি প্রাকৃতিক জগতকে ধ্বংস করার পদ্ধতি, বৃক্ষচ্ছেদনের পদ্ধতি এবং বন্যপ্রাণীদের খাওয়ার এবং ওষুধ তৈরির জন্য আটক করে রাখার পদ্ধতি অব্যাহত রাখি, তাহলে আমি নিশ্চিত যে, এ জাতীয় আরও অনেক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
প্রসঙ্গত, এর আগে ইবোলা নিয়ে গবেষণা করার সময়ে থেকেই গ্রন্থকার ডেভিড কোয়াম্মেন মহামারি হলে কী কী ঝুঁকি বেড়ে যায় তা নিয়ে মানুষকে সতর্ক করে আসছেন। দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে, তিনি জানিয়েছেন ‘আমাদের বাস্তুতন্ত্র অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়, যা বহু প্রজাতির বন্য প্রাণী, গাছপালা, ছত্রাক এবং ব্যাকটিরিয়ায় পরিপূর্ণ। আর এই জৈবিক বৈচিত্র্যের মধ্যে অনন্য কিছু ভাইরাসও রয়েছে। পাশাপাশি তিনি আরও বলেন, ‘যখন আমরা গ্রাম তৈরি করতে মাঠের পর মাঠ বনাঞ্চল কেটে সাফ করে ফেলি, বন্য পশু-প্রাণীকে খাওয়ার জন্য বন্দি করি, তখনই আমরা ভাইরাসকে নিজেদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ করে দিই’। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বুঝিয়ে বলেন, ‘মনে করুন আপনি যদি কোনও পুরনো শস্যাগার ভেঙে দেন তখন ধুলো উড়ে যায়। একইভাবে আপনি যখন বনাঞ্চল ধ্বংস করেন তখন ভাইরাসগুলি প্রকৃতিতে ঠিক এইভাবেই ছড়িয়ে যায় এবং তা সহজেই মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে।’ আর এর ফলেই বাড়তে থাকা তাপমাত্রা রোগ-বালাই ছড়ানোর একটা অনুকূল পরিবেশ লাভ করে।
এ প্রসঙ্গে বলা ভাল, গত বছর আমাজনের জঙ্গলের পুড়ে যাওয়ার খবরে কেঁপে উঠেছিল সারা বিশ্ব। আর সেই পুড়ে যাওয়া জঙ্গল সাফাই করতে নেমেছিলেন ব্রাজিলের ইটাইটুবার কৃষকরা। এরপর সমীক্ষায় উঠে আসে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য, যেখানে দেখা গিয়েছে গত ৫০ বছরে আমাজনের জঙ্গলের ১৭ শতাংশই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের কথায় মানুষ যত বেশি করে অরণ্যচ্ছেদন করে ততই মানুষ বন্যপ্রাণীর সন্নিকটে চলে আসে। এর ফলে বন্যপ্রাণীর মারফত বিভিন্ন সংক্রমক ব্যাধি খুব সহজেই মানবজাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বন্যপ্রাণীর বৈচিত্র অনেকটা অতল জলাধারের মতো, যার অনেককিছু সম্পর্কেই আমরা কিছুই জানি না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সারা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ এই ধরণের সংক্রমক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় প্রতি বছর।
আর সেই কারণেই প্রতিনিয়ত প্রকৃতি যেভাবে রূপ পরিবর্তন করছে, তাতে করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করা আজ বিশেষভাবে জরুরী। সেই নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে আলাপ-আলোচনা হলেও বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশগুলি তাতে বিশেষ আমল দেয়নি। কিন্তু পরিবেশবিদদের দাবি, সময় এসে গিয়েছে, এবার কষে হাল ধরার পালা। কারণ সারা বিশ্বজুড়ে যেভাবে জনবিস্ফোরণ হচ্ছে তাতে ২০৫০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা ২ বিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৯.৭ বিলিয়ন হতে চলেছে। যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে খাদ্যের চাহিদা। খাদ্যের অপ্রতুলতার সঙ্গে পাল্লা দিতে মানুষ ফের কোপ বসাবে প্রকৃতির ওপর, বন্যপ্রাণীর ওপর। আর তার ফলেই ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাস্তুতন্ত্র। আর পরিবেশবিদরা এটাই আশঙ্কা করেছেন যে, ফের এমনটা হলে কিন্তু করোনার থেকেও ভয়ানক মহামারির কবলে পড়বে মনুষ্যজাতি।
তথ্যসূত্র: দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ইউকে