রানু ভট্টাচার্য|
নবাব সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ব্রিটিশ রাজশক্তির কাছে পুরস্কৃত হয়েছিলেন মহারাজা নন্দকুমার। কিন্তু সেই ব্রিটিশ আদালতের বিচারেই তাঁর ফাঁসি হয়। দিনটা ৫ আগস্ট, ১৭৭৫। আর সেটাই ছিল একটা পরিপূর্ণ বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এদেশের প্রথম ফাঁসি।
খিদিরপুরের কাছে কুলিবাজার অঞ্চল, অর্থাৎ আজ যেখানে হেস্টিংস তখন সেই জায়গা ছিল লোকালয় বর্জিত। সেই রাজপথেই সেদিন ছিল লোকে লোকারণ্য। এর আগে ফাঁসি অনেকেই দেখেছেন। ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে ফাঁসি দেওয়া হত রাস্তার ধারে গাছের উপর থেকে। প্রত্যেকে যাতে অপরাধীর অন্তিম পরিণতি প্রত্যক্ষ করেন, তাই এই ব্যবস্থা ছিল। নন্দকুমারের ফাঁসিও হয়েছিল প্রকাশ্যে। কিন্তু তার জন্য একটা আস্ত কূপ খোঁড়া হয়েছিল। এ যে হাইকোর্টের রায়ে প্রথম ফাঁসি। তাই এমন ঘটনার সাক্ষী থাকতে ভিড় ভেঙে পড়েছিল রাজপথে।
নন্দকুমারের মামলাটি ছিল অতি সাধারণ। সামান্য একটি জালিয়াতির মামলায় তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ব্রিটিশ আদালতে অবশ্য জালিয়াতির শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু এদেশের চিরাচরিত আইনে এমন কঠোর শাস্তির কথা কেউ কল্পনাও করতে পারতেন না। তবে ঘটনার বীজ লুকিয়ে ছিল অনেক গভীরে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নন্দকুমার নানাভাবে দেশীয় রাজশক্তিকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ তার প্রমাণ পেয়েছে বহুবার। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে বাগে আনতে পারেননি। আর তাই এই জালিয়াতির মামলার সূত্রে তাঁরা পেয়ে গেলেন শেষ মোক্ষম অস্ত্র।
তবে নন্দকুমারের সঙ্গে মূল দ্বন্দ্ব ছিল লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের। এদেশের গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার আগে তিনি ছিলেন কোম্পানির সামান্য একজন কর্মচারী। সেই সূত্রে তাঁর দায়িত্ব ছিল বর্ধমান, নদীয়া এবং হুগলির খাজনা আদায় করা। কিন্তু ১৭৬৩ সালে নন্দকুমার হেস্টিংসের বিরুদ্ধে অর্থ তছরুপের অভিযোগ আনলেন। কোম্পানির কাছে সমস্ত প্রমাণ দাখিল করলেন। আর তার ফলে হেস্টিংসকে সেই পদ থেকে সরিয়ে নন্দকুমারকে কালেক্টর নিযুক্ত করা হয়। এই ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন হেস্টিংস। কিন্তু তখন তিনি কিছু করতে পারেননি। কারণ লর্ড ক্লাইভ নন্দকুমারকে স্নেহ করতেন। পরে অবশ্য বিভিন্ন দেশীয় রাজার সঙ্গে নন্দকুমারের গোপন পত্র বিনিময়ের কথা জানতে পেরে সেই সম্পর্ক তিক্ত হয়। তবু সাধারণ মানুষের কাছে কিন্তু নন্দকুমার ক্রমশ একজন নির্ভীক, সৎ এবং জনহিতৈষী ব্যক্তি বলেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। এমন সময়েই এল সেই জালিয়াতির মামলা।
নন্দকুমারের সঙ্গে জহরতের কারবার চলত বোলাকিদাস জহুরির। নবাব মীর কাশিমের আমলে একবার নন্দকুমার তাঁকে একটা মুক্তার হার, একটা কলকা, একটা শিরপেচ এবং চারটি হীরার আঙটি বিক্রি করতে দেন। কিন্তু যুদ্ধের সময় কাশেমবাজার লুঠ হওয়ায় বোলাকিদাসের নিজের জিনিসের সঙ্গে এগুলিও লুঠ হয়ে যায়। অতঃপর বোলাকিদাস নন্দকুমারকে ৪ হাজার ২১ টাকা পরিশোধ করবেন বলে অঙ্গীকারপত্র লিখে দেন। সেইসঙ্গে ৪ শতাংশ হারে সুদ দেবেন বলেও জানান। বোলাকিদাসের মৃত্যুর পর পদ্মমোহন দাস সেই টাকা পরিশোধও করেন। কিন্তু পদ্মমোহনের মৃত্যুর পর বোলাকির এক আত্মীয় গঙ্গাবিষ্ণু সেই টাকার হিসাব নিয়ে নন্দকুমারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। নন্দকুমার তখন তাঁর কাছে থাকা অঙ্গীকারপত্রের জোরে মুক্তি পান। কিন্তু ঠিক এই সময় ১৭৭৩ সালে হেস্টিংস আবার কলকাতায় এলেন। এবার তিনিই গভর্নর জেনারেল। সেইসঙ্গে রেগুলেটিং অ্যাক্ট অনুসারে কলকাতায় তৈরি হল হাইকোর্ট। তখন হেস্টিংসের পরামর্শে গঙ্গাবিষ্ণু হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন এবং বোলাকিদাসের অঙ্গীকারপত্রটি জাল বলে দাবি করেন। এই মর্মে মামলা শুরু হয় ১৭৭৫ সালের ১২ মে।
শোনা যায় নিজের সপক্ষে যাবতীয় যুক্তি নন্দকুমার পেশ করেছিলেন। কিন্তু বিচারপতি এলিজা ইম্পে তাঁর কোনো কথাতেই কর্ণপাত করেননি। হেস্টিংসের প্রাণের বন্ধু এলিজা শুধু ভেবেছিলেন, কী কী প্রকারে নন্দকুমারকে শাস্তি দেওয়া যায়। অবশেষে ১৬ জুন ফাঁসির রায় বেরোল এবং ৫ আগস্ট ফাঁসির দিন স্থির করা হল। তবে এর পরেও নাকি মামলা গড়িয়েছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। সেখানে হেস্টিংস এবং এলিজা দুজনকেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। কারণ প্রথমত যে মামলায় নন্দকুমার শাস্তি পেলেন সেটি শুরু হয়েছিল হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার আগে। অতএব আইন মোতাবেক তা হাইকোর্টের এক্তিয়ারভুক্ত নয়। দ্বিতীয়ত, ইংল্যান্ডের আইনে জালিয়াতির শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও ভারতের হিন্দু আইন বা মুসলমান আইনে তা নয়। বরং তৎকালীন আইন অনুযায়ী কোনো ব্রাহ্মণকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেত না। কিন্তু এইসব প্রশ্ন যখন ওঠে তখন পুনরায় বিচার করার আর কোনো সুযোগই নেই।
মহারাজা ততদিনে সমস্ত বিচারের উর্দ্ধে চলে গেছেন। ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে গেছে হাইকোর্টের প্রথম ফাঁসির আসামীর নাম, মহারাজা নন্দকুমার।
তথ্যসূত্রঃ কলিকাতা সেকালের ও একালের – হরিসাধন মুখোপাধ্যায়
ছবিঃ নেক্সট ফিউচার ম্যাগাজিন
কমেন্টস
মহারাজ নন্দকুমারের সম্পর্কে লেখাটি পড়ে ভাল লাগল।
লেখক মহাশয়কে ধন্যবাদ।