শতরূপা বোস রায়|

পর্ব – ১

জার্মানির বার্লিন শহরের উত্তর দিকে বুক (BUCH) নামে এক গ্রামের পার্শবর্তী একটি ছোট্ট গ্রামে থাকে গিলবার্ট এবং তার স্ত্রী মারিয়া। পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট্ট বাড়ি তাদের। ১৬ বছরের একটা বুড়ো ল্যাব্রাডার এবং তিনটে বিড়ালকে নিয়ে দীর্ঘ ৮০ বছর ধরে তাদের বাস। এই গ্রামে একটাই চার্চ, একটাই স্কুল, যেখানে গিলবার্ট এত বছর শিক্ষকতা করে এসেছে। একটাই পোস্ট অফিস, একটাই ব্যাংক। ইদানিং ব্যাংকটা উঠে গিয়ে গ্রামের যেখানে হাট বসে প্রতি শনিবার, সেই পাথর বাঁধানো চকের পাশে একটা এটিএম তৈরি হয়েছে। পাহাড়ের কোলে, গিলবার্টের বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেক দূরে একটাই দোকান। সেখানে কিছু ফল, ডিম, পাউরুটি, মাখন, দুধ, জার্মান বিয়ার, আর চকোলেট পাওয়া যায়। দোকানটি চালায় গিলবার্টের বাল্য বন্ধু জর্জ। জর্জ তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে এই দোকান। আগে বার্লিনে কোনও এক বেসরকারি অফিসে চাকরি করত জর্জ। গত ১০ বছর যাবৎ বাবার মৃত্যুর পর থেকে জর্জ শহরের চাকরি ছেড়ে এই সামলায়, এখান থেকেই যা রোজগার।

এই গ্রামে সকাল হয় নিজের নিয়ম মেনে। সূর্যের অলস রশ্মি রাশি একবুক উষ্ণতা নিয়ে হেসে ওঠে পাহাড়ের চূড়ার মাঝে। সেই আলোর খানিকটা ঢোলে পরে গিলবার্টের কনসারভেটরির ভেতর। সকাল হয়, গিলবার্ট ঘুম ভেঙে উঠে কাঁচের ভেতর দিয়ে দিনের প্রথম আলোকে অভিবাদন জানায়। আরও কয়েকটা অলস প্রহর যাপন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে গিলবার্ট।

এই গ্রামে শহরের ভিড় নেই, হৈ-হুল্লোড় নেই, অফিস নেই, তাড়াহুড়ো নেই। ঘুম ভেঙে উঠে অনেকটা সময় কনসারভেটরিতে কাটিয়ে, তারপর গিলবার্ট পাউরুটি, দুধ আর ডিম কিনতে জর্জের দোকানে যায়। সকাল ১০টায় জর্জ দোকান খোলে রোজ। একটা সময় ছিল যখন সবাই একত্রিত হতো দু’বেলা জর্জের দোকানে। গিলবার্ট, গোমস, বার্নার্ড, এডলফ, এঙ্গেলবার্ট, এরিক। একসঙ্গে বসে বিয়ার খেত সারা সন্ধ্যে, একটা ছোট্ট সাদা-কালো টিভিতে ডি-এফ-বি সুপারকাপ, ইউ-ই-এফ-এ চ্যাম্পিয়নস লীগের খেলা দেখত। আর এখন একা গিলবার্ট আর এরিক পরে আছে। বাকিরা পাহাড়ের চুড়ো অতিক্রম করে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় নিরুদ্দেশের পথে রওনা হয়ে গেছে। গিলবার্টের বুঝি এখনও অনেকটা পথ অতিক্রম করা বাকি।

মারিয়া ঘুম ভেঙে উঠে অপেক্ষা করে, গিলবার্ট ফেরে তারপর কবেকার পুরনো একটা সাদা-নীল পোর্সিলিনের কেটলিতে চা “ব্রু” করতে দেয়। গিলবার্টের শরীর ইদানিং শিথিল হয়ে এসেছে। তাই পাহাড়ের উঁচু-নীচু বেয়ে হেঁটে আসতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। তবুও সকাল হলেই সেই ভেড়ার লোমের পুরনো কোট, লাল বা নীল টাই আর হাতে একখানা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পরে গিলবার্ট। বহুদিনের অভ্যাস, সকাল হলেই জর্জের দোকানে আসা, প্রত্যেকদিনের এই বাজার করা, সে অভ্যাস ছাড়তে পারে না সে। গিলবার্ট বাড়ি ফিরলে দু’জনে মিলে সারা সকাল ধরে চায়ের কাপ হাতে পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকা-বাঁকা পথ বেয়ে উঠে আসা গাড়িগুলোর দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চুলের কাঁটার মতো আঁকা-বাঁকা এই পথ কেমন যেন তাদের জীবনের গতিপথের মতো। এই পথই তো একদিন বেছে নিতে হবে। তাই হয়তো অপেক্ষা নিরন্তর। মারিয়া ইদানিং আর রান্না করতে পারে না। কিছুদিন আগে অবধি কী অনায়াসে স্টেক, রোস্ট, পুডিং, কাস্টার্ড, কেক বানিয়ে ফেলত সে, কিন্তু কিছুদিন যাবৎ কেমন যেন জীবন স্তব্ধ মারিয়া। হয়তো বা জীর্ণ শরীরটা সঙ্গ দেয় না আর? হয়তো বা একাকী রিক্ত মনটা ছুটি চায় এবার? মারিয়া বুঝতে পারে না। এই স্তব্ধতা তাদের নিঃসঙ্গ, নিস্তরঙ্গ জীবনকে কেমন যেন নিস্পন্দ নিথর করে তুলেছে। যতগুলো দিন এই পথে ওঠা-নামা ততদিন অন্তত বেঁচে তো থাকতে হবেই। গিলবার্ট বোঝায় মারিয়াকে। সুখ নিয়ে বেঁচে থাকা যেমন, দুঃখ-শোক নিয়েও তো বেঁচে থাকতে হবে। কিন্তু মারিয়া ঘুরে দাঁড়াতে নারাজ। একমাত্র মেয়ে মানুষিক রোগগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছিল বছর পাঁচেক আগে। কনসারভেটরি থেকে যে পথ নীচে সবুজ সমতলে নেমে গেছে, সেই পথেই। সেদিন মৃত্যু স্মৃতিকে অমর করেছিল। মৃত্যুর ছায়া যেন আজও কুয়াশার গায়ে লেগে আছে। 

কিন্তু এ ঘটনা আগনেসের মৃত্যুকে ঘিরে নয়।

সেদিন লুনাকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিল মারিয়া। দিনের মধ্যে ৪-৫ বার লুনাকে নিয়ে বেরোতে হয়। সেদিনও সন্ধে নামার আগেই বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে এক পাক ঘুরে আসবে বলে বেরিয়েছিল মারিয়া। ড্রাইভয়ে পেরিয়ে বাগান বেয়ে কনসারভেটরিতে ঢোকার একটা দরজা আছে বাড়ির পেছন দিকে। কুকুর হাঁটিয়ে এসে চিরকাল মারিয়া ওই দরজাটাই ব্যবহার করে।  সদর দিয়ে নোংরা পায়ে ঢুকলে কার্পেট নোংরা হয়। সেদিন লুনাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় প্রচন্ড ভয় পেয়েছিল মারিয়া। লুনাও হয়তো বা টের পেয়েছিল কিছু। ওর ঘেউ ঘেউ শব্দেই বোধয় লোকটা… 

মারিয়া হয়তো পারত আটকাতে? অন্তত চিৎকার করে লোক জড়ো করতে। কিন্তু সে এখন অশীতিপর বৃদ্ধা। কতটুকুই বা তার শারীরিক ক্ষমতা? আর তাছাড়া এই প্রত্যন্ত গ্রামে কোথায় বা লোক? কেই-ই বা ছুটে আসবে এক ডাকে? লোকে তাকে বিশ্বাসই বা করবে কেন? শোকস্তব্ধ সে, লোকে কী বলবে না পুরোটাই মনের বিকার? সারাদিন অলস প্রহর যাপনে, ঘোর একাকীত্বে, জীবনের উত্থান পতনে, জড়ায়, জীর্ণ শরীরে মারিয়া এখন প্রায় সমাজ পরিত্যক্ত। মারিয়া নিজেই ভাবে, সে ঠিক দেখেছে তো? গিলবার্টকে এসে সবটা বলতে ভয় পায় সে। কিন্তু লুনাকে চিৎকার করতে শুনে গিলবার্ট বার বার প্রশ্ন করে মারিয়াকে। উত্তর খুঁজে পায় না মারিয়া। চোখের ভুল না তো? 

দুপুর বেলা হয়তো বা একটা স্যান্ডউইচ আর আধখানা ফল। সেও এই কনসারভেটরিতে বসেই। এখান থেকেই যে পথের হদিশ মেলে। এখান থেকেই যে দেখা যায় সব আলো কেমন করে নিভে যায়। কেমন করে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। পাহাড়ের অন্যদিকটায় জমাট বাঁধা অন্ধকার। কনসারভেটরি থেকে দেখা যায় দূরে সমতলে টিমটিম করে কয়েকটা আলো। ঘরের ভেতরে মোমবাতি জ্বলে বেশি। গিলবার্ট ইলেক্ট্রিকের আলো ভালোবাসে না। জোনাকিরা ভিড় করে গাছে।

গিলবার্ট মারিয়াকে নিয়ে চিন্তা করে।  জর্জের দোকানে পুলিশ এসেছে দু’বার। মারিয়ার পুলিশের সঙ্গে দেখাও করতে চেয়েছে বার বার। কিন্তু গিলবার্ট রাজি হয়নি। এরিক ছিল না কিছুদিন এই গ্রামে, ছেলের কাছে গিয়েছিল বার্লিন, ফিরে এসে সমস্ত ঘটনা গিলবার্টের কাছে শোনে।

গত কয়েক মাস যাবৎ জর্জের দোকানের সামনে একটি ফুলওয়ালা এসে বসছিল। মারিয়া রোজ বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে সেই ফুলওয়ালার কাছ থেকে এক তোড়া সাদা গোলাপ কিনে আনত। আগনেসের কফিনে দেবে বলে। এই গ্রামে এই ফুলওয়ালা নতুন এসেছিল। গ্রামের সব মিলিয়ে মাত্র ২০০ কী ৩০০টা পরিবার। সুতরাং সবার সঙ্গে আন্তরিক আলাপ না থাকলেও মুখ চেনা প্রায় সকলেই গিলবার্টের, বিশেষ করে যখন এতদিনের বাস। 

সেদিন মারিয়া একটা সাদা রঙের স্কার্ট, আর গোলাপি রঙের কার্ডিগান পরে ফুল কিনতে গিয়ে ফুলওয়ালার সঙ্গে আলাপ পাতিয়েছিল। ফুলওয়ালা বলেছিল, মারিয়ার বাড়ি ফুল পৌঁছে দেবে সে রোজ, তার আর আসার দরকার নেই । দু’দিন বাড়িতে টাটকা গোলাপ পৌঁছেও দিয়েছে ফুলওয়ালা। মারিয়া তাকে বাড়ির মধ্যে ডেকে এনে তার কাঁপা কাঁপা হাতে চা এবং নিজের হাতে বানানো চকোলেট কুকিস খাইয়ে আপ্যায়ন করেছে। কিন্তু কথায় কথায় ফুলওয়ালার নামটা জেনে উঠতে পারেনি। জর্জ একবার বলেছিল প্রথম দিকে, সে নাকি জার্মান না। তার জার্মান ভাষায় অন্য ভাষার ছায়া পরে। গিলবার্টও ভেবেছিল, বার্লিন থেকে ৫০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে এই গ্রামে কেন আসে সে? কটা ফুলই বা বিক্রি হয় তার সারাদিনে এই প্রত্যন্ত গ্রামে? জর্জ বলেছিল ফুলওয়ালার ওপরে নজর রাখতে হবে।

মারিয়ার রাতে ঘুম আসে না। সে এই কনসারভেটরিতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মারিয়াও গিলবার্টকে জানিয়েছিল, ফুলওয়ালার গাড়ি পাহাড় বেয়ে উঠে আসে দিনের আলো ফোটবার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু তারপর তো আর ফেরত যায় না শহরে? রাত্রি দুই প্রহরে গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখেছে সে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে।  সে রাত্রে দেখেছে একটা গাড়ি পাহাড় বেয়ে নেমে যাচ্ছে সমতলে। তবে কি সেটাই ফুলওয়ালার গাড়ি?

ফুলওয়ালা কদিন যাবৎ আসছে না গ্রামে। মারিয়া হয়তো বা জানে কারণটা। পুলিশ এসে আবারও হানা দিয়ে গেছে জর্জের দোকানে। পুলিশ জনিয়েছে তার নাকি এই গ্রামেই একটা আস্তানা ছিল। কিন্তু কেউ জানে না সে কথা, সবাই জানত ফুলওয়ালা রোজ বার্লিন থেকে গাড়ি চালিয়ে আসত এবং দিনের শেষে ব্যাবসা বন্ধ করে ফেরৎ যেত বার্লিন।

পুলিশ এবারে গিলবার্টের সঙ্গেও কথা বলতে চায়। রোজ ফুলওয়ালা মারিয়ার বাড়ি গিয়ে ফুল দিয়ে আসত সে খবর পৌঁছয় পুলিশের কাছে। মারিয়াকে ঘরের মধ্যে রেখে গিলবার্ট কথা বলে একা। সে বলে, ফুলওয়ালা বাড়ির মধ্যে কোনওদিন ঢোকেনি। পুলিশ তেমন কিছু তথ্য না পেয়ে ফিরে যায়। 

মারিয়া কনসারভেটরি থেকে দেখে পুলিশের গাড়ি পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে যাচ্ছে নীচে সমতলে।

(চলবে)