লেখক – ঈপ্সিতা নায়ক

বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু, পুথান্দু, বাসোয়া- এই খটমট নামগুলোর একটা সরল প্রতিশব্দ হল নববর্ষ বা নিউ ইয়ার। আর সারা বছরের সমস্ত দিনক্ষণের তালিকা বলতে আমরা যা বুঝি তা নতুন বছরের অতিথি হয়ে আমাদের ঘরে আসে। বছর শেষে আবার বিদায় জানিয়ে চলে যায় অতীতের খাতায়, দিয়ে যায় অনেক মুহূর্ত, অনেক স্মৃতি। সেই সকল মুহূর্ত নিয়ে হয় বিস্তর চর্চা, চলে স্মৃতিরোমন্থন।

৭৫৬ অব্দে পন্ডিত পন্ডিফোরাই-এর প্রচেষ্টায় প্রথম ক্যালেন্ডারের সূচনা। রোমে মাসের প্রথম দিনকে বলা হত ‘ক্যালেন্ডি’( kalendae )। এই শব্দ’র উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ ‘ক্যালেন্ড্রিয়াম’ থেকে, যার মানে ‘হিসাব খাতা’। এর থেকেই ইংরেজি ‘ক্যালেন্ডার’-এর উৎপত্তি।  

শোনা যায়, প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার আবিষ্কারের মধ্যে এটি অন্যতম। কালের শাণিত আঁচড়ে চলে এর সংশোধন-বিয়োজন-পরিমার্জন। তবে সময় নির্ধারণের জন্য এক এক সময়ে এক এক পরিমাপ পদ্ধতি ব্যবহার করেছে মানুষ। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০অব্দে মিশরীয় জ্যোতির্বিদরা এক বিশেষ পদ্ধতির ব্যবহার করে এক সম্পূর্ণ দিনকে ১২ঘন্টার ব্যবধানে দু’ভাগে ভাগ করতেন।

বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো-র নাম কারুর অজানা নয়, তিনিও তাঁর আশ্রমে ছাত্রদের অধ্যয়ন করতে বলতেন এক ধরনের জলের ঘড়িতে সময় দেখে। ১৯৬৫ সালে ফ্রান্সে পাওয়া গিয়েছিল তিরিশ হাজার বছরের পুরোনো হাড়, যার গায়ে ছিল ৬৯টি আলাদা আলাদা দাগ।

এছাড়াও আফ্রিকায় পাওয়া যায় এমন হাড়। বিজ্ঞানীদের মতে, আদিম যুগের মানুষ শিকারের হিসাব লিখে রাখত এতে। তবে তা মানতে পারেননি একজন। তিনি আলেকজান্ডার মাশরাক। প্রমাণ করে দেন তিনি যে এগুলি প্রকৃতপক্ষে চাঁদের দশা পরিবর্তনের হিসাব।

ইতিহাসের পাতা উল্টে একটু ফিরে দেখা গেলে জানা যাবে যে দিন-সময় হিসাব শুরু হয় প্রথমে চন্দ্রকে কেন্দ্র করেই। সৌরগণনা শুরু হয় তারও বেশ পরে। প্রথম গণনার সাথে সম্পর্ক ছিল না ঋতু পরিবর্তনের যা সৌরসাপেক্ষ গণনার এক অপরিহার্য অংশ ছিল। চাষাবাদের সুবিধার্থে ফসল উৎপাদনের সঠিক সময় নির্ধারণ করতে প্রয়োজন পড়ে ক্যালেন্ডারের। যেহেতু শৈত্যের কারণে দু মাস বন্ধ থাকতো চাষাবাদ তাই সেক্ষেত্রে মাসের সংখ্যা ছিল দশ। তবে বছর গণনা শুরু হতো সেদিন থেকে, যেদিন দিন ও রাত সমান হত৷

খ্রিস্টপূর্ব ৪২৩৬ অব্দ থেকে শুরু হয় প্রকৃত অর্থে ক্যালেন্ডার ব্যবহার অর্থাৎ ছয় হাজার বছরেরও আগে মানবসভ্যতার পরিচিতি হয় এই ক্যালেন্ডারের সঙ্গে। তার পরেই ক্রমশ জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে এটি। এর প্রবর্তক রোমানদের ধারণা ছিল ১০ মাসেই এক বছর হয়, যার মোট দিনের সংখ্যা ছিল ৩০৪। শীতের দুই মাস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি গণ্য হতো না বর্ষগণনায়। ৩০ দিন বিশিষ্ট ৬ মাস ও ৩১ দিন বিশিষ্ট চার মাস সমন্বয়ে ৩০৪ দিন।

মাসে সপ্তাহ থাকতো ৩টি করে আর সপ্তাহে দিন থাকতো ১০টি করে। দশম মাস ডিসেম্বরের পরে ছিল শীত তথা বর্ষগণনার বিরতি। মার্চ মাস থেকে আবার শুরু হত নতুন বছরের হিসাব। পরবর্তীকালে রোমান সম্রাট নুম পামপিলিয়াস ১০ মাসের ক্যালেন্ডারে যুক্ত করেন আরো দুই মাস, ২৯ দিনের জানুয়ারি ও ২৮দিনের ফেব্রুয়ারি। এভাবেই হয় বারো মাসে এক বছর। তবে মজার বিষয় এই যে এতো নামের মাঝে ছিল আরো একটি নতুন নামের মাস, নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মারসিডানাস’। ২২দিনের এই বাড়তি মাসটি ফেবরুয়ারি মাসের ২৩ ও ২৪ তারিখের মাঝে ধার্য্য করা হয়েছিল। তবে তাতে হিসাবে থেকে যেত অমিল। অবশেষে রোমানদের হাত ধরেই আসে লিপ ইয়ার এবং অবসান হয় হিসাবের গরমিলের।  

‘লিপ ইয়ার’-এর প্রচলন হয় রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের শাসন আমল থেকে। জুলিয়াস সিজার আলেকজান্দ্রিয়া থেকে গ্রীক জ্যোতির্বিদ মোসাজিনিসকে নিয়ে আসেন ক্যালেন্ডার সংস্কারের জন্য। মোসাজিনিস দেখতে পান পৃথিবী সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণে সময় নেয় ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা। অনুপ্রবেশ ঘটে লিপ ইয়ারের একটি দিনের হিসাবের। সংশোধিত ক্যালেন্ডারের নাম দেওয়া হয় ‘জুলিয়াস ক্যালেন্ড’।

১৫৮২ সালে আর এক রোমান পণ্ডিত পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী হিসাব করে দেখেন একটি বছর সম্পূর্ণ হয় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে কিন্তু জুলিয়াস ক্যালেন্ডারে ১১ মিনিট ১৩ সেকেন্ড বেশি ধরা হয়েছে। তাই চলে পুনর্বিবেচনা, দীর্ঘ হিসাব নিকাশের পর তিনি ৪ঠা অক্টোবরকে ১৫অক্টোবর বলে স্থির করেন আর বিশ্ববাসী স্থির করে তাঁর আবিষ্কৃত এই ক্যালেন্ডারকে। রোমানদের হাতে ক্যালেন্ডারের জন্ম ও বিকাশ হয়েছে বলে এর বারোটি মাসের নামও বেশির ভাগই রোমান দেবতা বা সম্রাটের নামে। এভাবেই সেদিনের এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার আজ বিশ্বের  কাছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয়।