গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক|
পৃথিবীর গণ্ডি পেরিয়ে মানুষ মহাকাশে পারি দিয়েছে। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে গোটা বিশ্বকে করেছে মুঠোবন্দি। প্রকৃতি মানুষের উপর হারিয়েছে নিয়ন্ত্রণ। তবে এর ফল কখনও হয়েছে বিপর্যয় কখনও বা এনেছে সাফল্য। এমনই এক যুগান্তকারী প্রযুক্তির কথা আলোচনা করব আজ।
প্রাণের প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল জলেই। আর যেকোনোও প্রাণীর বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান উপাদান হল জল। যার একমাত্র প্রাকৃতিক উৎস হল বৃষ্টিপাত। এবার যদি বলি এই বৃষ্টির ওপরেও মানুষ কৃত্তিম নিয়ন্ত্রণ ফলাতে সক্ষম? শুনতে অবাক লাগছে ঠিকই কিন্তু এটাই সত্যি। বৃষ্টির উপর নিয়ন্ত্রণ মানুষ বহুদিন আগেই আবিষ্কার করেছে। কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানোর এই পদ্ধতিকে বলা হল ক্লাউড সিডিং।
এবার জেনে নেওয়া যাক কীভাবে বৃষ্টিপাত হয় ক্লাউড সিডিং পদ্ধতিতে।
প্রিকৃতিক বৃষ্টির ক্ষেত্রে সূর্যের উত্তাপে নদী, সমুদ্র, খালবিলের জল বাষ্প হয়ে উপরে উঠে যায়। যা বাতাসে ভেসে থাকা অসংখ্য ধূলিকণার সঙ্গে মিশে জমাট বাঁধে। এই জলীয় বাষ্পগুলোই একত্রে মেঘে পরিণত হয়। এতে আরও জলীয়বাষ্প এবং ধূলিকণা জমে যখন অপেক্ষাকৃত ভারী হয়ে যায় তখন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে তা ফোঁটা ফোঁটা জলের আকারে ভূপৃষ্ঠে নেমে আসে। এবার আসা যাক ক্লাউড সিডিংয়ের প্রসঙ্গে, এটি বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য খুবই সাধারণ একটি উপায়। আকাশে ভেসে বেরানো বৃষ্টি অনুপযোগী মেঘের উপর কেমিক্যাল ছড়িয়ে সময়ের আগেই বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়। যাকে কৃত্রিম বৃষ্টিপাতও বলা যেতে পারে।
মিসাইল, রকেট অথবা বিমানের সাহায্যে বৃষ্টি অনুপযোগী মেঘের উপর তরল প্রোপেন গ্যাস, জমাটবাধা কার্বন ডাইঅক্সাইড বা ড্রাই আইস, পটাসিয়াম আয়োডাইড, সিলভার আয়োডাইড এবং পটাসিয়াম ক্লোরাইড (লবণ) ছড়িয়ে দিলে তা দ্রুত মেঘ ঘনীভূত হতে সহায়তা করে। এর ফলে সহজেই বৃষ্টি নামে। কৃত্তিম তুষারপাতের ক্ষেত্রেও এই একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

১৯৪৬ সালে ক্লাউড সিডিং’ প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন মার্কিন রসায়নবিদ ভিনসেন্ট শায়েফার। প্রথম কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের সফল ব্যবহারিক প্রয়োগ হয়েছিল জুলাই মাসে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিকের গবেষণাগারে। এর পর নোবেলজয়ী মার্কিন বিজ্ঞানী আরভিং ল্যাংমুর এবং শায়েফার একত্রে ওই বছরেই ১৩ নভেম্বর বার্কশায়ারের পাহাড়ি এলাকার উন্মুক্ত পরিবেশে প্রথম ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছিলেন। আশ্চর্যজনক বিষয় হল শায়েফারের রসায়নবিদ্যায় কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী ছিল না। স্বশিক্ষিত এই বিজ্ঞানী কখনও হাইস্কুলের গণ্ডিই পেরোয়নি।
বিশ্বে যত কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হয় তার অধিকাংশই করে থাকে চিন। বহু প্রতিবেশী রাষ্ট্রই তাদের দেশে অনাবৃষ্টির কারণ হিসেবে দায়ী করে আসছে চিনকে। চিনের গণ্ডি পেরিয়ে মেঘের সারি ভেসে অন্য দেশে ঢোকার আগেই চিন সেগুলো থেকে কৃত্তিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে ফেলছে বলে শোনা যায়। এমনকি ভারতের পক্ষ থেকেও চিনকে ‘বৃষ্টি চোর’ বলা হয়েছে।
বর্তমানে বহু রাষ্ট্র বর্ষার জলে উৎপাদিত শস্য চাষের ক্ষেত্রে ক্লাউড সিডিং-এর ব্যবহার করছে। কৃষিক্ষেত্রে ক্লাউড সিডিং ব্যবহারে সর্ব প্রথমেই রয়েছে থাইল্যান্ড। ১৯৫৫ সাল থেকে সেখানে সরকারি উদ্যোগে কৃষি ক্ষেত্রে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হচ্ছে। যেমন আরবের আমিরাত। নদীহীন এই দেশ মরুভূমি এবং সাগর পরিবেষ্টিত। সেখানে বছরে গড়ে মাত্র দশদিন বৃষ্টিপাত হয়, হিসেব মতো যার পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ১২০ মিলিমিটার। ওই দেশের ভূগর্ভস্থ জলের শতকরা নব্বই শতাংশই লবণাক্ত! এই শতকের শুরু থেকেই সেখানে সরকারী উদ্যোগে বৃষ্টিপাত বাড়ানোর বৃহৎ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। যার অন্তর্ভুক্ত বৃষ্টি বৃদ্ধির জন্য গবেষণা, ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তির আরও উন্নয়ন, বৃষ্টির জল সংরক্ষণের জন্য কৃত্রিম হ্রদ এবং বাঁধ নির্মাণ করা। আমিরাতের জাতীয় আবহাওয়া কেন্দ্রের একটি দল রয়েছে, যারা সারাক্ষণ মেঘ পর্যবেক্ষণ করে থাকে। বৃষ্টিপাত ঘটাতে সক্ষম এমন মেঘের সন্ধান পেলেই তারা ক্লাউড সিডিং অপারেশন শুরু করে। এভাবেই তারা ২০১৭ সালের মধ্যে ২৪২টির মতো সফল ক্লাউড সিডিং অপারেশন করেছে। যা ১৫-৩০ শতাংশের মতো বৃষ্টিপাত বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।শুধু তাই নয়, সমুদ্রের লবণাক্ত জল পরিশোধনের ক্ষেত্রেও আমিরাত অন্যতম। ওই দেশে রোজকার কাজে ব্যবহৃত হওয়া জলের ৯৯ শতাংশই পরিশোধিত সমুদ্রের জল।
বিশেষ করে যে সকল স্থানে অনাবৃষ্টি সমস্যা রয়েছে এবং মরু অঞ্চলগুলিতে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত প্রযুক্তির আশীর্বাদের একটি অন্যতম উদাহরণ। তবে ক্লাউড সিডিং এখনও অনেকটাই ব্যয়বহুল। এক্ষেত্রে প্লেন এবং রকেটের পরিবর্তে লেজার রশ্মির ব্যবহার নিয়ে গবেষণা চালানো হচ্ছে। যা সফল হলে কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের প্রযুক্তিকে সুলভ করা সম্ভব হবে।
ছবিঃ উইকিপিডিয়া