দৃশ্যটা মনে পড়তেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল সুমন্ত্রর। ব্যাঙ্কে ঢুকেই ফোন করে জানতে পারল আজও এয়ারকন্ডিশন সারাতে আসবে না। আগের সার্ভিসের জন্যই টাকা পায়নি অর্ডার এপ্রুভ হতে দেরি হওয়ায়। এখন তাই ধ্যানাইপানাই করছে। অগত্যা সেই আওয়াজ ওঠা স্ট্যান্ড ফ্যানটা। ওটাকে বড় ভয় করে সুমন্ত্রের। সেবার রিজিওন্যাল অফিসের সাহেবের কাছে কী অপদস্থই না হতে হয়েছিল। সাহেব যখন ঢুকলেন তখন বেয়ারা আত্মারাম সুমন্ত্রের টেবিলের তলায় হামাগুড়ি দিচ্ছে। এক ডাকসাইটে ব্যবসাদারের লোনের কাগজ হওয়ায় উড়ে ঢুকে গিয়েছিল টেবিলের তলায়। আত্মারাম হামাগুড়ি দিয়ে খুঁজছিল। আরও কিছু উড়ে না যায় তাই পাখা বন্ধ করে পেপার ওয়েট চাপা দিতে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল সুমন্ত্র। সেই সময় সাহেব ঘরে এসে অবস্থা দেখে হেসে গড়াগড়ি।

সুমন্ত্র সে পরিস্থিতিতে হঠাৎ সাহেবকে দেখে, লন্ডভন্ড অবস্থায় হতভম্ব হয়ে ‘সরি স্যার’ বলে আবার সেই রাক্ষুসে ফ্যানটা অন করে দিল। আত্মারাম টেবিল নীচে থেকে চমকে উঠে মাথা তুলতে গিয়ে টেবিলের কিনারায় মাথা ঠুকল। আর সব কাগজ চাপা দেওয়া সত্ত্বেও কোথায় একটা লুজ থেকে গিয়েছিল কে জানে, আমার মুক্তি হওয়ায় হওয়ায় ভেবে নিয়ে সেই কাগজটা সোজা উড়ে গিয়ে সাঁটল সাহেবের হাসি মুখে!

আজ ফ্যানটা চালাবার আগে সেদিনের ঘটনা ছবির মতো মনে পড়ে গেল সুমন্ত্রর। বাইরে মানুষের লাইন দেখে এসেছে সুমন্ত্র। এবার কাস্টমার গেট খুলে দিলেই তাঁরা পিলপিল করে ঢুকে পড়বে। ভেতরে ভিড় বাড়বে, গরম বাড়বে, মাথা গরম করে কিছু অসন্তুষ্ট লোক চিৎকার করবে। অথচ এমন জ্যাবজ্যাবে বিরক্তিকর দিনলিপি থেকে কিছুটা মুক্তি পেতেই সেন্ট্রাল এসি ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নোটসিট থেকে টেন্ডার সবই দায়িত্ব নিয়ে করেছিল সুমন্ত্র। যাতে একটু স্বস্তিদায়ক হয় পরিবেশ। হালকা করে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানোর ব্যবস্থাও হয়েছিল। সেটা অবশ্য খারাপ হয়নি, অন করলেই বাজছে।

সুমন্ত্র টেবিলের সব কাগজের ওপর ফাইল আর পেপার ওয়েট চাপিয়ে উঠে গেল গান বাজাতে। ক্যাশ কাউন্টার আর লোন সেকশন মিলে কিছু কর্মী বাদ দিলে কজন লোকই আর অবশিষ্ট আছে এই মফস্বলের এই শাখায় ? রিটায়ারমেন্ট হচ্ছে, নতুন লোক ঢুকছে না। তাই এখন অনেক টুকটাক কাজ ম্যানেজারকেই করে নিতে হয়।

অথচ হতভাগা সঞ্জয়কে দেখো। কী আরাম! দৃশ্যটা মনে পড়লেই রাগ চড়ে যায়। ব্যাটা পুটলিটা মাথার বালিশ বানিয়ে এসির হাওয়ায় ঘুমাচ্ছে। প্রাত্যহিক চাপ নেই, ভবিষ্যতের উদ্দেশ্য নেই, লক্ষ্য নেই, শুধুই আরাম।

অথচ চাইলে কী হতে পারত ছেলেটা! কত ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল। নীচু ক্লাসে প্রথম হত স্কুলে। কিন্তু হাইয়ার সেকেন্ডারি লেভেল থেকে সেই যে আনমনা, উদাসী হয়ে গেল। কলেজে গিয়ে সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। পুরোপুরি লুনাটিক হল সঞ্জয়। প্রথমে মাটি, আকাশ, জ্যোৎস্না ছেনে কবিতার ভাষা খুঁজে হন্যে হল। এর পর শুরু হল অনন্তের প্রাণ স্পন্দন স্পর্শ পাওয়ার নাছোড় আকুলতা।
তখন কত কী খুঁজত। মূর্ত, বিমূর্ত, জাদুবাস্তবতা। আর এখন সারা শহর হেঁটে বেরিয়ে খোঁজে এটিএম। রক্ষীবিহীন এটিএম। যেখানে টাকা নেই, কিন্তু এসি ঠিকঠাক আছে। এর পর এই গরম দিনে সারাদিন ঠাণ্ডার আরাম। বসবে, শোবে, হাই তুলবে, আড়মোড়া ভাঙবে। দেখলে হাড়পিত্তি জ্বলে যায়। পরিবার বলে তো আর কিছু নেই শুনেছে সুমন্ত্র। বাবা, মা গত হয়েছে। পাগল বলে আত্মীয়স্বজন কেউ পোঁছে না। মাথার আশ্রয় নেই, পেটে খাবারের নিশ্চয়তা নেই। এত নিশ্চিন্তি আসে কি করে! সুমন্ত্র রাগে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফ্যানের হওয়াটাও গরম লাগছে। বন্ধ করিডোরে এত লোকের নিঃশ্বাস জমছে। এক ছোকরা ক্যাশ কাউন্টারে ঝামেলা করছে একশো টাকার বান্ডিল চেয়ে।

মিনমিন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে, ‘‘তুমি যত ভার দিয়েছ সে ভার করিয়া দিয়েছ সোজা, আমি যত ভার জমিয়ে তুলেছি, সকলি হয়েছে বোঝা।’’

সুমন্ত্র ব্যাঙ্কে আসার পথে দেখে এসেছে সঞ্জয় কোন এটিএম-এ সেঁধিয়েছে। সেটা সুমন্ত্রের ব্যাঙ্কের। ওটার মেশিন খারাপ হয়ে আছে বেশ কিছুদিন। মেরামত হতে সময় লাগবে। সুমন্ত্রের মনে হল যখন লোন রিকোভারি অভিযানে বেরবে, তখন একবার সিকিউরিটি দিয়ে খেদিয়ে দিয়ে আসবে সঞ্জয়কে। কেন কে জানে, সুমন্ত্রের সঞ্জয়কে দেখলেই একটা অস্বস্তি শুরু হয়। সেদিন সন্ধ্যে বেলা বাজার থেকে ফিরছিল সুমন্ত্র। এক হাতে পাঁচ কেজি আলু, অন্যহাতে মুদিখানার ভার। স্টান্ডে রিকশা নেই, দুটো টো টো র সঙ্গে দরদামে পোষাল না। কাঁধ থেকে হাত দুটো খসে যাবার উপক্রম হচ্ছিল। সেই সময় গুনগুন করতে করতে হওয়া খেতে বেরিয়েছিল সঞ্জয়। সুমন্ত্রের সামনে এসে একবার থমকে দাঁড়িয়েছিল।

তারপর নিজের স্বভাবসিদ্ধ বিস্মৃতির ঘোরে চলে গেল। ও কি বিদ্রূপ করল? সুমন্ত্র বুঝতে পারেনি। পকেটের মধ্যে মোবাইলটা মূর্হুমূহ বেজে চলেছে। সুলতার তর সইছে না। কখন সুমন্ত্র ফিরবে! বাচ্চাটাকে সুমন্ত্রর ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে মুক্ত হবে। সুমন্ত্রর এত বিরক্ত লাগছিল। এমন হলে সব রাগ গিয়ে পড়ে সঞ্জয়ের ওপর। ও কেন ওই রকম?

যেন নিজের মুক্তি বিজ্ঞাপন করছে দেখিয়ে দেখিয়ে। আজ তাই যখন আসার সময় দেখল সঞ্জয় এসিতে বসে হাই তুলছে, আর এদিকে প্যাচপ্যাচে অবস্থা । প্রথমেই মনে হয়েছিল কখন ওটাকে ঠান্ডা ঘর থেকে বার করে বাস্তবের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দেব।
খুব আনন্দ হয়েছিল যখন দুপুরে কাজে বেরিয়ে ব্যাটাকে সিকিউরিটি লাগিয়ে বার করে দেওয়া হল। কিন্তু সঞ্জয়ের তাতে কোনও হেলদোল হল বলে মনেই হল না। সে নিজের স্কুলের ক্লাসমেট সুমন্ত্রকে চিনতেই পারে না কোনও দিন। নিজের পুটলি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অন্য ঠান্ডা ঘরের খোঁজে। শুধু যেতে যেতে বিড়বিড় করে সিকিউরিটি কে অভিশাপ দিয়ে গেল, খুব বার বেড়েছে মানুষের। একদিন সব ডানা ছাঁটা পড়বে।

2
এত তাড়াতাড়ি সঞ্জয়ের শাপ ফলবে বোঝা যায়নি। পৃথিবীর এই অন্য পরিস্থিতি, অন্য জীবন অভ্যাসে আনা কঠিন হয়ে পড়েছিল সুমন্ত্রর। সব কিছু যেন বদলে গেল। শুনশান রাস্তা, বাজার। হঠাৎ দিকশূন্য হয়ে পড়ল প্রমোদের সব আয়োজন। এর পর শুধু অপেক্ষা পুরনো অভ্যেস কবে ফিরে পাওয়া যাবে! নিজেকে মুখোশে ঢেকে এখন সুমন্ত্রকে ব্যাঙ্কে বেরতে হয়। বড্ড ভয় লাগে। কার শরীরের কী অবস্থা। সহকর্মীদের সন্দেহ হয়। তবে ব্যাঙ্কে ভিড়টা বাইরেই জমে। ভেতরে অল্প লোক ঢুকতে দেওয়া হয়। ফলে ভেতরে গুমট ভাবটা কমেছে। দু’দিন আগে পুরনো ফাইলের ঘরটা ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে এসি খারাপ হবার আসল কারণটা উদ্ধার করেছে সুমন্ত্র। ফাইল ঘর দিয়ে ভেতরে ঢুকে আসা এসির কেবল কেটে দিত ইঁদুরে। পেস্ট কন্ট্রোল করে এসি ঠিকঠাক আছে বেশ কয়েক সপ্তাহ। ঠান্ডা ঘর। তবু এসির মাধ্যমে রোগ ছড়াতে পারে কেউ কেউ সাবধান করে যায়। কিন্তু এসি ঠিক হয়ে যাবার পর থেকে সুমন্ত্র অবচেতনে অনুভব করছিল অন্য কিছু।

এই ভিন্ন সময়ের অন্য বাস্তবতার মধ্যে সেদিন এটিএম-এ টাকা তুলতে গিয়ে হঠাৎ একটা বাইরে গড়াগড়ি খাওয়া একটা ছেঁড়া পুটলি দেখে সঞ্জয়কে মনে পড়ে গেল সুমন্ত্র। পাড়ার যে দোকানগুলো মানবিকতার খাতিরে ওকে খেতে দিত, সবই তো বন্ধ দীর্ঘদিন।

সঞ্জয় কি অন্য কথাও চলে গেল? নাকি না খেতে পেয়ে মারা পড়ল? মানুষের মৃত্যু কি এত সহজ? কিন্তু অসম্ভব তো নয়। এই তো হেড অফিসে মনুবাবু মরে গেল। জ্বর শ্বাস কষ্ট নিয়ে ভেন্টিলেশনে ঢুকল আর জেনারেল বেডে ফিরল না। বাড়ির লোকেরা কিছুই দেখতে পেল না আর।

কী যেন মনে করে স্কুটি নিয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল সুমন্ত্র। ওর নিজের শিকলে বাঁধা গতানুগতিক জীবনের বিপরীত গল্পটা দেখতে পেত সঞ্জয়ের মধ্যে। ওটা যেন অন্য সুমন্ত। যে ওকে একটা দিকশূণ্য, মুক্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরত। দেখে রাগ হত, মাঝে মাঝে ভেঙে দিয়ে শোধ নেওয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু সেটা হারিয়ে যাক এটা কখনও চায়নি। সঞ্জয়কে খুঁজতে বেশ লাগছিল সুমন্ত্রর। এই ঘোরাফেরা। যেন একটা জনশূন্য নগরীতে হারিয়ে গেছে একদিন। খুঁজতে খুঁজতে দেখা গেল একটা ক্লাবের কমিউনিটি কিচেনের লাইনে বাটি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সঞ্জয়। গলদঘর্ম হয়ে আছে।

দূর থেকে অনেকক্ষন দু’চোখ ভরে দেখল সুমন্ত্র। ক্লাবের সেক্রেটারির কাছে গিয়ে ফান্ডে কিছু ডোনেশন দিল। বলল, ‘‘ওই পাগলটা বড় ভাল ছেলে। অমন হয়ে গেছে গ্রহের ফেরে। ওকে রোজ ডেকে খাওয়াবেন। আমি আবার আসব। আমাদের ব্যাঙ্ক কর্মীদের সংগঠনের পক্ষ থেকেও আপনাদের উদ্যোগে সাহায্য করা হবে।’’

এরপর সুমন্ত্র সঞ্জয়ের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ব্যাঙ্কের বাইরের এটিএম-এর এসি ঠিক আছে। টাকা নেই। সিকিউরিটি করোনার ভয়ে আসছে না। খেয়ে দেয়ে চলে আয়। বুঝলি!

সঞ্জয় কী বুঝল কে জানে । সে চোখ বড় বড় করে সুমন্ত্রের হাত দুটো খুব মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করল। এরপর সরল হেসে নিজের মাথা চুলকে বলল, ‘‘আকাশ, মেঘ, জ্যোৎস্না তোকে ডাকছে, এবার তোর ডানা গজাবে।’’

ইলাসট্রেশানঃ স্মৃতীশ মণ্ডল