গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক|

ভোজন রসিক বাঙালির জিভে জল আনা রকমারি মিষ্টি খাবারের পদ খেজুর গুড় ছাড়া ভাবাই যায় না। তাই ডিসেম্বর মাস পড়তে না পড়তেই বাজারে বাজারে খেজুর গুড়ের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। নলেন গুড়ের সন্দেশ, পুলি-পিঠা, গুড়ের পায়েস, জয়নগর বা বহরুর মোয়া সবেতেই চাই খেজুর গুড়। তবে জানেন কি এই খেজুর গুড় তৈরি হয় কীভাবে?

খেজুর গুড় তৈরি হয় খেজুর গাছের রস থেকে। এই রস যারা সংগ্রহ করে থাকেন তাদের ‘গাছি’ বা ‘শিউলী’ বলা হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগণায় প্রচুর খেজুর গাছ দেখা যায়। অক্টোবর মাস থেকেই গাছিরা খেজুর গাছ পরিষ্কারের কাজ শুরু করে দেয়। এরপর পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন গাছের উপরের দিকের অংশ কাটা হয়। যাতে ওই অংশ থেকে রস নিঃসরণ শুরু হয়। অনেক সময় গাছ কাটা শুরুর ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যেই গাছ থেকে খেজুর রস বেরোতে শুরু করে। এরপর ওই কাটা অংশের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয় একটা ‘ইউ’ (U) আকৃতির বাঁশের নল। সেই নল বরাবর মাটির হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। ফোঁটা ফোঁটা খেজুর রস বাঁশের নল বেয়ে হাঁড়ির মধ্যে জমা হতে থাকে। নল বেয়ে রস নির্গত হয় বলে খেজুর রসের গুড়কে নলেন গুড় বলা হয়।

৩ দিন রস সংগ্রহের পর পরবর্তী ৩ দিন গাছ শুকানো করা হয়। তারপর আবার সেই গাছের কোনো অংশ কেটে রস নেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও আগের পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এই পদ্ধতিতে খেজুর গাছকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়। গাছিদের মতে, একটা প্রাপ্তবয়স্ক খেজুর গাছে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত দিনে ১০-২০ লিটার রস পাওয়া যায়। প্রতিবার রস সংগ্রহের পর রসের হাড়ি ভালোভাবে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়, নাহলে সংগৃহীত রস গেঁজিয়ে ওঠার সম্ভবনা থেকে যায়।

গাছ থেকে রস নামানোর ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা বিধি-নিষেধ। দিনের যেকোনও সময় খেজুর রস পাড়লেই হয় না। নিয়ম মেনে সূর্য ওঠার অনেক আগে অর্থাৎ ভোর রাত্রে খেজুর রস নামিয়ে নেয় শিউলীরা। তা না হলে সূর্যের তাপে রস গেঁজিয়ে উঠে তাড়ি হয়ে যায়।

খেজুর রস থেকে গুড় তৈরির প্রণালী –

  • শিউলীরা গাছ থেকে রস নামিয়ে এক জায়গায় জড়ো করে।
  • এরপর সেই রস ছেঁকে নেওয়া হয়।
  • ছেঁকে নেওয়া রস বড় পাত্রে ঢেলে কাঠের আঁচে জ্বাল দেওয়া হয়।
  • রস গরম হলে রসের উপরিভাগে যে ফেনা ভেসে ওঠে তা ছাকনি বা হাতা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়।
  • জ্বাল দেওয়ার পর রস চটচটে ও গাড় বাদামী বর্ণের হয়ে ওঠে। একে বলা হয় সিরাপ, যা অনেক সময় মিষ্টি তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
  • গুড় তৈরির জন্য ওই ফুটন্ত চটচটে সিরাপ হাল্কা আঁচে লাগাতার নাড়া হয়। ক্রমে তা ঘন হয়ে আসলে এক চিমটে পরিমাণ গুড় জলের মধ্যে ফেলা হয়।
  • গুড় জলে পড়া মাত্রই দ্রুত জমাট বাঁধলেই বুঝতে হবে গুড় তৈরি হয়ে গিয়েছে।
  • জ্বাল থেকে গুড়ের পাত্র নামিয়ে তা ঠাণ্ডা করতে দেওয়া হয়।

এই ভাবেই তৈরি হয় আমাদের সকলের প্রিয় খেজুর গুড়। এরপর সেই গুড় বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে পৌঁছে যায়। যা থেকে তৈরি হয় নরম পাকের খেজুর গুড়ের সন্দেশ, হরেক রকম মিষ্টি, মোয়া ইত্যাদি।