গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক|

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে টেলিগ্রাফের খটখট শব্দ ছিল এক রোমাঞ্চের মত। সে তখন এক ষ্টার গ্যাজেট। বিদ্যুতের সাহায্যে তারের মাধ্যমে সে পৌঁছে দিত কোডেড মেসেজ। কিন্তু একবারে একটার বেশি মেসেজ সে পাঠাতে পারতো না। গবেষণা কি কখনো থেমে থাকে! উন্নততর পদ্ধতি তথা যন্ত্র আবিষ্কারের চলল জল্পনা। চলল এক্সপেরিমেন্টের পর এক্সপেরিমেন্ট। বহু বিজ্ঞানী ইতিমধ্যেই অংশগ্রহণ করেছিল সেই যন্ত্র আবিস্কারের কর্মযজ্ঞে যেখানে শব্দকে প্রেরণ করা সম্ভব হবে। 

চেষ্টা কখনো বিফলে যায় না। এক্ষেত্রেও আলাদা কিছু ঘটলো না। আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল যার আবিষ্কারের জয়জয়কার আজ বিশ্ব জুড়ে। টেলিফোনের এই আবিষ্কর্তার দৌলতেই প্রথম তারের মাধ্যমে শব্দপ্রেরণ সম্ভব হয়। দূরে থাকা মানুষের কাছে ভেসে ওঠে অপরের স্বর। বাস্তবায়িত হয় পৃথিবীর প্রথম টেলিফোন কল। “মিস্টার ওয়াটসন, কাম হিয়ার – আই ওয়ান্ট টু সি ইউ।” যাদুতরঙ্গের মতো গ্রাহাম বেলের কণ্ঠস্বর টেলিফোনের মাধ্যমে পৌঁছে যায় অন্য ঘরে থাকা তাঁর সহকর্মী থমাস ওয়াটসনের কাছে। সে এক যুগান্তকারী দিন। 

আজ টেলিফোন পেরিয়ে যুগ এসেছে মোবাইল ফোনের। কিন্তু এই টেলিফোনই একসময় ছিল তার পাথেয়, তার সূত্রপাত। আর টেলিফোন বললেই যে নামটি সবার আগে উঠে আসে তা হল আবিষ্কর্তা- আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল।  কিন্তু এই আবিষ্কার নিয়ে রয়েছে একাধিক মত, বহু বিতর্ক। ফোন আবিষ্কার নিয়ে অনেক আগে থেকেই কাজ করছিলেন অনেক বিজ্ঞানী। ১৬৬৭ সালে রবার্ট হুক প্রথম স্ট্রিং টেলিফোন তৈরী করেন। ঠিক ছোটবেলায় দুটো কাপ সুতো দিয়ে জুড়ে আমরা যেমন খেলতাম এটা সেই জাতীয় যন্ত্র যেখানে স্ট্রিংয়ের মেকানিক্যাল ভাইব্রেশনের সাহায্যে শব্দ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেত। শুরুটা হয় এখান থেকেই। এরপর ১৮৬১ সালে ইয়োহান ফিলিপ রাইস বানান প্রথম ওয়ার্কিং ডিভাইস যার নাম দেন ‘টেলিফোন’। নামটি আসে সেখান থেকেই। তবে প্রেরণ ছিল একতরফা আর মানও খুব খারাপ। ১৮৬৪ সালে ইনোসেঞ্জো ম্যানজিটি তাঁর কাজ শুরু করেন স্পিকিং টেলিগ্রাফ নিয়ে। এই যন্ত্রের মাধ্যমে সুর শোনা গেলেও কথা একেবারেই অস্পষ্ট।    

এরপর আসে ইতিহাসের পাতার সেই তিন নাম যাদের মধ্যে কে প্রকৃতপক্ষে টেলিফোনের আবিস্কারক তা নিয়ে চলে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব। সালটা ১৮৭১, ইতালির অ্যান্টোনিও মিউচি টেলিফোনের মতোই একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। নাম দেন- সাউন্ড টেলিগ্রাফ। জমা দেন পেটেন্ট অ্যাপ্লিকেশনও। কিন্তু প্রসেসিং ফি না দিতে পারায় সাফল্যের পথ বন্ধ হয় সেখানেই। এই মিউচির ওয়ার্কশপে কাজ করেন আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল। স্টাডি করেন ইয়োহান ফিলিপ রাইসের গবেষণা। অবশেষে ১৮৭৬ সালে তার প্রথম টেলিফোন আবিষ্কারের পেটেন্ট অ্যাপ্লিকেশন জমা দেন তিনি। আর এখানে আসে এক নতুন টুইস্ট। বেলের পেটেন্ট জমা দেওয়ার দু ঘন্টা পরেই আমেরিকার এলিসা গ্রে জমা দেন তার পেটেন্টও। চলে তর্ক-বিতর্ক, একে  অপরকে দোষারোপ। অবশেষে ১৮৭৬ সালের ৭ই মার্চ পেটেন্ট পান আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল। তৈরি হয় ইতিহাস।

বেলের জন্ম হয় এমন এক পরিবারে যে পরিবারের সদস্যরা শব্দের উপর কাজ করেন। স্পিচ ডিসর্ডার, শ্রুতিহীন মানুষদের কথা বলতে শেখানো, পিয়ানো বাজাতে শেখানো এইসব নিয়ে তাঁর পরিবার ভাবত, কাজ করত। স্বাভাবিকভাবেই শব্দের প্রতি ছোটবেলা থেকেই তাঁর এক অদম্য টান ছিল। মানুষের কাছে শব্দকে পৌঁছে দিতে তিনি পরবর্তীকালে শুরু করেন তাঁর গবেষণা। হয়তো এই পুরানো গবেষণা অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে আসে কিন্তু বেলের হাত ধরে তা লক্ষ্যে পৌঁছায়। টেলিফোন দূরকে করে নিকট।

ছবিঃ পিক্সাবে এবং বায়োগ্রাফি