গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক।
ভারতবর্ষ প্রাচীন লোকশিল্পের দেশ। এই দেশের মধ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মুখোশ সহযোগে নৃত্য। এর মধ্যে মিশে আছে উনিশ শতকীয় ধ্যানধারণা। মানুষকে বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠান থেকে তুলে নিয়ে এসে দেবতাজ্ঞানে পুজো করা। দেবতার থানে মাথা দেওয়ার রীতি কিংবা টোটেম-স্মৃতির মতো মুখোশকে ঘিরে থাকা লোকাচার বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অলৌকিক ভাবনা বা জাদুবিশ্বাস।
সংস্কৃতির চারটি প্রাচীন ধারার মধ্যে নৃত্যকলাকেই সব থেকে প্রাচীনতম কলা হিসেবে ধরা যায়। নৃত্যের শুরু হয়ে ছিল জাদুর অঙ্গ হিসেবে এবং মুখোশ ছিল এই জাদুর বহিপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম। আদিম মানুষের সমাজ সংস্কৃতির এই মুখোশ পরম্পরার ছায়া সমসাময়িক কালেও লক্ষ করা যায় লোক-জন গোষ্ঠী ও জন-জাতি গোষ্ঠী গুলির মধ্যে।
প্রায় কুড়ি হাজার বছর আগের গুহাবাসী মানুষেরা যে শিল্প স্বাক্ষর রেখে গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে্র গুহার দেওয়াল ও ছাদে, সেই শিল্প স্বাক্ষর গুলিই প্রমান করে যে তা ছিল শিকার নৃত্য ও জাদুবিশ্বাস সম্পর্কে মানুষের ভাবনা ও আচরণের প্রতিফলন বা প্রতিফলিত রূপ। দক্ষিণ ফ্রান্সের পিরেনিজ পর্বতমালার আরীজ অঞ্চলের লেস্ ত্রোয়া ফ্রের (Les Trois Freres) নামক গুহার একটি গুহাচিত্রে কয়েকটি নৃত্যারত মুখোশধারী মানুষের মধ্যে, একটি জাদুকরের চিত্র দেখা যায়। যার দেহ বিবিধ পশুর আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা আবৃত ছিল, ক্যাথলিক যাজক, নৃতত্ত্ববিদ তথা আদিম গুহা চিত্রকলা বিশেষজ্ঞ অ্যাবে হেনরি ব্রুইল (Abbe Henry Breuil, 1952) এই নৃত্যরত মুখোশ পরা মানুষটিকে “Sorcerer” অর্থাৎ, জাদুকর বলে উল্লেখ করে ছিলেন। এটি প্রায়, ২৫০০০ বছর আগের, আদিম মানবের হয়তবা নিয়ানডার্থাল মানব জাতির তৈরি মুখোশের একটি অন্যতম আদিম নিদর্শন বলে মনে করা যায়। অর্থাৎ, জাদুবিশ্বাস সম্পর্কে মানুষের সেই আদিকালের ভাবনা ও আচরণের সূত্রটি এবং একই সাথে মুখোশ উদ্ভবের প্রাচীনতম মূল সূত্রটিও এর থেকেই পাওয়া যায়।
প্রাচীন গুহা মানবের যুগের নাচ, ছবি প্রভৃতির বিশেষ ভূমিকা ছিল। আর এর প্রধান কারণ ছিল বাঁচার তাগিদের জন্য এবং যে বিশ্বাসের দ্বারা এই সকল সংস্কৃতি ও জীবন ধারা প্রবাহিত হয়েছিল সেই বিশ্বাসটি ছিল জাদু-বিশ্বাস। আর মুখোশ ছিল বাস্তব জগৎ ও অতিপ্রাকৃতের মধ্যে সংযোগকারী এক জাদু-মাধ্যম।

গুহাগাত্রে চিত্রিত মুখোশসহ গুহামানবদের মুখোশ ব্যবহারের কারনকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে ধরা যাক মুখোশের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের রূপান্তর ঘটানো হত। আদিম নৃত্য শিল্পীদের ছদ্মবেশ ধারণের প্রধান উপকরণই ছিল গাছের ছাল ও ডাল-পালা বা পূর্বে তাদের হাতেই শিকার হওয়া এইরূপ প্রাণীর মাথা, শিং বা গায়ের ছাল। যা পরিধান করে এবং তার গলার স্বর নকল করে ও চলন নকল করে সেই প্রাণীকে আকর্ষণ বা বিভ্রান্ত করত এবং ঐ গোত্রীয় প্রাণীকে আবার শিকার করতে সুবিধা হত। অন্য মতে, দ্বিতীয় ভাগে ধরা যাক মুখোশ ছিল জাদু বিদ্যার প্রয়োগ মাধ্যম। যার দ্বারা মানুষ শিকারে যাবার আগে শিকারটির ছবি গুহাগাত্রে এঁকে তাকে বধ করার চিহ্ন এঁকে দিত। শিকারে যাবার পূর্বে শিকার নৃত্যের মহড়া চলাকালীনও তাদের ছদ্মবেশ তথা মুখোশ ধারণ করে মুখোশ নৃত্য করার রীতি ও ছিল যা আচার ধর্মী নাচেরই এক প্রয়োগ বলে মনে করা যায়। অথবা প্রায় একই ভাবে বলা যায়-পূর্বে শিকার করা পশু বা প্রাণীর মুখোশ বা ছদ্মবেশের মধ্যে সেই প্রাণীটির আত্মা ভর করবে বা কোনো অলৌকিক ঘটনার দ্বারা পুর্বে ঘটে যাওয়া শিকারটির অনুকরণ আবার ঘটবে; এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই ছদ্মবেশ ধারণ করে তার অন্তলীন জাদুকে বা পূর্বের শিকারের আত্মাকে সন্তুষ্ট করে ও সেই মান্যাকে কাজে লাগিয়ে আসল শিকারটিকে বর্তমান শিকারীর অস্ত্রের সামনে এনে দাঁড় করানো যাবে এবং বর্তমান শিকারটিকে এই জাদু বিশ্বাসের জোরেই বধ করা যাবে। অর্থাৎ মুখোশের সাহায্যে তৈরি হত এক ইন্দ্ৰজালিক আবহের, যা শিকারটিকে বিভ্রান্ত করত এবং শিকারটি সহজেই বধ করা যেত। অর্থাৎ, সেই সময় থেকেই জাদু ও নৃত্যের উপকরণ হিসেবে মুখোশের ব্যবহার শুরু হয়েছে বলে ধরা যায়। অর্থাৎ, এই বর্ণনার মধ্যে দিয়েও যেন টোটেম ও মান্যার ছায়াটিই বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যায়।ভয় থেকেই ভক্তির সৃষ্টি হল, যার থেকেই মানুষের মধ্যে পশু-পূজার আবির্ভাব হল এবং এই উপাসনা অর্থাৎ জাদু কেন্দ্রিক আচারটি পালন করতে প্রধানত যে বিশেষ উপকরণটিকে কাজে লাগাত তা হল মুখোশ।
পুজো-পার্বণের আনন্দকে নতুন মাত্রা দিতে একসময় গুরুত্ব পেয়েছিল মুখোশ নৃত্য। মুখ ও মুখোশের দ্বন্দ্ব নিয়ে নৃত্যের আবেগেও নাটকীয় দ্বন্দ্ব তৈরি হল। গুরুত্ব পেল মানুষের মধ্যে জমে থাকা কাহিনি। নানা চরিত্র নিয়ে সেজে উঠল মুখোশ। পরবর্তীকালে এইসব মুখোশ শিশুদের খেলনা হয়ে উঠেছে, হয়ে উঠেছে গৃহসজ্জার উপকরণ। বর্তমানেও গোটা দেশ জুড়ে তৈরি হচ্ছে নিত্যনতুন মুখোশ। কিন্তু মুখোশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লৌকিক আবেগ ও জাদুবিশ্বাস মুখোশের আড়ালেই যেন লুকিয়ে পড়েছে। কারণ শিল্পকে অবলম্বন করেই শিল্পী বাঁচে।
তথ্যসূত্র- বঙ্গদর্শন, অপরজন
ছবি – উইকিপিডিয়া