শুভজিৎ দে|
এখন যেখানে আনন্দময়ী কালীর মন্দির আছে, আগে নিমতলা শ্মশান ঘাট সেখানেই ছিল, তখন মন্দির তৈরী হয়নি, শ্মশানের মধ্যেই কালী ছিলেন, তার জন্যেই ইনি শ্মশানকালী দেবী, আর এই শ্মশানের পাশেই ছিল গঙ্গা, তখনও স্ট্যান্ড রোড হয়নি। তারপর স্ট্যান্ড রোড তৈরি হলে শ্মশান উঠে গেল কালী মন্দিরের সোজা পশ্চিমে গঙ্গার ধারে, বর্তমানে নিমতলা শ্মশানের দক্ষিণে।
১৬০ ফুট লম্বা ৯০ ফুট চওড়া জায়গা, তিন দিকে ১৫ ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, শুধু নদীর দিকটা খোলা ছিল এই শ্মশান। এই শ্মশান ঘাট তৈরি হয় ১৮২৮ সালে। ওই বছরই ১৭ মার্চ থেকে এই শ্মশানে শবদাহ আরম্ভ হয়।
এই শবদাহ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে গৌতম ঘোষের ‘অন্তর্জলি যাত্রা’ সিনেমাটির কথা। অথবা খুব সাম্প্রতিক রানি রাসমণি ধারাবাহিকে ওনার আত্মীয়দের মৃত্যুর সময়কাল। তবে শুধু সিনেমা বা গল্পে নয়, একটা সময় কলকাতা এবং তার আশপাশের ঘাটগুলোতে দেখা যেত মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ভিড়। তাদের জন্যই তৈরি হয়েছিল ওই ঘরগুলি, যা আজও কোনো কোনো গঙ্গার ঘাটে দেখা মেলে নিমতলা ঘাটের মতো।
সে যুগে পরাত পক্ষে কোনো মুমূর্ষুকে নিজের বাড়িতে মরতে দেওয়া হত না। বাড়িতে মারা গেলে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় এবং অধর্মের কাজ বলে মনে কর হত। যে ব্যক্তি বাড়িতে মারা যেত, লোক ধরে নিত সে পাপী। তাই মৃত্যুর পর আত্মার মুক্তির উদ্দেশ্যে মৃতপ্রায় ব্যক্তিদের গঙ্গাযাত্রা করানো বা ঘটা করে তাঁকে গঙ্গার ধারে নিয়ে যাওয়া হত। এই রকম মৃতপ্রায় ব্যক্তিদের বলা হত গঙ্গাযাত্রী। এদের আশ্রয়ের জন্য গঙ্গার ধারে যদি কোনো ঘর থাকতো সেই ঘরে তাদের রাখা হত, যত দিন না তাঁদের মৃত্যু হচ্ছে সেখানেই থাকত তাঁরা। এখান থেকেই বাংলার সমাজে সেই বিখ্যাত প্রবাদটি এসেছে ‘ঘাটের মরা’। যে ঘরে সেই মৃতপ্রায় ব্যক্তিদের রাখা হত সেই ঘরকে বলা হত গঙ্গাযাত্রীর ঘর। ওই সকল মৃতপ্রায় ব্যক্তিদের অবশেষে মৃত্যু ঘটলে বলা হত তাঁর ‘গঙ্গাপ্রাপ্তি’ হয়েছে। এই ঘটনার প্রতিচ্ছবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তৎকালীন বহু সাহিত্যিকের লেখায় স্থান পেয়েছে।
প্রতিদিন জোয়ারের সময় মুমূর্ষুকে তার আত্মীয়-স্বজনরা ঘর (গঙ্গাযাত্রীর ঘর) থেকে বার করে খাট সমেত গঙ্গার জলে নামিয়ে তাঁদের দেহের অনেক খানি ডুবিয়ে রেখে দিত। একে বলা হত অন্তর্জলী ক্রিয়া। এই অবস্থায় যদি তার মৃত্যু হত তাহলে মনে করা হত সে সোজা স্বর্গে যাবে। এই রকমভাবে দিনের পর দিন অন্তর্জলী ক্রিয়া করার ফলে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শীতে কষ্ট পেয়ে একদিন বেচারা মারা যেত, তখন সামান্য মুখাগ্নি সেরে তাঁকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুখাগ্নি করা হত না। জোয়ারের জল তাঁদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যেত।
সমাচার দর্পণে ১৮২৫ সালে এই বিষয় নিয়ে লেখা বেরিয়েছিল, যেখানে বলা হয় মৃত্যুকালে গঙ্গার ধারের মুমূর্ষু ব্যক্তিরা যাদের মাথায় উপর ছাদ নেই। অনেক সময় আবার জোয়ারের টানে অর্ধমৃত দেহ ভেসে চলে যেত, সেই প্রতিবেদন সাড়া ফেলে তৎকালীন বঙ্গ সমাজে। তারপরই গঙ্গার ঘাটের পাকা ঘরগুলি নির্মার্ণ করা শুরু হয়। শহরের বিত্তবান মানুষরাই এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন। যেমন নিমতলা ঘাট নির্মাণ করেছিলেন রানি রাসমণির স্বামী, বাবু রাজচন্দ্র মার (দাস)। এই শ্মশানের দক্ষিণে গঙ্গাযাত্রীদের থাকার জন্য একটি পাকা ঘর তৈরি করে দেন।
তখন বেশিরভাগ লোক এত গরিব ছিল যে শবদেহ দাহ করার জন্য কাঠ, তেল কেনারও ক্ষমতা ছিল না, এও মনে রাখতে হবে তখনও ইলেকট্রিক চুল্লির ব্যবহার শুরু হয়নি। তাই অনেকেই মুখে আগুন না ছুঁইয়েই নিজেদের আত্মীয়দের গঙ্গায় ভাসিয়ে দিত। এভাবেই বহু দাগা দাগা মৃতদেহ নিমতলা ঘাট ও কাশি মিত্তির ঘাট থেকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করা হত।
শত শত মানুষের মৃতদেহ গঙ্গায়, যে নদী কলকাতার অধিকাংশ লোককে পানের (খাওয়ার) ও রান্নার এবং গৃহকার্যের জল জোগায় সেই নদীতে প্রতি বছর (তৎকালীন সময়) ৫ হাজারের উপর মানুষের মৃতদেহ নিক্ষেপ করা হত। ১৮৭৫ সালে পোর্ট কমিশনার নালিশ করেন যে নিমতলা ঘাট থাকার জন্য তাদের রেল চলাচলের পথে বাধা তৈরি হচ্ছে, এই নালিশের ফলে ম্যাকিনটস বার্ণ কোম্পানিকে দিয়ে ৩০ হাজার টাকা খরচ করে বর্তমান জায়গায় নিমতলা শ্মশান ঘাট তৈরি হয়।
তথ্যসূত্রঃ কলির শহর কলকাতা- হরিপদ ভৌমিক, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত – বিনয় ঘোষ, কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা – মহেন্দ্রনাথ দত্ত, কলিকাতা দর্পণ – রাধারমণ মিত্র, শ্রীপান্থের কলকাতা – শ্রীপান্থ
ছবিঃ পিন্টেরেস্ট