গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক।

ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।

একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই পথের আলো॥

                      – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যদিও কবিগুরুর লেখা এই দুটি পংক্তি যদিও একেবারে অন্য অর্থে ব্যবহৃত। তবে আক্ষরিক অর্থে আবর্জনা কিন্তু বর্তমান বিশ্বে এক বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেললেও আবর্জনা পোড়ালে কিন্তু পরিবেশ দূষণ অবধারিত। এই প্রচলিত পদ্ধতিতেআবর্জনা পুড়িয়ে বা মাটির নীচে পুঁতে দিয়ে অথবা সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ না করে তাকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলাকে বলা হয় ‘জিরো ওয়েস্ট’। আর এই জিরো ওয়েস্ট প্রসঙ্গে গত কয়েক বছরে সারা বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে জাপানের ছোট্ট শহর কামিকাতসু।

জানলে অবাক হবেন, আদতেই ছোট্ট এই শহরের আয়তন মাত্র ১০৯ বর্গকিলোমিটারের কাছাকাছি। তার মধ্যে স্থলভাগ খুবই কম। জঙ্গলে ঘেরা পার্বত্য অঞ্চলই মোট জমির ৮৫ শতাংশ স্থান দখল করে রয়েছে। ৮০০টি পরিবার নিয়ে ১,৫৮০ জন মানুষ এখানে বসবাস করেন। ২০০৩ সালে জাপান যখন প্রথম জিরো ওয়েস্ট কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল তখন বর্জ্য পদার্থের ব্যবস্থাপনার এক নয়া দিশা খুলে দিয়েছিল কামিকাতসু। এই শহর জুড়ে কোথাও কোনও আবর্জনা ফেলার স্থান নেই। কোনও ময়লা ফেলার গাড়িও আসে না বাড়ি বাড়ি। বরং এখানকার বাসিন্দারা নিজে দায়িত্ব নিয়ে ওয়েস্ট রিসাইক্লিং সেন্টারে গিয়ে বর্জ্য পরিষ্কার করে আসেন।

আবর্জনার কনসেপ্টও এখানে খুবই স্পষ্ট। এই শহরের ওয়েস্ট রিসাইক্লিং সেন্টারে বর্জ্য পদার্থকে বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়েছে। কাগজ, পিচবোর্ড, ম্যাগাজিন-এর মতো আবর্জনার জন্য রয়েছে আলাদা জায়গা আবার প্লাস্টিকের সামগ্রীর জন্য আলাদা জায়গা এবং বিভিন্ন ধাতব বর্জ্যের জন্যও আলাদা জায়গা রয়েছে। এইভাবে আবর্জনার ৩৪টি ক্যাটেগরি রয়েছে। সত্যি বলতে এইভাবে আবর্জনা বাছাই করাটা একটা সময়সাপেক্ষ ব্যপার। সময় লাগলেও এইভাবেই নিজেদের অভ্যস্থ করে তুলেছেন এই শহরের মানুষ। শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ বর্জ্য এইভাবেই রিসাইকেল করা হয়।

সঠিক আবর্জনা সঠিক স্থানে রাখা হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য নিরন্তর দেখাশোনা করছেন এক ব্যক্তি। জানলে অবাক হবে, এত ঝক্কি পেরিয়ে এই কাজ করতে হয়বলে শহরের বেশিরভাগ মানুষ এই পদ্ধতিকে সমর্থন করতেন না। কিন্তু শহরের আইনের বাইরে যাওয়ার উপায়, নেই সেই কারণে ঝামেলাবহুল হলেও এই পদ্ধতিকে আপন করে নিয়েছেন তাঁরা। আরও একটা কারণ হল এই উপায় একদিকে যেমন ব্যয়বহুল নয়, তেমনই খুবই পরিবেশবান্ধব।

কামিকাতসুর রিসাইকেলিং স্টেশনটির সবথেকে উল্লেখযোগ্য দিক হল, শহরের বাসিন্দারা এখানে বাড়ির পুরনো জিনিস, আবর্জনা, বর্জ্য দেওয়ার পাশাপাশি সেখান থেকে পছন্দসই জিনিস বাড়ি নিয়েযেতে পারেন, তাও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। এই কারখানায় কর্মরত এক স্থানীয় ফেলে দেওয়া পুরনো অপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে নিত্যনতুন জিনিস তৈরি করেন, যেমন ধরুন পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে বানানো হল পুতুল। শুধু তাই নয় আবর্জনা রিসাইকেল করে এমন জিনিসও তৈরি করা হয়, যাতে স্থানীয় সরকারও যথেষ্ট লাভবান হয়েছে। যেমন ফেলে দেওয়া কাঠের হাতা-খুন্তি বা চপস্টিক রিসাইকেল করে তৈরি হয়েছে পিচবোর্ড বা কাগজের মতো দ্রব্য। বর্তমানে শহরের অর্ধেকের বেশি অধিবাসীই এই ব্যবস্থায় খুবই খুশি।

কামিকাতসু ছাড়াও জাপানের অন্যান্য শহরে এখনও বর্জ্যপদার্থ পৃথকীকরণের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে পৃথকীকরণ হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা চুল্লিতে পুড়িয়ে ফেলাই রীতি। কিন্তু তার মধ্যে ছোট্ট এই শহর কামিকাতসু কিন্তু নজির সৃষ্টি করেছে, কারণ এখানে আবর্জনা পোড়ানোর কোনও চুল্লিই নেই। পুরোটাই নির্ভর করে রিসাইকেলিং-এর ওপর।

সত্যি কথা বলতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে জাপান যে প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে একথা বলাই যায়। আর সেই প্রযুক্তির কারিগরি দিয়ে এমন অভিনব প্রয়াস করেছে এই ছোট্ট শহরটি যা ইতিমধ্যেই একটি চর্চিত বিষয় হয়ে উঠেছে। দিনে দিনে পৃথিবীতে জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে হিসাব করলে দেখা যাবে মাথাপিছু বর্জ্যের পরিমাণও বাড়তে থাকবে। এমন অবস্থায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাপানের এই প্রয়াসকে কুর্নিশ জানাচ্ছে বিশ্ববাসী।