লেখাঃ প্রতিম রাহা |

‘‘গড়িয়াহাট, গড়িয়াহাট উঠে আসুন, দেখি, ভাড়াগুলো দেখি …’’- কন্ডাক্টরের ডাকে সম্বিৎ ফেরে রথিনবাবুর। এবার নামতে হবে। ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগোন তিনি। বাসে ভিড় নেই। বাইরে পড়ন্ত বিকেলের কলকাতা। স্কুল-কলেজ সবে শেষ হয়েছে। তাই জ্যামটা কিঞ্চিৎ বেশি। লাল-হলুদ রাংতায় ঠাসা প্যাকেট নিয়ে এইমাত্র এক লজেনসওয়ালা গাড়িতে উঠেছে। সামনের সিটের বাচ্চাটা তাকে দেখে বায়না জুড়েছে। রথিনবাবু মনে মনে হাসেন, টুকাই থাকলেও বায়না করত নিশ্চয়ই। বাচ্চারা এমনই হয়।

বাস থেকে নেমে রথিনবাবু দেখলেন মোড়ের সিগন্যালটা লাল। সেই সুযোগে রাস্তা পেরোচ্ছে একঝাঁক তরুণী। সবার পিঠে ব্যাগ। পড়ন্ত বিকেলের রোদে ঝলমল করছে ওদের মুখগুলো। কিন্তু রথিনবাবুর মুখে বিষণ্ণতার ছায়া। বয়স বাড়ছে। সেই সঙ্গে শরীরে বাড়ছে হাজার ব্যামো। আজকাল সব কিছুই কেমন গুলিয়ে যায়। চারপাশের এত মানুষ, পরিবেশ, চেনা জানা ভালোলাগা-গুলো মেলাতে পারেন না আগের মতো। কোথাও একটা শুনেছিলেন, বার্ধক্যে কম-বেশি সবার এমন হয়। অ্যালঝেইমারস না কী যেন নাম রোগটার!

সামনে বড়দিন। রংবেরঙের টুপি বিক্রি হচ্ছে চারদিকে। রথিনবাবুর লক্ষ্য একটা হার্ডওয়্যারের দোকান। অথচ কী যে নিতে এসেছেন, চট করে মনে আসে না। ছুরি ? কাঁচি ? না গাছে জল দেওয়ার পাইপ ? 

আজকাল হামেশাই এমনটা হচ্ছে। আর এই ছোটখাটো ভুলে যাওয়াগুলোই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই তো, দিন পাঁচেক আগের কথা। সন্ধ্যেবেলা হাঁটতে বেড়িয়ে কী বিপদেই না পড়েছিলেন! ফেরার সময়ে পাড়া গুলিয়ে যা-তা কাণ্ড! সেই পাড়া, যেখানে গত ৩৫ বছর তার বাস! শুনলে যে কেউ হাসবে! শেষে দোলন, তার কাজের মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বড় রাস্তার মোড়ে, তাই রক্ষে! বাড়ি পৌঁছালেন, কিন্তু একটু দেরি হয়ে গেল। তার বীমার কাগজ নিয়ে রতন বসে বসে ফিরে গেছে।

কিংবা সুকান্তর দোকানে মাসকাবারির মুদিখানার দাম মেটাতে গিয়ে যা কাণ্ড করলেন, তা-ও কহতব্য নয়! পাশের দোকান থেকে কেষ্ট হাঁক দেয় তাকে, ‘‘ ও রথিনবাবু, এদিকে আসুন। মাল দিলাম আমি, আর টাকা দিচ্ছেন ও ব্যাটাকে !’’

কথাটা সত্যি। কেষ্ট আর সুকান্তর গায়ে গায়ে দোকান। বরাবর কেষ্টর থেকেই মাল নেন রথিনবাবু। মাসের শেষে পেনশনের টাকা ঢুকলে মেটান। দেরি হলে ছেলের থেকে চেয়ে দিয়ে আসেন। কী মরতে যে সেদিন হঠাৎ সুকান্তর দোকানে ঢুকে তাকে পাঁচশো টাকার নোট দুটো ধরাচ্ছিলেন, তিনি নিজেও জানেন না! গিন্নি থাকলে বলত বয়সকালের ভীমরতি! 

এ হেন ঘটনাগুলোই দিন দিন রথিনবাবুর চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে। আজকের সমস্যাটাও বেয়াড়া। বাড়ি থেকে বেরনো অব্দি ঠিকই ছিল সব। যত দূর মনে পড়ে, ঝামেলাটা হল বাসে ওঠার পরেই! একটা লোক জোয়ান না কী যেন বেচছিল! তার দিকে মন যেতেই আসল জিনিস মাথা থেকে বেমালুম হাওয়া!

শুধু মনে পড়ছে, কী একটা কারণে যেন তড়িঘড়ি বেরিয়েছিলেন ! খেয়াল ছিল না বাড়ির সামনের মার্কেটটা আজ বন্ধ! কী করণীয়, দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতেই বাসটা এল, আর উঠে পড়লেন!  টুকাইয়ের স্কুলের কিছু নেওয়ার ছিল কি? নাকি নিজের জন্য কিছু? গড়িয়াহাটেই বা আসলেন কেন, এমন হাজারটা প্রশ্ন রথিনবাবুর মাথায় পাক খায়! ছেলে কতদিন বলেছে, একখানা মোবাইল সঙ্গে রাখতে, দরকারে-অদরকারে কাজে আসে! এখন মনে হচ্ছে, কথাটা খারাপ বলেনি সে।

‘‘আরে রথিন চন্দ যে! ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে কেন!’’ রথিনবাবুর ভাবনায় ছেদ পড়ে হঠাৎ। চেয়ে দেখেন সামনে সুনীল, তার কলেজ ফ্রেন্ড।

আর রোদ নেই। আকাশের রং ক্রমশ কালচে হয়ে আসছে। মাইনাস দুই পাওয়ারের চশমার মধ্যে দিয়ে সুনীলকে ভালো করে দেখেন রথিনবাবু। সেই ঢ্যাঙা শরীর, লম্বাটে নাক, শক্ত চোয়াল। অন্তত ১২ বছর পর দেখছেন, তাও চিনতে অসুবিধে হয় না। দু’জনের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। শেষবার দেখা হয়েছিল শান্তিনিকেতনে, পৌষমেলার সময়ে। সস্ত্রীক গিয়েছিল ও, রথিনবাবুও ছিলেন পরিবারের সঙ্গে।

১২ বছরে সুনীলের চেহারা খুব একটা পাল্টায়নি। সাম্প্রতিক অনেক কিছু ভুলে গেলেও সুনীলকে যে একবারেই চিনতে পেরেছেন, তার জন্য ভগবানকে ধন্যবাদ দেন রথিনবাবু।

‘‘তুই!’’ বিস্ময় ঢাকার চেষ্টা করেন না তিনি।

‘‘এই কাছেই ছেলের বাড়ি তো। পরশু এসেছি। বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি। দিব্বি সময় কাটে।’’

‘‘অহ!’’

ফ্লাইওভারের নীচে জনা আটেক লোক দাবার বোর্ড নিয়ে বসেছে। এক একটা বোর্ডে দু’জন খেলোয়াড়, তাদের ঘিরে চার-পাঁচজন দর্শক। তাদের পাশ কাটিয়ে গোলপার্কের দিকে এগোন রথিনবাবুরা।

মাফলার ঠিক করতে করতে আড়চোখে বন্ধুকে দেখেন সুনীল বৈদ্য; ‘‘তোর শরীর তো বেশ ভেঙে গেছে। গিন্নি খেতে দিচ্ছে না, নাকি ?’’

রথিনবাবু ম্লান হাসেন ‘‘ময়ূরী লাস্ট আগস্টেই চলে গেল। বছর দুয়েক আগে একবার স্ট্রোক হল। সেই থেকেই ভুগছিল। সেকেন্ডটা আর সামলাতে পারেনি। হসপিটালে যেতে যেতেই— একটু দেরি হয়ে গেল।’’

‘‘সে কী! কিছু জানাসনি তো!’’

উত্তর দিতে সময় নেন রথিনবাবু। কাছের দু’একজন ছাড়া গিন্নির মৃত্যু সংবাদ সেভাবে কাউকেই জানাননি তিনি। সুনীলকে জানানো যে প্রয়োজন, সত্যি বলতে এমনটা মনেও হয়নি। হেসে বললেন, ‘‘আর জানানো হয়ে ওঠেনি। তোর নম্বরটাও হারিয়ে ফেলেছি অনেকদিন – ’’

‘‘ কিন্তু বাড়ি যে চিনিস না এমন তো নয়;’’ সুনীলবাবুর গলায় অভিমানের সুর স্পষ্ট– ‘‘ফলতা এখান থেকে খুব দূরে বুঝি! আসা যায় না ?’’

সুনীলের এই রোগটা বড় সাংঘাতিক। কোনও জিনিস নিয়ে পড়লে সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। তাই বিষয়টা এড়ানোর চেষ্টা করেন রথিনবাবু, ‘‘যাক গে, আমার ছাড়। তোর খবর বল।।’’

‘‘ আমার আর কী, ছেলেটা অনেকদিন ধরেই বলছিল ওর কাছে ক’দিন কাটিয়ে যেতে। কাজের এত চাপ, ও বাড়ি যাওয়ার সময় পায় না। নাতনির স্কুলও এখানে। প্রতিমাসে কীসব সাপ-ব্যাং পরীক্ষা হয়েই চলেছে! আমরা কত্তা-গিন্নি বাপু ঝাড়া হাত-পা, বছরে বার দু’য়েক এসে থেকে যাই। এই তো, কাছেই ওর ফ্ল্যাট। যাবি?’’

‘‘নাহ, আজ থাক।’’

এখনও পাঁচটা বাজেনি কিন্তু এর মধ্যেই চারপাশ বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। ফুটপাথ বরাবর পসরা সাজিয়ে বসছে দোকানিরা! সেসব দোকান থেকে রঙবেরঙের আলো রাস্তায় এসে পড়ছে! তার উপর দিয়েই চলে যাচ্ছে গাড়ির স্রোত। ধুপধুনোর গন্ধে ভরে আছে এপাশটা। ওপারের এক সোনার দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকেন রথিনবাবু। গিন্নির বড় শখ ছিল একগাছা কাংরিকাটা সোনার বালার। ভেবেছিলেন আসছে বছর বীমার টাকাটা এলে গড়িয়ে দেবেন। কিন্তু একটু দেরি হয়ে গেল।

‘‘কী, কোথায় হারিয়ে গেলি ?’’ রথিনবাবুর অন্যমনস্কতায় ঠেলা দেন সুনীল বৈদ্য। ‘‘তুই কি কোনও কাজে এসছিস?’’

‘‘হ্যাঁ, কাজ একটা ছিল বটে, তবে—-’’ তবেটা যে কী, রথিনবাবু মনে করতে পারেন না।

 ‘‘সে কাজ হবেক্ষণ’’, বন্ধুর হাত ধরে টানেন সুনীলবাবু— ‘‘আগে ওপাশে চল। একটা লোক বেড়ে চা বানায়।… ’’

কিছু কিছু মানুষ বড় সহজ হয়! এই যেমন সুনীল। ১২ বছর পর দেখা। তার আগে কবে দেখা হয়েছিল, সেটাও মনে নেই। কিন্তু দেখা মাত্রই এমনভাবে কথা বলছে, যেন ফি মাসের আলাপ! রথিনবাবুর মনে হল, তিনিই বুঝি বেশি জটিল হয়ে পড়ছেন। চায়ে চুমুক দিয়ে নিজের স্মৃতিভ্রংশের কথাটা বন্ধুকে বলেই দিলেন শেষমেশ।

সুনীলবাবুর উত্তর, ‘‘ ধুস ! ও আবার সমস্যা নাকি! ৬৫ পেরোলে এটা প্রতি ঘরের ব্যাপার। ১০ জনের মধ্যে খোঁজ নিয়ে দেখ, ১ জনকে পাবিই পাবি। ও নিয়ে চিন্তা করিস না …’’

‘‘কিন্তু তাই বলে এতটা বাড়াবাড়ি ? বাড়ি থেকে বেরোনোর মিনিটকয়েকের মধ্যে ভুলে যাব কী নিতে বেরোলাম? …?’’

‘‘ আরে ডিমেনশিয়া রোগই এমন! কারোর ক্ষেত্রে কম, কারোর বেশি! হতে পারে তোর ক্ষেত্রে একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। একটা ডাক্তারের অ্যাডভাইস নিয়েই নে না!’’

রথিনবাবু বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নাড়েন।

‘‘আর আরও বেটার অপশন যদি চাস তো বলতে পারি এই ধুলো-ময়লা-জঞ্জাল ছেড়ে কটাদিন ফলতায় কাটিয়ে যা আমার কাছে। নদীর খাঁটি হাওয়া, সেই সঙ্গে দু’বেলা খাঁটি মাছ খাওয়াবো। হু হু বাওয়া, দেখবি আগের জন্মের কথাও মনে পড়ছে!’’— চায়ের ভাড়টা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে দিয়ে হেঁসে ওঠেন সুনীলবাবু ; ‘‘গিন্নি যখন নেই, তুই তো ঝাড়া হাত পা, কী বল!’’

 ‘‘নাহ, পুরোপুরি ঝাড়া হাত পা আর কই !’’; রথিনবাবু বলেন, ‘‘টুকাইটা এখনও বেশ ছোট! ছেলে-বৌমা দু’জনেই তো আপিস যায় আমার কাছে রেখে!’’

‘‘কত হল ওর ?’’

‘‘ এবার ছয়ে পড়ল। সকালে স্কুল থেকে আসে, তার পর সারাদিন বাড়িতেই। যা দস্যি হয়েছে একটা—’’

‘‘ বেশ তো, ওকেও নিয়ে আসবি …’’

‘‘ ধুস, ওকে কি আর সঙ্গে নিয়ে—-’’ কথাটা শেষ না করেই থেমে যান রথিনবাবু। নিস্পলক চেয়ে থাকেন সামনের দিকে। রাস্তার ঠিক ওপাশেই একটা চার তলা বাড়ি। তার তেতলার বারান্দা থেকে দড়ি বাঁধা একটা ব্যাগ নীচে নামিয়ে দিচ্ছে এক বৃদ্ধা। নীচে দাঁড়ানো সাইকেলওয়ালা এবার কিছু একটা ভরে দিল ব্যাগে। ফের দড়ির টানে উপরে উঠে যাচ্ছে ব্যাগ।

খুব স্বাভাবিক দৃশ্য। অনেক আবাসনেই এমন দেখা যায়। বারবার ওঠা-নামার কষ্ট এড়াতে এই পদ্ধতি!  কিন্তু রথিনবাবু তাই দেখে থমকে গেলেন কেন! কিছু মনে পড়ল কি তার?

তা পড়ল বৈকি। দড়ি! হ্যাঁ, একগাছা দড়ির সন্ধানেই তো বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিলেন তিনি! কমপক্ষে ৪৫ ফুট লম্বা একটা দড়ির বড় প্রয়োজন ছিল তার! আশপাশের কারোর কাছে অত লম্বা দড়ি পাবেন, সেই আশা ছিল না! ভাবছিলেন কী করবেন। সময় বেশি নেই হাতে। রাস্তাঘাটে লোক কম, সামনের মার্কেট বন্ধ। দেখতে দেখতে বাস এল। উঠে পড়লেন তিনি।

কিন্তু অত লম্বা দড়ির প্রয়োজন পড়ল কেন হঠাৎ? সেটাও অবশ্যি তার দিব্বি মনে পড়ছে এখন। আদরের নাতি টুকাইয়ের আর্তনাদটা পেয়েছিলেন একতলার ঘর থেকেই। ছুটে কুঁয়োর পারে যখন পৌঁছান, দেরি হয়ে গেছে। ছ্যাঁতলা পড়া কুঁয়োর ধারে গড়াগড়ি খাচ্ছে একটা ক্যাম্বিস বল আর বহু নীচ থেকে জলের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ ভেসে আসছে। প্রতিবেশী গোবিন্দর বাড়িতে তালা, তেতলার ভাড়াটেদের ছেলেটা সম্ভবত স্নানে। সাড়া নেই কারো। সাবেকি আমলে গড়া ৪৫ ফুট গভীর কুঁয়োয় জল বেশি না থাকায় তার তল পেতে রথিনবাবুর দরকার ছিল লম্বা একটা দড়ির। সেই দড়ির খোঁজেই তো বেড়িয়েছিলেন তিনি, বেশ মনে পড়ছে এখন!

‘‘কী, চা খেয়ে মাথা খুললো না এখনও সেই তিমিরে ?’’ – সুনীলবাবুর ডাকে চটক ভাঙে রথিনবাবুর। একটা শিরশিরে হিমেল হাওয়া দিচ্ছে। উত্তর না দিয়ে সম্মোহিতের মতো এগিয়ে যান রথিনবাবু। মাথা খুলেছে বৈকি। ভালোই খুলেছে। কিন্তু একটু দেরি হয়ে গেল।