গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক|

কোয়ারেন্টিন – বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে এই শব্দটি যেন এক বিভীষিকা। যতটা আশঙ্কা কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসকে নিয়ে রয়েছে তার থেকেও বেশি অসহনীয় হয়ে উঠেছে এই হোম কোয়ারেন্টিন বিষয়টি। কিন্তু উপায় নেই যে! এই মারণ ভাইরাসকে ঠেকানোর এই একমাত্র উপায়। এগুলি তো আমাদের সকলেরই জানা কিন্তু এই শব্দটির উৎপত্তি কিভাবে জানেন? মোটামুটি ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা রাখেন তাঁরা হয়তো অনেকেই জানেন।

চলে যাওয়া যাক সপ্তদশ শতকে, ব্যবসা-বাণিজ্যের এক মূল কেন্দ্র ছিল তখন ইতালির ভেনিস। সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে চলত জাহাজের আনাগোনা। আর সেই সকল জাহাজে বহু মানুষ এমনও থাকতো যাদের শরীরে বাসা বাঁধতো প্রাণনাশক মাইক্রোঅর্গানিজম বা প্যাথোজেনস। তাদের অজান্তেই তা সংক্রামিত হতে থাকতো, ফলে তারা তো অসুস্থ হয়েই পড়তো সঙ্গে সেই রোগ ছড়িয়ে পড়তো বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু এক্ষেত্রেও সমস্যা ছিল ওই একই, রোগের লক্ষণ কিছুই ধরা পড়তো না প্রথমদিকে।  

বিষয়টি বোধগম্য হতেই ভেনিস এক সিদ্ধান্ত নেয়। ডকে জাহাজ আসার আগে চল্লিশ দিন নিকটবর্তী অংশে অপেক্ষা করতে হতো তাদের। কারোর সংক্রামক রোগের কোনো লক্ষণ ধরা পড়ে কিনা তা দেখার জন্য। এই চল্লিশ দিনকে ইতালির ভাষায় বলা হত কোয়ারেন্টিন। আর তারপর থেকেই সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অন্যদের থেকে আইসোলেট করে রাখার প্রক্রিয়ার নাম হয় কোয়ারেন্টিন। যদিও এই প্রক্রিয়া বেশ প্রাচীন তবে শব্দটির উৎপত্তি ও প্রচলন হয় তারপর থেকেই। আর এরকমই হোম কোয়ারেন্টিনে বিশ্ববাসী আজ ঘরবন্দী। তারা অতিষ্ট, আশঙ্কিত, ভবিষ্যৎ ও উপার্জন নিয়ে চিন্তিত।

চিন্তা-দুশ্চিন্তার এই ভার একটু লাঘব করা যেতে পারে! ইতিহাস কিন্তু এক মজার তথ্য দেয় আমাদের। এই হোম কোয়ারেন্টিনে থাকাকালীন এমন কিছু মানুষ আছেন যারা তাদের যুগান্তকারী সৃষ্টির জন্য বিশ্বের দরবারে নিজেদের জায়গা করে নেন। তাদের সৃষ্টিগুলির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত আমরা। এই তালিকায় যাঁর নাম সর্বপ্রথম রয়েছে তাঁর গল্প জানতে গেলে আমাদের যেতে হবে ১৬৬৫ সালে, লন্ডনে। এই শহরজুড়ে সবেমাত্র থাবা বসিয়েছে তখন গ্রেট প্লেগ যা ব্ল্যাক ডেথ নামেও পরিচিত। এই ভয়াবহ মহামারীর জেরে একে একে বন্ধ হচ্ছিল স্কুল-কলেজ-অফিস-ইনস্টিটিউশন। স্বাভাবিকভাবেই কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিও বাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছিল সমস্ত পড়ুয়াদের। আর তাদের মধ্যেই এক পড়ুয়া ছিল যে তার কোয়ারেন্টিন টাইমের অনেকটা সময় কাটাতো তার বাগানে। যেখানে একটি আপেল গাছ থেকে মাটিতে পড়ে, ঘটনাটা স্বাভাবিক হলেও এই ঘটনাই তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কারের মূল উৎস। হ্যাঁ, স্যার আইজ্যাক নিউটন, ঘরবন্দি থেকেই করে ফেলেন তাঁর জীবনের অন্যতম এই আবিষ্কার যা মোটামুটি সাড়া ফেলে দেয় পৃথিবী জুড়ে। শুধু তাই নয়, ক্যালকুলাস, অপটিক্স্ ইত্যাদি নিয়েও সেই সময়ে কাজ করেন তিনি। ‘অ্যানাস মিরাবিলিস’ বা ‘ওয়ান্ডার ইয়ার’! নিউটনের ক্ষেত্রে ১৬৬৬ সালটিকে এটাই বলা হয়ে থাকে।

এবার যাওয়া যাক রানী এলিজাবেথের রাজত্বে, বিউবনিক প্লেগ ছড়িয়েছে চারিদিকে। প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। শুধু শহরাঞ্চল নয় পার্শবর্তী সকল জায়গায় মানুষদের ভরসা ছিল কোয়ারেন্টিন। রানীর সুন্দর-বিলাসবহুল-ঐতিহ্যময় শহর ক্রমশই হয়ে উঠছিল মৃত্যুর আঁতুরঘর। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে হার না মেনে নিজের ঘরে একা বসে লেখালেখি করতেন এক কিংবদন্তি নাট্যকার। তাঁর জীবনের সেরা কিছু নাটক যেমন  কিং লিয়ার, ম্যাকবেথ, অ্যান্থনি ক্লিওপেট্রা তিনি লেখেন ওই সময়ে। বোঝার অপেক্ষা রাখে না, নামটা হল উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। অভিনয়ের স্বপ্ন নিয়ে এই নাট্যকার একসময় আসেন লন্ডনে। পরবর্তীকালে লন্ডন এই মহামারীর কবলে পড়লে তিনি তা দেখেন খুব কাছ থেকেই, ফলে তার লেখাতেও প্রতিফলিত হয় ভয়, অসুস্থতা, মৃত্যু, ট্রাজেডি।

শুধু এই দুই লেজেন্ড নয় রয়েছে আরো বহু নাম। চতুর্দশ শতকে প্লেগের কারণে টাস্কান অঞ্চলে গৃহবন্দী করেন নিজেকে ফ্লোরেন্টিন লেখক জিওভানি বোকাচিও। যিনি কোয়ারেন্টিন টাইম, তৎকালীন পরিস্থিতি, মানুষের দুর্দশা এই সব নিয়ে বহু নাটক লেখেন যা নাট্যজগত তথা সাহিত্যজগতে মাস্টারপিস হিসাবে কদর পায়।

এছাড়া এই তালিকায় রয়েছেন এডওয়ার্ড মাঙ্ক, যাঁর সেরা চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম ‘দ্য স্ক্রিম’। ছোটবেলা থেকেই তাঁর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল খুবই কম, ফলে সহজেই যে কোনো রোগ জাঁকিয়ে বসত তার শরীরে। ঘটনাটি ১৯১৮ সালের, যখন দেখা দেয় স্প্যানিশ ফ্লু- আর এক ঘাতক মহামারী। অসুস্থ হয়ে পড়েন এডওয়ার্ড। রোগের আধিপত্যকে সরিয়ে শিল্পী তৈরী করে ফেলেন ‘দ্য স্ক্রিম’, যতটুকু সামগ্রীর জোগান তাঁর কাছে ছিল তা দিয়েই। তাঁর শারীরিক পরিস্থিতির এক প্রতিচ্ছবি যেন এই সিরিজের প্রতিটি পেইন্টিং। ওয়ার্ল্ড আর্টে তাঁর এই ছবি বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়।

এরকম আরো অনেক নাম রয়েছে যারা আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। গৃহবন্দী হোক বা জেলবন্দী নিজেদের সময়ের সঠিক ব্যবহার করে তাদের সেরা সৃষ্টিগুলি তুলে ধরেছেন সকলের সামনে। থমাস ন্যাস, মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা, জওহরলাল নেহেরু- এরা সকলেই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আর বর্তমান সময়ের এই একই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আশঙ্কা-দুরাশা দূরে রেখে সঠিক ব্যবহার করতেই পারেন নিজেদের কোয়ারেন্টিন টাইমের। হয়তো খুঁজে পেতে পারেন এক নতুন ‘আমি’-কে!

ছবিঃ পিক্সাবে