লেখক – শুভজিৎ দে|
কথায় আছে ‘মান্ধাতার আমলে’। এই শব্দযুগল আমাদের অনেকেরই প্রাত্যহিক জীবনে বহুল ব্যবহৃত শব্দে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন আসতেই পারে, কে এই মান্ধাতা? কী এমন ঘটেছিল তার আমলে, যে তিনি এত বিখ্যাত হয়ে গেলেন?
পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী ‘মান্ধাতা’ এক রাজার নাম। তিনি ছিলেন সূর্য বংশের রাজা যুবনাশ্বের পুত্র। রামও এই সূর্য বংশেরই রাজা ছিলেন।
মান্ধাতার জন্মের ইতিহাসটাও বেশ অবাক করার মতো। তার বাবা যুবনাশ্বের কোনও পুত্র ছিল না। একটি পুত্র সন্তান লাভের আশায় তিনি মুনিদের আশ্রমে গিয়ে যোগ সাধনা করতে শুরু করলেন। দিনের পর দিন নিষ্ঠার সাথে সাধনা করার পর এক সময় মুনিরা তার সাধনায় সন্তুষ্ট হলেন। যুবনাশ্বের পুত্র লাভের জন্য মুনিরা এক যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। ভোরের দিকে শুরু হওয়া সেই যজ্ঞ শেষ হল মধ্যরাতে। কলসি ভর্তি মন্ত্রপূত জল বেদীতে রেখে তাঁরা গেলেন ঘুমাতে। যাওয়ার আগে নিজেরা নিজেরা বলাবলি করলেন, এই কলসির জল যুবনাশ্বের স্ত্রী খেলে তাদের পুত্র সন্তান হবে।
সে কথা অবশ্য যুবনাশ্ব জানতেন না। রাতে তার খুব তৃষ্ণা পেল তিনি নিজেই সেই কলসির জল পান করে ফেলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে কলসিতে জলের পরিমাণ কমে যাওয়া দেখে অবাক হয়ে গেলেন মুনিরা। যুবনাশ্বকে জিজ্ঞেস করতেই রাতের ঘটনা পুরোটা খুলে বলেন তিনি। সবটা শুনে মুনিরা বললেন, সন্তান তাহলে যুবনাশ্বের গর্ভেই হবে। তবে তাঁরা যুবনাশ্বকে গর্ভধারণের কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে একটি উপায় বের করলেন। একশ বছর পূর্ণ হলে যুবনাশ্বের পেটের বাম দিক বিদীর্ণ করে ভূমিষ্ঠ হলেন মান্ধাতা।
পৌরাণিক এই কাহিনিকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু গল্প লেখা হয়েছে, যেখানে যুবনাশ্বকে বলা হয়েছে ‘দ্য প্রেগনেন্ট কিং’। একই নামে দেবদূত পৌত্তনিকের একটি বইও আছে।
সে যা-ই হোক, মান্ধাতার জন্মের পর দেখা দিল আরেক সমস্যা। মান্ধাতাকে তো কোনো মা গর্ভে ধারণ করেনি। ফলে দুধ সে কোথায় পাবে? এখন দুধ ছাড়া মান্ধাতা বাঁচবেই বা কী করে? জটিল এই সমস্যার সমাধান দিতে এগিয়ে এলেন স্বয়ং ইন্দ্র। তিনি নিজে মান্ধাতাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নিলেন। তার মুখে নিজের অমৃতক্ষরা তর্জনী পুরে দিয়ে বললেন, “মাম ধাস্যতি” অর্থাৎ “আমাকে পান করো”। সেখান থেকেই পুত্রটির নাম রাখা হয় মাম-ধাতা বা মান্ধাতা।
ইন্দ্রের সেই আঙুলের গুণে মান্ধাতা এক দিনেই দেহসৌষ্ঠবের দিক থেকে তারুণ্যে পদার্পণ করে। পড়াশোনা এবং অস্ত্রবিদ্যায় বেশ পারদর্শিতা অর্জন করে মান্ধাতা।
পরবর্তীকালে তিনি পৃথিবী বিজয়ে বেড়ান। যুদ্ধ করতে করতে মান্ধাতা প্রায় সারা বিশ্বই জয় করে ফেললেন। তিনি কেবল জিততে পারলেন না রাবণের সাথে। সুমেরু পর্বতে রাবণের সঙ্গে মান্ধাতার যুদ্ধ হল। যুদ্ধে কেউই জিততে পারছিল না। একেবারে মুখোমুখি লড়াই চলছিল তাদের মধ্যে। শেষে তাঁরা যুদ্ধ বাদ দিয়ে সন্ধি করলেন। আর সেই সন্ধির মধ্য দিয়ে রাবণের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপিত হল মান্ধাতার।
এরপর মান্ধাতা পাতাল ছেড়ে স্বর্গরাজ্য জয় করার অভিযানে বের হলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র তাকে থামালেন। বললেন, তুমি তো এখনও পুরো পৃথিবী জয় করতে পারোনি। লবণাসুর এখনও তোমার অধীনতা স্বীকার করেননি। আগে তাকে পরাজিত করে এসো, তারপর না হয় স্বর্গ জয়ের কথা ভেবে দেখবে।
এই লবণাসুর ছিলেন রাজা মধুর ছেলে। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণভক্ত। মধুর উপর সন্তুষ্ট হয়ে শিব তাকে নিজের ত্রিশূলের একটি শূল দিয়েছিলেন। এই শূল শত্রুদের ভস্ম করে আবার মধুর হাতেই ফিরে আসতো। তবে দেবতা বা ব্রাহ্মণদের বিরোধিতা করলে এই শূলের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাবে। মধু আবার উপযাচক হয়ে আরেকটি বর চেয়ে নিয়েছিলেন। এই শূল যেন উত্তরাধিকার সূত্রে তার বংশের সবাই ব্যবহার করতে পারে। শিব অবশ্য তাকে এতটা স্বাধীনতা দেননি। কেবল তার ছেলে লবণ এই শূল ব্যবহারের অধিকার পায়।
মধুর সঙ্গে লড়াই হয় রাবণের, আর লবণের সাথে যুদ্ধ হয় মান্ধাতার। মধু-রাবণের যুদ্ধে জয়ী হয় রাবণ। তার হাতে মারা যায় মধু। কিন্তু মান্ধাতা লবণকে হারাতে পারেননি। উল্টে লবণের হাতে মারা যান মান্ধাতা। পরবর্তীতে অবশ্য মান্ধাতারই বংশধর শত্রুঘ্ন লবণকে পরাজিত ও নিহত করেছিলেন।
এই রাজা মান্ধাতা ছিলেন সত্যযুগের রাজা। দৈবযুগকে যে চারটি ভাগে ভাগ করা হয় তার প্রথমটি ছিল এই সত্যযুগ। তারপর ত্রেতাযুগ, দ্বাপরযুগ পার হয়ে এখন চলছে কলিযুগ। মান্ধাতার আমল মানে যে বহুদিনের পুরনো কিছুই হবে তা আর আলাদা করে বলাই বাহুল্য। এই কারণেই আমরা অনেক পুরানো কিছু বোঝাতে গিয়ে মান্ধাতার আমলের কথা উল্লেখ করি।
মান্ধাতা সারা পৃথিবী জয় করেছেন, দীর্ঘকাল শাসন করেছেন। কিন্তু এত কাল পরেও মানুষ কেবল জানে তাঁর নাম ও শাসনামল, জানে না তাঁর শাসনাকালটা ঠিক কবে থেকে শুরু হযেছিল।
তথ্যসূত্রঃ দ্য প্রেগন্যান্ট কিং, পৌরাণিক বাগধারা,পৃথিবীর ইতিহাস ( প্রথম খণ্ড)
কমেন্টস
Raghu→Ajo→Dashratha→Ram(who killed Rabana)
এখানে মান্ধাতার নাম কই?