শুভজিৎ দে|
প্রাচীন কাল থেকে আমাদের দেশে সৌধ নির্মাণের প্রথা অব্যাহত রয়েছে। নগরায়ণের অনিবার্য অঙ্গ হিসেবে উপাসনার ক্ষেত্রেও স্থাপত্যরীতি গড়ে উঠেছে। প্রাচীন কাল থেকে নির্মিত অনেক সৌধ প্রাকৃতিক কারণে কিংবা বিরুদ্ধবাদীদের আঘাতে বর্তমানে নিশ্চিহ্ন প্রায়। যদিও বিরুদ্ধমতাবলম্বীদের আচরণে বৈপরীত্যের নজির অতীতেও যেমন ছিল, বর্তমানেও তেমন আছে। যেমন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের বিষ্ণুমন্দির নির্মাণে অকুণ্ঠ সহয়তা; হিন্দু ও মুসলিম শাসক কর্তৃক মঠ-মন্দির, দরগা নির্মাণে সহয়তাদান ইত্যাদি।
বাংলার চারিদিকে ছড়িয়ে আছে নানান ধর্মীয় ইমারত। কালের প্রবাহে অযত্ন ও কংক্রিটের জঙ্গলে কর্মব্যস্ত মানুষ ডুব দেওয়ায় সেসব স্থাপত্যসৌধের অধিকাংশ জীর্ণ হয়ে পড়লেও যেগুলি টিকে আছে, তার থেকে অনুমান করা যায় প্রাচীন বাংলার জীবনচর্চা ও শৈল্পিকবোধের পরিচয়। পরবর্তীকালে মূলত খ্রিস্টিয় পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলায় নবপর্যায়ে মন্দির নির্মাণের সূত্রপাত হয় এবং সেই ধারাবাহিকতা বিংশ শতকের তৃতীয় দশক পর্যন্ত বজায় থাকে। মূলত শ্রীচৈতন্য প্রভাবিত বৈষ্ণবধর্ম অন্দোলনের প্রভাবেই যে এই পুনরুজ্জীবনের প্রধান কারণ সেকথা মন্দিরগবেষকগন স্বীকার করে নিয়েছেন। এই নবপর্যায়ে নির্মিত মন্দিরের গঠনরীতির রূপরেখা অনেকটাই নির্ভর করে মন্দিরের ওপরের অংশের আচ্ছাদন সংক্রান্ত নির্মাণকৌশলের ওপর। আর সেই করণেই এই আচ্ছাদনরীতির বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করেই মন্দিরের প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়। আচ্ছাদন সহ গঠনরীতি অনুসারে নবপর্যায়ে নির্মিত এই মন্দির গুলিকে প্রধানত পাঁচটি স্থাপত্যরীতিতে ভাগ করা যায়, যথা – চালা, রত্ন, শিখর বা রেখ, পীঢ়া বা দেউল ও দালান স্থাপত্যরীতি। এছড়াও বাংলার মন্দির স্থাপত্যে মিশ্ররীতির প্রভাবও দেখা যায়। যা বাংলার স্থপতির সৃষ্ট এক অপূর্ব নিদর্শন।
বাংলার চালা স্থাপত্য রীতি –
বাংলায় মন্দির স্থাপত্যের ক্ষেত্রে নিজেস্ব স্থাপত্যরীতি হল ‘চালা স্থাপত্যরীতি’। এই চালা আবার বিভক্ত ছিল ছয় ভাগে। ফলে এই চালারীতি ছিল যথেষ্ট বৈচিত্র্যপুর্ণ। যার জন্য বাংলার মন্দির স্থাপত্যকীর্তি বিশেষ উৎকর্ষের দাবি রাখতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন পরবর্তীকালে আমরা যে সুলতানী ও মুঘলস্থাপত্যের চাকচিক্য ও রমরমা দেখি সেখানেও সগর্বে বিরাজ করেছেন বাংলার মন্দির স্থাপত্যরীতির স্থপতিগণ।
বিভিন্ন ধরণের চালা-
- একচালা বা তিনচালা – গ্রামবাংলায় বাঁশ ও খড় দিয়ে সহজে ও সংক্ষিপ্তভাবে তৈরি হয় একচালা যা একটি ত্রিভুজের আকৃতিতে উঁচু দেওয়াল থেকে নেমে আসে। স্থানীয় ক্ষেত্রে একে বা এই ধরনের চালাকে বলা হয়ে থাকে “পরচালা”। সাধারণত মাটির চারচালা বা আটচালা ঘরের সামনের দাওয়া বা বারান্দাটিকে রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই একচালা বা পরচালার প্রয়োজন হয়। এ জাতীয় স্থাপত্যের নিদর্শন দেখা যায় মেদিনীপুর জেলার নোয়াদার রাধাগোবিন্দ মন্দিরের (1860 খ্রি:) ক্ষেত্রে।
- দোচালা বা একবাংলা – পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে খড়ে ছাওয়া দোচালারীতির সাধারণ কুটির অজস্র দেখা যায়। তবে দোচালারীতির যথার্থ নিদর্শন পাওয়া যায় সেকেলে দুর্গাপূজার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের খড়ে ছাওয়া স্থাপত্যের মধ্যে। তখনকার মিস্তিরিদের তৈরি করা এই খড়ে ছাওয়া বাঁকানো চালের দোচালা চন্ডীমন্ডপকে বলা হত ‘পাটাকুমারী’। সেদিক থেকে দোচালা কুঁড়েঘরের এই আদলকে বা শিল্পশৈলীকে মন্দির স্থপতিরা অনুসরণ করে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপ দিয়েছেন দোচালা মন্দির নির্মাণে। এই শৈলীর মন্দিরকে ‘একবাংলা’ নামেও অভিহিত করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, বাংলার এই কুঁড়েঘর শুধু যে মন্দির স্থপতিদের প্রভাবিত করেছিল তা নয়। বাংলার জলবায়ুর উপযোগী এই গৃহশৈলীর অনুকরণ করার জন্য সেগুলির নামকরণও করা হয় ‘বাংলো’ বা ‘ডাকবাংলো’ । একই সাদৃশ্যের কারণে দোচালা কুঁড়েঘরের আদলে নির্মিত দেবায়তন গুলিও বাংলারীতি থেকে ‘একবাংলা’ নামে অভিহিত হয়েছে। বাঘডাঙার সূর্যেশ্বরমন্দির এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
- জোড়বাংলা- দুটি দোচালা স্থাপত্যকে পাশাপাশি স্থাপিত করে নির্মিত মন্দিরকেই বলা হত জোড়বাংলা মন্দির। বলা যেতেই পারে এই জোড়বাংলা শৈলী পূর্ববর্ণিত দোচালারীতিরই একটি পরিবর্তিত ও উন্নততর রূপ। পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রাচীন জোড়বাংলা স্থাপত্যের উদাহরণ হল হুগলি জেলার গুপ্ত পড়ার ‘চৈতন্যদেবের মন্দির।’
- চারচালা- পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগ্রামান্তরে বসবাসের কুটির হিসেবে সর্বাধিক দেখতে পাওয়া যায় চারচালাছাদ বিশিষ্ট মাটির বাড়ি। বলা যেতে পারে দোচালাছাদের স্বাভাবিক পরিণতি ঘটেছে এই চারচালার, যার সংক্ষিপ্ত ও সহজরূপ প্রকাশ করার ক্ষমতাও যেন বেশী এই রীতির কুটিরের। এই স্থাপত্য শৈলীর একটি উল্লেখযোগ্য মন্দির হল ঘাটালের ‘সিংহবাহিনীর চারচালা মন্দির।’
- আটচালা- বাংলার আটচালা কুটির হল চারচালা কুটিরের পরবর্তী পর্যায়। বঙ্গীয় মন্দির স্থপতিরা প্রথাগত আটচালা কুঁড়েঘরের অনুকরণে নির্মাণ করেছেন আটচালারীতির মন্দির। পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থানে আটচালামন্দিরের বিভিন্নতা দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে একক আটচালামন্দির ছাড়াও পাশাপাশি নির্মিত জোড়া আটচালামন্দিরও দেখা যায় যা সাধারণ্যে জোড়া মন্দির নামে পরিচিত।
- বারোচালা- গ্রামবাংলার বহুস্থানে আটচালার মত বারোচালার কুটিরও দেখা যায়। যার অনুকরণে মন্দির স্থপতিরা বারোচালারীতির মন্দির নির্মাণেও মুখফিরিয়ে নেননি। ভূমিনকশায় বারোচালার মন্দির আটচালার মতনই বর্গাকার এবং আটচালার ওপরভাগে তৃতীয় স্তরে আর একটি অপেক্ষাকৃত ছোটো চারচালা নির্মাণ করে সেটিকে বারোচালার রূপ দেওয়া হত। মুর্শিদাবাদের ” সাহানগর মন্দির”, হুগলীর ” ইলছোবা মন্দির” প্রভৃতি ।
উপযুক্ত রক্ষণাবক্ষেণের অভাবে বহু মন্দির ও স্থাপত্য আজ বিলুপ্ত। প্রাথমিক পর্যায়ে সামান্যতম সংস্কার না করার ফলে আজ বেশ কিছু মন্দির বা স্থাপত্য ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।