লেখক – ঈপ্সিতা নায়ক

অ্যালার্ম ক্লক নয় ঘুম ভাঙে এখানে মোরগের কর্কশ ডাকে। রাতজুড়ে হাড় কাঁপানো শীতের পরে ভোরের স্নিগ্ধ রোদ গায়ে মেখে নিতে বিছানা ছেড়ে বাইরে উঠে আসা। আর চোখ যেদিকেই যায় দেখা যায় নীল আকাশ যার নেই কোনো সীমারেখা। দেখা যায় সবুজ চাদরে মোড়া দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়। কিছু কিছুর ক্ষেত্রে আবার চূড়ায় শোভা পায় সাদা বরফের টুপি। শীতকাল আসার আগে এই গ্রামের ছবিটা থাকে কিছুটা এরকমই। শীতের আগমনের সাথে সাথেই পুরো গ্রামটা ঢাকা পড়ে যায় বরফের পুরু আস্তরণে।

আমাদের পরিচিত রোজকার জীবনের সঙ্গে এর কোনও মিল নেই। পরিচিত জগৎ, তথাকথিত শহর-মফস্বল-গ্রাম এবং সেখানকার সুযোগসুবিধার সীমানা থেকে এই জায়গাটা অনেকটাই দূরে। এখানে ‘জীবন’ মানে একদিকে ‘কষ্টসাধ্য’ আবার অন্যদিকে ‘নির্মল’ একটা পরিবেশ। এরকমই একটি গ্রাম হল ‘খাতি’।

উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুনের কোলেই এই গ্রামের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সাত পরিবার থেকে এখন এই গ্রামের সদস্য বেড়ে হযেছে ৭৫টি পরিবার। প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কের নিবিড়তা ও পবিত্রতা এই গ্রামে প্রত্যক্ষ করা যায়। বাগেশ্বর থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই ক্ষুদ্র পাহাড়ি গ্রামটি। নিকটবর্তী বড়ো শহর বলতে গ্রামবাসীরা বোঝেন বাগেশ্বরকেই। সেখান থেকে বেশ অনেকটা পথ যানবাহন চলার উপযুক্ত বটে তবে শেষ ৪ কিমি পায়ে হেঁটেই পৌঁছতে হয় ‘খাতি’ -তে।

প্রায় দুশো বছরের পুরানো এই গ্রামের ইতিহাস-বর্তমান-আগামী সম্পর্কে গ্রামবাসীরা কিন্তু বেশ অবগত। সেখানে কিছুটা রয়েছে বিশ্বাসের ভীত এবং বাকিটা পরিশ্রমের উপর ভরসা । এখন এই গ্রামের জনসংখ্যা সাড়ে চারশোর কাছাকাছি। সমাজ পুরুষতান্ত্রিক হলেও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটা মানুষের অবদান নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে সমান। গ্রামের মধ্যেই চাষ-আবাদ থেকে শুরু করে পশুপালন সমস্ত কিছুই হয়ে থাকে এবং সেখান থেকে পাওয়া যাবতীয় জিনিস দিয়েই দিন চলে গ্রামবাসীদের জীবন। তাছাড়া অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসের জন্য তাদের ভরসা বাগেশ্বর।

ছোট্ট এই গ্রামে যোগাযোগের মূল মাধ্যম হল মানুষ নিজেই, কারণ মোবাইল কানেকশনের নেই কোনো ভরসা। সেক্ষেত্রে পায়ে হেঁটে যাওয়াই একমাত্র উপায়। তাদের পরিশ্রমের ছাপ রয়েছে গ্রামের প্রতিটি কোণায়। শীতকালে অর্থাৎ ডিসেম্বরে বরফ পড়ে তাদের স্বাভাবিক জনজীবন হয় ব্যাহত। শুরু হয় আর এক সংগ্রাম। এই সব কিছুর মাঝেই তাঁরা এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের অস্তিত্ব। একবিংশ শতাব্দীর উন্নত প্রযুক্তির থেকে অনেক দূরে থেকেও তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করেন। তাঁদের জীবনের ধারা সেখানে কুমায়ুনের প্রতিটি পর্বতমালার মতই স্বতন্ত্র, সেখান থেকে বয়ে চলা পিন্ডার নদীর জলধারার মতই স্বচ্ছ।

ছোট্ট এই গ্রামটিতে পাহাড়ের ধাপে ধাপে রয়েছে বাড়ি। নিজেদের ইষ্টদেবতার পূজারি হলেও মা কালীর আরাধক প্রায় সকলেই। গ্রামের মানুষেরা এখানে মিলেমিশে থাকতে অভ্যস্ত। অসুস্থতার দিনে একে অপরের পাশে দাঁড়ায় তাঁরা, ক্ষেতের কাজ হোক বা বাড়ির ভাগ করে নেয় সকলে। অর্থসাহায্যও করেন অনেকে, ফেরাতে না পারলে শ্রমদানের মাধ্যমে ঋণপরিশোধ করেন। প্রকৃত মহামিলনের দৃষ্টান্ত এটি।


একই গ্রামে মিলবে নানান পেশার মানুষ। কেউ কাঠের কাজে পটু, কেউ কৃষিকাজে, কেউ ধাতুর কাজে, আবার কেউ বা পুজার্চনায় পারদর্শী। পুরুষরা গ্রামের ভিতরেই তাদের নিজ নিজ পারদর্শিতার পারিশ্রমিক নিয়ে অর্থ উপার্জন করে, তাছাড়া ট্রেকিং রুট গাইড হিসাবে তারা গ্রামের বাইরে অর্থ উপার্জন করে থাকে। মহিলারা মূলত সাংসারিক কাজই করে থাকে। পালিত পশুর মধ্যে থাকে গরু যার থেকে নিত্যনৈমিত্তিক বহু জিনিস পাওয়া যায়, খচ্চর যাকে ব্যবহার করা হয় মালবাহক হিসাবে, কুকুর যারা বাঘের সাথে লড়াই করে হাজারো ভেড়ার পালকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখে। প্রতিটি বাড়িতে আর কিছু থাকুক না থাকুক একটি করে কুকুর রয়েছেই।


যদিও দুশো বছর আগেকার ছবিটা ছিল একেবারে অন্যরকমই, চারিদিকে ছিল বনাঞ্চল, বাঘ-চিতা-ভল্লুক ইত্যাদি হিংস্র প্রাণীর বাস। সেখানেই প্রথম আস্তানা তৈরির পরিকল্পনা করেন সেই সাত পরিবারের কর্তা অর্থাৎ এদের পূর্বপুরুষরা। ছোটবেলায় ইতিহাস বইতে পড়া আদিমকালের মানুষের সেই সংগ্রাম যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে এই গ্রামবাসীদের গল্পে। জঙ্গল সাফ করে, হিংস্র জন্তুর সাথে লড়াই করে তারা গড়ে তোলে জনবসতি। আর সেখান থেকেই আস্তে আস্তে ‘খাতি’ আজ স্বাবলম্বী।


এরকম একটা গ্রাম যার পরতে পরতে রয়েছে রোমাঞ্চ তার আস্বাদ গ্রহণ করতে হলে বছরের দুটো সময় উপযুক্ত- এপ্রিল-মে(গ্রীষ্ম) ও ডিসেম্বর-জানুয়ারি(শীত)। হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে নিকটবর্তী হল্দওয়ানি বা কাঠগোদাম স্টেশনে নামা যায়, সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে চড়াই পথে ঘুরে ঘুরে বাগেশ্বরে পৌঁছে যাওয়া যায়। সেখান থেকে পরেরদিন গাড়ি নিয়ে খরকিয়া, তারপরে ভরসা দুই পা। খরকিয়াতে লাঞ্চ সেরে চার কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যায় খাতি-তে। মাত্র পাঁচ-ছয় হাজার খরচেই দিব্যি ঘুরে আসা যায় চারপাঁচ দিন। তবে আর অপেক্ষা কিসের! অ্যাডভেঞ্চার-লাভাররা বছরের শুরুটা কিন্তু এখানে করতেই পারেন!