শুভজিৎ দে|
আজ মোহনবাগান ক্লাবের শিল্ড জয়ের ১০৯ তম বছর। এশিয়ার প্রথম দেশ যারা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থেকে এক ব্রিটিশ ফুটবল ক্লাবকে পরাস্ত করে। তবে এখনে বলে রাখা দরকার মোহনবাগানের আগে ইউরোপিয়ান ক্লাবকে হারানোর কৃতিত্ব “শোভাবাজার ক্লাবের” ১৮৯২ ট্রেডস কাপ প্রতিযোগীতায় ইস্ট সারে’কে হারিয়ে দেয় শোভাবাজার। বাঙালি বুঝতে পারে, ইংরেজকে হারানো সম্ভব। ১৯১১ সালে মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের আগে কোনও বাঙালি ক্লাবের এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য। কিন্তু পরবর্তীকালে সবাই মাথা ঠুকেছিল মোহনবাগানের শ্রেষ্ঠত্বের কাছে।
এই শিল্ড জয়ের ১০০ বছর উপলক্ষে কয়েক বছর আগে, এই সময় সংবাদপত্রে “দে গোল গোল” বলে একটি কবিতা ছেপেছিল। অনেকে ভেবেছিল কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের লেখা। আসলে ওটি ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘ঝুলন’ কবিতার প্যারডি। যে কবিতার বিখ্যাত লাইন “দে দোল দোল।”

তবে রবিঠাকুর কি সত্যিই মোহনবাগান নিয়ে লেখেননি! এ প্রশ্ন অনেকের, তবে তিনি একবার, দু’বার নয়, বহুবার এই ক্লাবের কথা লিখেছেন। সেই প্রসঙ্গে আসছি পরে। শিল্ডকাপ জয় উপলক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে রবি ঠাকুর কিছু না লিখলেও, কবি করুণানিধন বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯১১ সালে মোহনবাগানের শিল্ড জয় উপলক্ষে একটি জনপ্রিয় গান রচনা করেছিলেন, “জেগেছে আজ দেশের ছেলে পথে লোকের ভিড়,অন্তঃপুরে ফুটল হাসি বঙ্গরূপসীর।গোল দিয়েছে গোরার গোলে বাঙালির আজ জিত,আকাশ ছেয়ে উঠছে উধাও উন্মাদনার গীত। আজকের এই বিজয়বাণী ভুলবে নাকো দেশ, সাবাশ সাবাশ মোহনবাগান! খেলেছ ভাই বেশ। “
যা শুনে উন্মত্ত পরাধীন দেশের মানুষ যেন স্বাধীনতার অল্প স্বাদ পেলেন, মুখে মুখে তাদের ঘুরতে থাকে, “গোল দিয়েছে গোরার গোলে বাঙালির আজ জিত, আকাশ ছেয়ে উঠছে উধাও উন্মাদনার গীত।”
মোহনবাগান ভারতের স্বাধীনতা অন্দোলনে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আর সেই দৃষ্টান্ত হচ্ছে ১৯১১ সালের শিল্ড জয়। সেই সময় ভারতে বিদেশী ফুটবল দলগুলোর, বিশেষত সামরিক দলগুলোরই প্রাধান্য ছিল। মোহনবাগান ক্লাব সেই সব শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে খেলে শেষ পর্যন্ত ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে পরাজিত করে আইএফএ শিল্ড জিতে নেয় ১৯১১ সালের ২৯ জুলাই। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে যা একটি মহৎ ও স্মরণীয় দিন। মোহনবাগান ক্লাব ওই প্রতিযোগীতায় প্রথম রাউন্ডে মোট পাঁচটি খেলা খেলে, এবং বিপক্ষের দলের সঙ্গে তাদের সাহসিকতার ফলাফল হচ্ছে ২৯ জুলাইয়ের সেই জয়।

সেই পাঁচটি খেলার ফলাফল নীচে উল্লেখ করা হল –
১০ জুলাই ১৯১১ঃ মোহনবাগান বনাম সেন্ট জেভিয়ার্স (৩-০)
১৪ জুলাই ১৯১১ঃ মোহনবাগান বনাম রেঞ্জার্স (২-১)
১৯জুলাই ১৯১১ঃ মোহনবাগান বনাম রাইফেল ব্রিগেড (১-০)
২৪ জুলাই ১৯১১ঃ মোহনবাগান বনাম মিডলসেক্স রেজিমেন্ট (Middlesex Regiment) (০-০, ৩-০)
২৯ জুলাই ১৯১১ঃ ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট (২-১), অভিলাশ ঘোষ, শিবদাস ভাদুড়ী, মোহনবাগান ক্লাবের গোলদাতা, জ্যাকসন ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের একমাত্র গোলদাতা।
এই ঘটনার পর সিঙ্গাপুর ফ্রি প্রেস লিখেছিল “ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে এরকম ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি , আই এফ এ শিল্ডের ফাইনাল দেখতে আজ বিকেলে মাঠে অভূতপূর্ব দর্শক সমাগম হয়েছিল, ধারনা করা হচ্ছে দর্শকের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক সেদিন খেলার কিছুই দেখতে পায়নি, খেলাটির বিষয়ে তাঁদের কেবল কিছু তথ্য দেওয়া হয়েছিল, খেলার ফলাফল উড়ন্ত ঘুড়ির মাধ্যমে তাঁদের জানানো হয়ে ছিল।” ১৯১১ সালের শিল্ড জয়ী মোহনবাগান দলের খেলোয়াড়রা হলেন – হীরালাল মুখার্জি, ভুতি সুকুল, সুধীর চ্যাটার্জি, মনমোহন মুখার্জি, রাজেন সেনগুপ্ত, নীলমাধব ভট্টাচার্য, কানু রায়, হাবুল সরকার, অভিলাশ ঘোষ, বিজয়দাস ভাদুড়ী, শিবদাস ভাদুড়ী (অধিনায়ক)।
এবার আসা যাক রবি ঠাকুরের লেখায়। তাঁর লেখায় মোহনবাগানের এই জয় নিয়ে লেখা নাই বা থাকতে পারে। তবে মোহনবাগান থাকবে না! তা কি হয়? রবি ঠাকুরের অন্তত তিনটি লেখায়, বেশ কয়েকবার মোহনবাগানের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘দুই বোন’ উপন্যাসে দেখা যায়, ঊর্মিমালার মনজয় করার জন্য শশাঙ্ক তাঁকে মোহনবাগানের খেলা দেখতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। রবি ঠাকুরের আরেকটি রচনা ‘সে’, এই বইটিতে তিনি নানা মজার ঘটনা লিখেছিলেন, নাতনি পুপেকে খুশি করার জন্য। এই বইতে দু’বার মোহনবাগানের উল্লেখ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ একবার লিখছেন, স্মৃতিরত্নমশায় মোহনবাগানের গোলকিপারি করেছেন। আরেকবার লিখেছেন, মোহনবাগানের খেলা দেখতে গিয়ে সাড়ে তিন আনা পয়সা পকেটমারি হয়ে গেছিল। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘শেষের কবিতা’র একদম শুরুতে, যেখানে স্টাইল এবং ফ্যাশনের তুলনা করা হচ্ছে। সেখানেও মোহনবাগানের উল্লেখ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের এই সব লেখা পড়লে বোঝা যায়, আজকের মতো তখনকার দিনেও মেয়েদের মধ্যে মোহনবাগান প্রবল জনপ্রিয় ছিল। দাদু-নাতনি সকলেই মোহনবাগানের কথা শুনে খুশি হতেন।
ফুটবলের মক্কা এই কলকাতায়, মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল নিয়ে বাঙালির লড়াই চলবে মহাকালের শেষ দিন পর্যন্ত। তাই বারবার মনে পড়ে যায় মান্না দে মহাশয়ের সেই বিখ্যাত গান, “সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল…”
তথ্যসূত্রঃ দ্য মোহনবাগান এসি, মোহনবাগান নিউজ ব্লগস্পট, উইকিপিডিয়া, ইন্ডিয়ান ফুটবল
ছবিঃ উইকিপিডিয়া